শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও নতুন ধারার সরকার

ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও নতুন ধারার সরকার

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, 'ভবিষ্যতে প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রাষ্ট্র ও সরকার কাঠামোর কিছু সংস্কারের চিন্তা রয়েছে বিএনপির। যাতে রাষ্ট্র আরও গতিশীল হয়, গণতন্ত্র সুদৃঢ় হয়।' তিনি আরও বলেছেন, 'আমাদের নেতা খালেদা জিয়ার একটি চিন্তা হচ্ছে সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করে কীভাবে আরও কার্যকর ও জনগণের জন্য কল্যাণকর করা যায়। এরই মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়ে জাতীয় ঐক্য হলে তখন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এর একটি রূপরেখা তৈরি করা হবে' (সূত্র : মানবজমিন, ১৩ আগস্ট, ২০১৩)। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াও এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে নতুন ধারার সরকার বাস্তবায়ন করবে। অনেকে মনে করেন, তারা ওই কথাগুলো কোনো রাষ্ট্রচিন্তা কিংবা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থেকে বলেননি। তারা কর্মসূচিবিহীন রাজনীতিতে কিছুটা গতি আনার জন্য ও বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে আনার জন্য উপরোক্ত বক্তব্য দিয়েছেন। শুধু তিনিই নন, অন্য রাজনীতিবিদরাও মাঝে-মধ্যে চমক সৃষ্টি করতে এ জাতীয় কথা বলে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি বলেছেন, তারা আবারও সরকার গঠন করতে পারলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বড় দল দুটি প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, সুশাসন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণের জন্য নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ দুজনই ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ ও দুর্নীতি নিমর্ূলের শপথ নিয়ে। তাদের সৃষ্ট 'গ্রাম সরকার' ও 'উপজেলা' গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোনো কাজে আসেনি। বরং এতে শতবর্ষীয় তৃণমূল প্রতিষ্ঠান ইউনিয়নকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তারপরও বড় দল দুটির কাছেই আমাদের বারবার আশা করতে হয়। যেহেতু দল দুটির খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসার আপাতত কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ধরা যাক, বিএনপি আন্তরিক উদ্দেশ্যেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা বলেছে। কিন্তু সংসদের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি আসবে কোত্থেকে! এ দেশে তো প্রদেশ নেই। তাহলে কি প্রথমে ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে? যদিও কিছু রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী দীর্ঘদিন থেকে সংসদের উচ্চকক্ষের জন্য প্রদেশ বাস্তবায়নের কথা বলে আসছেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো_ এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখেও প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণসহ সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা সম্ভব। যেমন_ প্রত্যেক জেলাকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিয়ে জেলা থেকে প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সংসদের 'উচ্চকক্ষ' সৃষ্টি করা যেতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জেলা পরিষদ প্রশাসকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করতে পারলে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। কেন্দ্রের হাতে শুধু পলিসি তৈরি, মনিটরিং ও বাজেট বরাদ্দের দায়িত্ব থাকবে। বাকি সব ক্ষমতা স্তরে স্তরে ছেড়ে দেওয়া হবে। ... ... ... ভবিষ্যতে জেলা পরিষদের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্থানীয়ভাবে সব উন্নয়নের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হবে' (আ. সময়, ২৭ আগস্ট, ২০১৩)। তিনি এর কয়েক দিন পর সচিবদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় একই কথা আবারও বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে অনেকে বাকশালে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত মনে করছেন। আবার যারা 'বাকশাল' ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে তুলনা করেন তারাও ভুলের মধ্যে আছেন। বাকশাল ব্যবস্থা ছিল প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ আর গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকেন্দ্রীকরণ এক বিষয় নয়। এ ছাড়া 'বাকশাল' পদ্ধতিতে জেলাকে গ্রামভিত্তিক স্থায়ী প্রতিষ্ঠান মনে করা হয়েছিল। আমরা জানি, গ্রামের উন্নয়ন হওয়া মানে নগর হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ জেলার অধীনস্থ গ্রামগুলোর চরিত্র পরিবর্তন হওয়া মানেই সমগ্র জেলার চরিত্র পরিবর্তন হয়ে যাওয়া। কিন্তু 'বাকশাল' ব্যবস্থায় নগরায়ন, নগরীয় কৃষি, নগর সরকার ইত্যাদি বিষয়ে কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা ছিল না। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশে এককেন্দ্রিক ও অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। অনেকে বর্তমান সরকার ব্যবস্থাকে মন্ত্রিপরিষদ সরকার না বলে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার বলাই অধিক যৌক্তিক মনে করেন। সে জন্য কিছু রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য ফেডারেল সরকার ব্যবস্থার বাস্তবায়ন চান। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চকণ্ঠ রয়েছেন জাসদের একসময়ের তাত্তি্বক গুরু সিরাজুল আলম খান, জেএসডি নেতা আ. স. ম আবদুর রব, জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রমুখ ব্যক্তি। সবার জানা আছে, সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতাযুদ্ধে চার খলিফার এক খলিফা ছিলেন এবং 'নিউক্লিয়াস' নামে কমিটি গঠন করে স্বাধীনতার রূপরেখা তুলে ধরেন। পরবর্তী সময়ে তিনি জাসদের তাত্তি্বক গুরু হন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের 'সরকার ব্যবস্থা' কেমন হবে, স্থানীয় সরকারগুলো স্বশাসিত হবে কি-না ইত্যাদি সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা দেননি। বর্তমানে তিনি 'সামাজিক শক্তি' নামক এক সংগঠনের ব্যানারে অংশীদারিত্ব গণতন্ত্রের জন্য প্রাদেশিক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন চান। তার মতে, 'বাংলাদেশের চেয়েও ছোট দেশ যেমন- শ্রীলঙ্কা, নেদারল্যান্ডস, মাইক্রোনেশিয়া, নেপালসহ বহু দেশেই প্রাদেশিক ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার প্রয়োজনে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন জরুরি।' সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও দীর্ঘদিন প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চাচ্ছেন। তিনি সমগ্র দেশটিকে আটটি প্রদেশে ভাগ করে ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য পোস্টার-লিফলেট বিতরণ করেছেন। তিনি প্রদেশগুলোর নাম রেখেছেন_ জাহাঙ্গীরাবাদ, ময়নামতি, চট্টলা, জালালাবাদ, চন্দ্রদ্বীপ, জাহানাবাদ, বরেন্দ্র ও উত্তরবঙ্গ। তিনি প্রায় নয় বছর দেশ শাসন করেছেন, কিন্তু তখন এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। তিনি প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের নামে 'উপজেলা' নামক একটি বাহুল্য স্তর সৃষ্টি করেন। কিন্তু এ স্তরটির কাজ কি হবে, এর সঙ্গে ইউনিয়ন ও পৌরসভার সম্পর্ক কি হবে ইত্যাদি বিবেচনায় না নিয়ে এর পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। অনুরূপভাবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ইউনিয়নের নিচে 'গ্রাম সরকার' নামে আরেকটি বাহুল্য স্তর সৃষ্টি করেন। ফলে স্থানীয় সরকারের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্তের শিকার হয়। বর্তমান সরকারও উপজেলার ত্রুটিগুলো বিবেচনায় না নিয়ে পুনরায় উপজেলা নির্বাচন দিয়েছে। আবার সম্প্রতি সংসদ সদস্য ও এলডিপি নেতা ড. কর্নেল অলি আহমদ (অব.) 'কেন্দ্রীভূত শাসন নয়, চাই ১৩ প্রদেশ' নামক এক কলামে ১৩টি প্রদেশের বাস্তবায়ন চেয়েছেন। তিনিও মনে করেন, বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও এখানে ১৬ কোটি মানুষের বসবাস। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশ রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা যুক্তিসঙ্গত নয় (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ আগস্ট, ২০১৩)। অর্থাৎ তাদের সবার মতে, প্রদেশ সৃষ্টি করার মাধ্যমেই কেবল সংসদের উচ্চকক্ষ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ সবকিছু বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু দেশের আয়তন, জনসংখ্যা, ভৌগোলিক অবস্থান ও ইতিহাস-ঐতিহ্য বিবেচনায় নিলে এ দেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নযোগ্য নয়- এটা কেউই বলছেন না। এ ছাড়া প্রাদেশিক ব্যবস্থার সিস্টেম কস্ট কোথা থেকে আসবে- এ কথাও কেউ বলছেন না। পাশর্্ববর্তী দেশ ভারতে আঞ্চলিক বৈষম্য থাকার কারণে মাঝে-মধ্যে প্রদেশ প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপিত হয়। আমাদের দেশে তেমন আঞ্চলিক বৈষম্য নেই। যতটুকু আছে তা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে ক্রমান্বয়ে দূরীভূত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখেও গণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা সম্ভব। ব্রিটিশ সরকার এ দেশ শাসনের স্বার্থে বহু স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার সৃষ্টি করে (যদিও নিজ দেশে সেরকম ব্যবস্থা নেই)। তারা প্রথমে উপরে 'জেলা' ও নিচে 'ইউনিয়ন' সৃষ্টি করে শাসনকার্য শুরু করে। সে জন্য জেলা ও ইউনিয়ন আলাদা ঐতিহ্য ও পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে ৬৪টি জেলা রয়েছে। জনসংখ্যা বিবেচনায় প্রতিটি জেলাকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিয়ে স্ব-শাসন দিতে হবে (বর্তমানে প্রত্যেক জেলায় গড়ে প্রায় ২৭ লাখ লোক বসবাস করছে, যা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশের গোটা দেশের জনসংখ্যার সমান)। এ প্রস্তাবে বিভাগকে বিলুপ্ত করতে হবে। জেলা হবে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট। জেলা এক হাতে গ্রামীণ ইউনিট (ইউনিয়ন ও উপজেলা) এবং অন্য হাতে নগরীয় ইউনিটগুলোকে (পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড) তত্ত্বাবধান করবে। জেলাতে সরকার কাঠামো প্রতিস্থাপন করে 'জেলা সরকার' নাম দেওয়া যেতে পারে। জেলা প্রশাসন, জেলা সংসদ ও জেলা আদালত মিলে 'জেলা সরকার' গঠিত হবে। জেলা সরকারের বাইরে একজন জেলা ন্যায়পাল ও জেলা নির্বাচনিক বোর্ডও থাকবে। জেলা ন্যায়পাল জেলা সরকারের তিন বিভাগের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিষ্পত্তি করবেন। জেলা নির্বাচনিক বোর্ড জেলা সরকারের মেয়াদ শেষে স্ব-উদ্যোগে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষের জন্য সমগ্র জেলা থেকে দুজন প্রতিনিধি (একজন পুরুষ ও একজন নারী) নির্বাচিত হবেন। অর্থাৎ ৬৪টি জেলা থেকে ১২৮ জন প্রতিনিধি মিলে 'উচ্চকক্ষ' গঠন করবে। উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিরা দেশের কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, অভিনেতা তথা বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। স্থানীয় সরকারের অন্য ইউনিটগুলোতেও 'সরকার কাঠামো' প্রতিস্থাপন করে সেগুলোকে স্ব-শাসন দিয়ে দিতে হবে (যেমন_ ইউনিয়ন সরকার ও নগর সরকার)। 'রাষ্ট্রপতি' পদটি সর্বদলীয় করার জন্য এর নির্বাচন জাতীয় সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে করা যেতে পারে। মনে রাখা দরকার, আগামীর বাংলাদেশ মানে 'গণতান্ত্রিক নগরীয় বাংলাদেশ'। সে জন্য স্থানীয়দের ক্ষমতায়নের স্বার্থে সরকার কাঠামো সংস্কারের জন্য যা যা প্রয়োজন তা এখন থেকেই শুরু করতে হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, জানিপপ; সহলেখক : প্রফেসর ড. এ. কে. এম. রিয়াজুল হাসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিসিএস শিক্ষা; এবং মোশাররফ হোসেন মুসা, সদস্য, সিডিএলজি।

ই-মেইল- [email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর