সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা

সংস্কার ছাড়া নতুন ধারার রাজনীতি কি সম্ভব?

কাজী সিরাজ

সংস্কার ছাড়া নতুন ধারার রাজনীতি কি সম্ভব?

বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশে নতুন ধারার রাজনীতি চালু করার কথা বলেছেন। প্রথমে অবশ্য তিনি রাজনীতির কথা বলেননি, বলেছিলেন ক্ষমতায় গেলে নতুন ধারার সরকার কায়েমের কথা। নতুন ধারার সরকার বা নতুন ধারার রাজনীতির চেহারা কেমন হবে সে ব্যাপারে পরিষ্কার করে তিনি কিছু বলেননি। কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা নেতার এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা লুকিয়ে রাখার কোনো বিষয় নয়। এ বিষয়ে জানার আগ্রহ বা কৌতূহল মানুষের মনে জাগা স্বাভাবিক। বিশেষ করে বর্তমান বড় বড় রাজনৈতিক দলের ওপর-নিচ সর্বত্র সৎ, আদর্শবাদী ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদদের অবমূল্যায়ন বা বিতাড়ন, রাজনৈতিক দলের লোকদের মধ্যে লুণ্ঠন সংস্কৃতির চর্চা, কালো টাকার মালিক, অস্ত্রবাজ-পেশিবাজদের গুরুত্ব, পরিবারতন্ত্র কায়েম ও নির্বাসিত গণতন্ত্রের যুগে এবং নির্বাচিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকারকে নির্বাচিত স্বৈরাচারে পরিণত করার নগ্নতায় নতুন ধারার রাজনীতি বা নতুন ধারার সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা শুনতে ভালোই লাগে। ভালো হতো বিরোধীদলীয় নেতা যদি পরিষ্কার করে বলতেন, তিনি আসলে কী করতে চান?

দুই. দেশে দুর্বৃত্তায়নের যে রাজনৈতিক ধারা সমগ্র দেশ ও জাতির সর্বনাশ করছে এই ধারার রাজনীতির অবসান হওয়া উচিত। একটি দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি-কৃষ্টি, সমাজব্যবস্থা, সর্বোপরি রাষ্ট্রাচারের বাতিঘর হচ্ছে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল যদি সঠিক পথে থাকে ও চলে, একটি জাতি-রাষ্ট্রের অন্য সব কিছুই সঠিক পথে চলে। দেশ এগিয়ে যায় উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে। দলের কোনো প্রাণ নেই। নিষ্প্রাণ এই দলে আলাদা ধরনের প্রাণের সঞ্চার করেন দলের নেতৃত্ব_ অবশ্যই রাজনৈতিক নেতৃত্ব। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে বিশেষ একটি ঐতিহাসিক উক্তি হচ্ছে_  A Leader is he, who knows the way. goes the way and shows the way.. অর্থাৎ তিনিই প্রকৃত নেতা যিনি সঠিক পথ চেনেন, সঠিক পথে চলেন এবং অন্যকে সঠিক পথ দেখান। আরও একটি উক্তি এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। 'একজন নেতার মধ্যে তিনটি গুণ অপরিহার্য। এক. তার উন্নত নৈতিক চরিত্র, দুই. জনগণকে আবেগতাড়িত করে পরিচালিত করার যোগ্যতা এবং তিন. জনগণকে রাজনৈতিক-আদর্শিকভাবে পরিচালনার যোগ্যতা।' যদি প্রশ্ন করা হয়, আমাদের প্রধান প্রধান দলের নেতা-নেত্রীরা কী সঠিক পথ চেনেন? এর সংক্ষিপ্ত জবাব বোধহয় এটাই হতে পারে যে, তারা পথহারা। পদস্খলনের ফলে তারা যে পথে হাঁটছেন, হাঁটেন তা জাতির জন্য মসৃণ ও কল্যাণের পথ নয়। তাদের অনুসৃত পথ খারাপ পথ, নষ্টকর্মস্থল এ পথের গন্তব্য। এ পথে তাদের ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা পারিবারিক কল্যাণ হয়তো আছে, জাতি-রাষ্ট্রের কপালে আছে ভোগান্তি। পরের দুটি বিষয়ের জবাবও সহজ। আমাদের বড় বড় দলের নেতারা সঠিক পথে চলছেন না। তারা চলছেন এক সর্বনাশা পথে। এ পথে চলে তারা নিজেরা অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন দেশ-বিদেশে, প্রাচুর্যের মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন, কিন্তু জনগণের দুঃখ-কষ্টের কোনো সীমা নেই। দুঃখ মোচনের আলোকিত পথ দেখাতেও ব্যর্থ এই নেতৃত্ব। ফলে গোটা জাতি আজ সংকটাপন্ন, জাতি প্রায় বিপন্ন। আর নেতৃত্বের অন্য যে তিনটি গুণের কথা বলা হয় তার মধ্যে একটি গুণ আমাদের প্রধান দুই দলের নেতৃত্বের ভেতর বিদ্যমান আছে, তা নির্দ্বিধায়, নিঃসন্দেহে বলা যায়। সেটি হচ্ছে জনগণকে আবেগতাড়িত করে চালানোর (নাচানোর?) যোগ্যতা। বাকি দুটি অর্থাৎ উন্নত নৈতিক চরিত্র ও জনগণকে আদর্শগতভাবে এগিয়ে নেওয়ার গুণ বা যোগ্যতা যদি আমাদের নেতা-নেত্রীরা প্রমাণ করতে পারতেন তাহলে এত আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ-রক্তপাতের পরও এ দেশ, এ জাতির কী বর্তমান করুণ দশা থাকার কথা? অথচ আমাদের দেশের যত বড় বড় অর্জন তার সবটার পেছনেই অবদান ছিল রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের। নব্বইয়ের পর আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব অতীতের সেই গৌরব ধরে রাখতে পারেননি। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান_ এদের কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও বিত্তলোভের কোনো অভিযোগ কী কখনো শোনা গেছে? তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে সবাই একমত নাও হতে পারেন কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত সততা ও নৈতিক চরিত্র নিয়ে কখনো প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে এক-এগারোর পর আমরা কী দেখলাম, কী শুনলাম? আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বসহ অনেকেই জেল খাটলেন রাজনৈতিক কারণে নয়, দুর্নীতির অভিযোগে। তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফখরুদ্দীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। নবম সংসদ নির্বাচনকে বিতর্কিত বললাম এই কারণে যে, ফলাফল পূর্ব থেকে নির্ধারণ করা না থাকলে বিদ্যমান বাস্তবতায় দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই ২৯ সিট পাওয়ার দল নয়। হারলেও এদের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা একশ প্লাস-মাইনাস হওয়ার কথা। অথচ বিএনপির মতো একটি দলকে ২৯ সিট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদ করা বা ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে শপথ না নেওয়ার সাহস তখন বিএনপি দেখাতে পারেনি নৈতিক দুর্বলতার কারণে। গাজীপুর ও চাঁদপুরের দুটি আসনের ব্যালট পেপার রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়ার কথা বলে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ মিনমিনে গলায় করেছিলেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনতার মঞ্চের অন্যতম নায়ক ড. শামসুল হুদার এক ধমকেই চুপ। সিইসি বলেছিলেন, নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করাও হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফলে এমন অসংখ্য অভিযোগই উত্থাপন করা যায়নি। বেগম খালেদা জিয়ার ছিল তার দেশান্তরী ও মামলাক্রান্ত দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের দুশ্চিন্তা। শোনা গেছে, নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে দুই ছেলেকে দেশে ফেরত এনে কঠোর দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে বলে বেগম খালেদা জিয়াকে পরোক্ষে ভয় দেখানো হয়েছিল। ফলে ওই নির্বাচনের বিরুদ্ধে ভয়ে আর কিছু বলেননি কেউ। বিএনপির ঘাঁটি এলাকা বলে পরিচিত ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা মহানগরীসহ ঢাকা বিভাগ ও সিলেট বিভাগে দলটি একটি আসনও পাবে না_ এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও যদি এমন ঘটত বা ঘটে তখনো তা বিশ্বাসযোগ্য হতো না, হবে না। সে কারণেই এমন একটা ধারণা জনমনে স্থায়ী আসন গেড়ে আছে যে, নবম সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ হয়নি, ওটা ছিল একটা এরেঞ্জড গেম। মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি সমঝোতার ফসল। যার ভিত্তিতে এক-এগারোর নায়ক মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন, আমিন, বারি, মাসুদউদ্দিনসহ সবাই একটা সেফ এঙ্টি পেয়েছেন হাসিনা সরকারের কাছ থেকে। ক্ষমতায় এসে লীগ সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তাদের দলের দুর্নীতির দায়ে জেল খাটা সব নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করে নেয় আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির সুপারিশক্রমে। কোনো মামলাই আদালত পর্যন্ত গড়াতে দেয়নি সরকার। আদালতে বিচার-বিশ্লেষণ হলো না, সওয়াল-জওয়াব হলো না, সব লীগ নেতা দুর্নীতির দায় থেকে খালাস পেয়ে গেলেন! কিন্তু আদালত তাদের এই সার্টিফিকেট দেননি যে, তারা দুর্নীতিবাজ নন। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, একই অভিযোগে একই ধরনের যেসব মামলা বেগম খালেদা জিয়াসহ বর্তমান বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছিল তার একটিও প্রত্যাহার করা হয়নি। অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির অন্য জেলখাটা নেতারা এখনো দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রেহাই পাননি। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আওয়ামী লীগ যেমন নিজেরাই নিজেদের বিচারক সেজে সৎ মানুষের খোলস পরেছে। বিএনপিও সুযোগ পেলে একই কাজ করবে। নিজেরাই আদালত, বিচারক সেজে নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা করবে। কিন্তু দেশের জনগণ কী তা বিশ্বাস করেছে, না করবে? তারা যেসব দুর্নীতি করেছেন (সবাই নয়) তা চোখ মেললেই দেখা যায়, হাত দিয়ে স্পর্শও করা যায়। কার কয়টা ফ্ল্যাট আর বাড়ি হয়েছে, কার কয়টা বিলাসবহুল গাড়ি আছে, কার শানশওকত কতটা বেড়েছে তার সবই প্রকাশ হয়ে পড়ে এক-এগারোর পর। রাজনীতির নামে, ক্ষমতার দর্পে যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে যা খুশি তা করেছেন এরা সবাই এদেশের মানুষ। অন্যের কাছে না হোক এলাকার মানুষ তাদের চেনে। আঙ্গুল ফুলে কারা কলাগাছ নয়, রীতিমতো তালগাছ বনে গেছেন মানুষ তা জানে। জ্বরের গরম আর টাকার গরম চেপে রাখা যায় না। ১০-১২ বছর আগে কার কী ছিল আর এখন কী কী আছে তার হিসাব ধরলেই তো বেরিয়ে আসবে অনেক নেতার প্রকৃত চেহারা। এদের নিয়ে, এদের সঙ্গে রেখেই কী হবে নতুন ধারার রাজনীতি আর নতুন ধারার সরকার? মান্দার গাছে কী কাঁঠাল হয়? শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন যে, তার দলে কিছু খারাপ লোক ঢুকে পড়েছে। দলের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেই আবর্জনা-জঞ্জাল সাফ করা দরকার। তিনি সেই উদ্দেশ্যে দলের ভেতর শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছিলেন। দল এবং বিভিন্ন অঙ্গদল থেকে বেশ কিছু খারাপ লোককে বহিষ্কার করেছিলেন। সে কাজ শেষ করে যেতে পারেননি বাংলাদেশের অদৃষ্টের সন্তান জিয়া। ২০০৭ সালের ২৫ জুন সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে শহীদ জিয়ার অসমাপ্ত কাজই শেষ করতে চেয়েছিলেন বিএনপির সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। তিনিও পারেননি। অগণতান্ত্রিক নগ্ন পন্থায় তাকে বহিষ্কার করা হয় দল থেকে। মান্নান ভূঁইয়ার মাপের আর একজন রাজনৈতিক নেতার জন্ম বিএনপিতে আবার কবে হবে কে জানে! তবে দলকে পরিশীলিত করে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে যোগ্য করে তোলার কথা এখন দলের মধ্যে অনেকেই ভাবছেন, এমনকি দলের প্রধান ব্যক্তিও। অন্যান্য দলের ভেতরও এ শুভ চিন্তা কাজ করছে। এটাই মান্নান ভূঁইয়ার সাফল্য।

বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবিত নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হলে প্রথমেই তাকে যে শর্তটি অপরিহার্যভাবে কার্যকর করার কথা ভাবতে হবে, তা হচ্ছে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে আমূল সংস্কারের মাধ্যমে দলের ভেতরকার নষ্ট ও খারাপ লোকগুলো বের করে দিতে হবে। কেননা নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকারব্যবস্থা কায়েমে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের বাহন হবে তার দল। দলই যদি নির্মল না হয়, আদর্শবাদী, সৎ, সাহসী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীতে সমৃদ্ধ ও সক্ষম না হয় তার স্বপ্ন কোনো দিনই বাস্তবায়ন হবে না। তিনি যা চাচ্ছেন তা মহৎ কাজ। অসৎ লোকদের সঙ্গী করে কী তিনি এই মহৎ লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন? তার দলেই এখনো প্রচুর সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি আছেন বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। সেই লোকদের সাইডলাইনে বসিয়ে না রেখে মূল টিমে নিয়ে এলে ফল ভালো হতে পারে। তার 'ফার্স্ট ইলেভেনেই' আগে হাত দেওয়া দরকার বলে মনে করেন তার অনুরাগীরা। এর পর সত্যিই যদি তিনি নতুন ধারার রাজনীতি প্রবর্তন করতে চান তাহলে তার সেই ইচ্ছা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রচুর সমর্থন তিনি পেয়ে যাবেন; তবে জামায়াত সঙ্গে থাকলে নয়। আবার জামায়াতকে সঙ্গে রেখে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক নতুন ধারার রাজনীতির কথা চিন্তাও করা যায় না। নতুন ধারার রাজনীতি তো বর্তমানকার কালো টাকা, পেশিশক্তি, লুণ্ঠনপ্রিয় ব্যক্তিদের দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক ধারার বিরুদ্ধে আদর্শবাদী দেশপ্রেমমূলক রাজনীতির ধারা। এটা করতে গেলে দলের ভেতর থেকেই তিনি প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হবেন। তিনি কী পারবেন সে বাধার প্রাচীর গুঁড়িয়ে দিতে? দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে এই যাত্রায় তার সহযাত্রীর অভাব হবে না।

তিন. নতুন ধারার সরকারের কথাও বলেছেন তিনি। সেই সরকারের রূপরেখা কেমন হবে? দুনিয়াজুড়ে দুই ধরনের সরকার পদ্ধতি এখনো বেশ জনপ্রিয়_ সংসদীয় সরকার পদ্ধতি ও প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার পদ্ধতি। দেশ ও জনগণের সেবায় কোনো নেতা ও দল যদি আন্তরিক হয়, গণতন্ত্রের প্রতি যদি সত্যিই অনুরাগ থাকে, তা হলে যে কোনো পদ্ধতিতেই দেশ পরিচালনা করা যেতে পারে। কিন্তু নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার বা সংসদীয় পদ্ধতির সরকার যদি নির্বাচিত স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হয় তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির নির্বাচিত সরকার এবং বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সংসদীয় পদ্ধতির নির্বাচিত সরকারের অভিজ্ঞতা জনগণের কাছে সুখকর নয়। বেগম জিয়ার কাঙ্ক্ষিত নতুন ধারার সরকার যদি জনগণের খারাপ অভিজ্ঞতা বদলে দিতে পারে মন্দ কী! বেগম জিয়া নতুন ধারার সরকার বলতে কী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যমূলক সরকার পদ্ধতির কথা ভাবছেন? নাকি সেনা-রাজনৈতিক সরকারের কথা ভাবছেন একটি কার্যকর ও শক্তিশালী সরকার গঠন করার জন্য_ যে সরকার এক মেয়াদের পরই গণধিকৃত হয়ে যাবে না। অনেকে বলছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যমূলক সরকারের কথাই বোধহয় ভাবছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক্ষেত্রে একজন দেশপ্রেমিক, সৎ, গুণী ও যোগ্য ব্যক্তির যদি আগমন ঘটে, তাহলে এ ধরনের সরকার একটি কার্যকর সরকার হতে পারে- যেখানে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে, প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টকে 'কেয়ার' করবেন। বেগম খালেদা জিয়া আরও একটি কারণে এ ধরনের সরকারব্যবস্থা চাইতে পারেন বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। আমাদের মতো দেশে সরকার গঠনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের একটি অপ্রকাশ্য ভূমিকার কথা আমরা সবাই জানি। বর্তমান পদ্ধতিতে বিএনপি জোট যদি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারে বেগম খালেদা জিয়াই প্রধানমন্ত্রী হবেন। সরকার গঠনে যাদের ভূমিকার কথা বললাম, তারা বোধহয় এবার বেগম জিয়ার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। তারা এমনও হয়তো ভাবছেন, বেগম জিয়ার দল জিতলে বাংলাদেশ এক মেয়াদেই দুজন প্রধানমন্ত্রী পাবে_ যা তারা চায় না। তাই বেগম জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বেই তারা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারেন। সে জন্য বেগম খালেদা জিয়া একক ক্ষমতার চিন্তা পরিহার করে যৌথ ক্ষমতার সরকারের কথা ভাবতে পারেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এমন ভাবনা মন্দ নয়। তবে এই ভাবনা বাস্তবায়নে বাহন তথা তার দলকে অবশ্যই উপযুক্ত হতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected] 

 

 

 

সর্বশেষ খবর