বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

কঠোর কর্মসূচি, সংলাপ ও অন্য প্রসঙ্গ

সাদেক খান

কঠোর কর্মসূচি, সংলাপ ও অন্য প্রসঙ্গ

অনেক ধৈর্য ও প্রতীক্ষার পর ১৮-দলীয় জোটের নেতা-কর্মী, সমর্থকরা এবং দুঃশাসনে অতিষ্ঠ দেশবাসী তাদের দীর্ঘ-প্রত্যাশিত 'কঠোর কর্মসূচি'র সূত্রপাত দেখতে পেল। তার 'প্রাথমিক' ঘোষণা এসেছে ২৫ অক্টোবর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরকার অনুমোদনে অনুষ্ঠিত জনসভায় উপচেপড়া লোকারণ্যে সংসদীয় বিরোধী দলনেতা বেগম খালেদা জিয়ার মুখে। অবশ্য সোজা আঙ্গুলে সরকারি অনুমোদনের ঘি ওঠেনি। ১৮ অক্টোবর সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে এক টেলি-ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে চলমান রাজনৈতিক সংকটের মীমাংসার জন্য সংলাপের দ্বার উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে সংবিধানে হাল আমলে সংযোজিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্যেই সরকারের নির্বাচন-পূর্ব তত্ত্বাবধায়ক মেয়াদের জন্য একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব প্রকাশ করেন। তাতে বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কোন দলের কত সদস্য আনুপাতিকহারে বা বোঝাপড়ার মাধ্যমে নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনার জন্যই ছিল তার আহ্বান। আর স্বয়ংসিদ্ধ হিসেবে উহ্য ছিল তার স্বপদে বহাল থাকার কথা। এতদিন ধরে তার দল এবং মন্ত্রীদের প্রচারবাদ্য সেই ধুয়াই তারস্বরে বাজিয়ে চলেছে। নানামুখে নানা ব্যঞ্জনার মধ্যে যার বেদবাক্য 'শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে'। আর ১৮-দলীয় বিরোধী জোট নেতারও এক কথা_ 'শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না ১৮ দল, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। না হলে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।'

১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর মুখে সংলাপের ওই 'অস্পষ্ট' রূপরেখা ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরদিন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের তরফে রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশে প্রকাশ্য কিংবা ঘরোয়া সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে একরকম আংশিক বেসামরিক জরুরি অবস্থার ফরমান জারি হলো। প্রধানমন্ত্রী সংলাপের যে দাবার চাল চাললেন তা নিয়ে প্রকাশ্য বিরুদ্ধতা বা মতদ্বৈধতা প্রকাশের সুযোগ সঙ্কোচিত করে টেলিটক ও সংবাদপত্রের 'নিয়ন্ত্রিত' প্রচার মাধ্যমে সেই চালের পক্ষে প্রশংসাবাক্য, পুরোপুরি ধামাধরা বা নিম সমর্থন, কিংবা মেকি সমালোচনা দিয়ে জনমতের বাজারমাত করার ব্যবস্থা হলো। একই সঙ্গে চলল ১৮-দলীয় জোটের ঐক্যশক্তিকে বিভক্ত করার লক্ষ্যে ওই নিষেধাজ্ঞার আওতায় রাজধানীতে পরিকল্পিত আটকাভিযান, ধর-পাকড়, সাজানো মামলা-হামলার দৌরাত্দ্য। আনুষঙ্গিক স্বীকার সাব্যস্ত হলো ২০ তারিখ বাংলাদেশ-চীনমৈত্রী বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ঘরোয়া মহাসমাবেশ বা কনভেনশন, যেখানে সংসদীয় বিরোধী দলনেতা প্রধান অতিথি। এর আগে একই সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মিলিত ব্যবসায়ীদের সমাবেশে সংসদীয় বিরোধী দলনেতার বক্তব্য যেভাবে শিল্প-বাণিজ্যে বিনিয়োগ বা ব্যবস্থাপক সব তরফের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মনোযোগ আকর্ষণ করে সেটা সরকারপ্রধানকে বিচলিত করেছিল। সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ডেকে তিনি এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন বলেও প্রকাশ। সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ঘরোয়া কনভেনশন এভাবে শান্তিরক্ষার নামে বানচাল করার স্বেচ্ছাচারী নিষেধাজ্ঞায় ক্রুব্ধ বিরোধী দলনেতা খালেদা জিয়া কনভেনশনের সংগঠকদের পরামর্শ দিলেন ওই অন্যায় নিষেধাজ্ঞা ভেঙে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জড়ো হতে। বললেন, তিনি নিজে কনভেনশনে এসে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবেন। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদেরও খবর দিলেন। শেষ পর্যন্ত কিছু তথাকথিত 'শর্তসাপেক্ষে' ওই ঘরোয়া কনভেনশনের অনুমতি দিল নগর পুলিশ-কর্তৃপক্ষ। পেশাজীবী সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে খালেদা জিয়া বললেন, ক্ষমতাসীন সরকার গণনির্যাতনের সরকারে পরিণত হয়েছে। যাকে খুশি ধরে, যাকে খুশি ফাঁসি দেয়। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না বিরোধী জোট। এই গণবিরোধী সরকারের পতনের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে; পেশাজীবীদের জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে।

২০ অক্টোবরের পরও সরকার রাজধানীতে নাগরিক সভা-সমাবেশের মৌলিক অধিকার হরণকারী নিষেধাজ্ঞা চালু রাখল, অব্যাহত রাখল ধর-পাকড়, মামলা-হামলার দমনকৌশল। ইতোমধ্যে রাজধানীর বাইরে সারা দেশে ১৮-দলীয় জোটের পূর্ব-ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে এবং মিথ্যা মামলা, অত্যাচার, অবিচার, সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক গুম-খুন অপহরণ, হামলা, গ্রেফতার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-সমাবেশ, কোথাও কোথাও অন্যায়ভাবে আটক, স্থানীয় বা জাতীয় নেতাদের মুক্তির জন্য জেলা-উপজেলা শহরে সকাল-সন্ধ্যা বা আধাবেলা হরতাল পালনে অস্থির হয়ে উঠেছে সারা দেশ। পুলিশি নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে দেশের নানা জায়গায়। রাজধানী ঢাকায় ঝটিকা মিছিল নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে থেকে থেকে পাড়ায় পাড়ায় বিরোধী দলের স্লোগানে মুখরিত করেছে জনজীবন।

২১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে সংসদীয় বিরোধী দলনেতা খালেদা জিয়া ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক ২০ জন উপদেষ্টার মধ্য থেকে ১০ জনকে নিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সুনির্দিষ্ট পাল্টা প্রস্তাব দিলেন। সর্বদলীয় সরকার গঠনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া প্রস্তাবকে অস্পষ্ট, অসামঞ্জস্য ও অগ্রহণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করে নিজের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। বলেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে দুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে একবার আওয়ামী লীগ ও একবার বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। ওই দুটি সরকারের উপদেষ্টারা তাদের নিরপেক্ষতার জন্য সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। তাই ওই দুই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে ১০ জনকে নিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হোক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই পাঁচজন করে উপদেষ্টার নাম প্রস্তাব করবে। সরকার ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে ওই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা যেতে পারে এবং যেভাবে রাষ্ট্রপতি, স্পিকার ও মহিলা সংরক্ষিত এমপি নির্বাচিত করা হয় সেভাবে নির্বাচনকালীন ওই অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনবোধে সংসদ ভেঙে যাওয়ার আগে নির্বাচিত করা যেতে পারে বলে বিশদ প্রস্তাব রাখলেন খালেদা জিয়া। ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতে আলোচনার জন্য ২২ অক্টোবর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব পোশাকিভাবে চিঠি পাঠালেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে। জবাব মুলতবি রাখল সরকারপক্ষ। অন্যদিকে রাজধানীতে জরুরি অবস্থার শামিল নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকায় প্রায় এক মাস আগে ১৮-দল ঘোষিত ২৫ অক্টোবরের জনসভা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। যে কোনো মূল্যে ওই জনসভা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিলেন বিএনপি নেতারা। নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের মহড়া চলতে থাকল ঢাকায় এবং ১৪৪ ধারা জারি করা হলো অন্যান্য মফস্বল শহরে। ২৪ অক্টোবর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের একটা ঘরোয়া সমাবেশের 'শর্তসাপেক্ষ' অনুমতি দিল সরকার। সেখানে খালেদা জিয়া ঘোষণা করলেন_ 'আজ থেকে সংসদের সাংবিধানিক মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আপনাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার নৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে জনগণের। এই অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। এতদিন সরকার বলেছিল নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের ফর্মুলা দিন। আমরা জাতীয় সংসদ ও সংসদের বাইরে সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছি। ফর্মুলায় যা বলেছি তা সংবিধানসম্মতভাবে করা সম্ভব। এখন সমাধানের বল আপনাদের কোর্টে।' ২৫ অক্টোবর বিএনপি দলীয় কার্যালয়ের সামনে আহূত ১৮-দলীয় সমাবেশের অনুমতি প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া আবারও হুঁশিয়ারি দিলেন, 'ধানাই-পানাই না করে সমাবেশের অনুমতি দিন। বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন না। করলে তার দায়-দায়িত্ব আপনাদের। বিএনপি ও ১৮-দলীয় জোট অশান্তি-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না।'

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন ২৪ অক্টোবর হবে পঞ্চদশ সংশোধনী অনুসরণে চলমান জাতীয় সংসদের নির্বাচন-পূর্ব শেষ অধিবেশন।

সেই মোতাবেক সরকারেরও সংসদের কাছে জবাবদিহিতা লোপ পেয়ে বৈধতা শেষ হয়, রাষ্ট্রপতির কাছে জবাবদিহিতা স্বীকার করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমিত ক্ষমতায় পরিচালিত হতে পারে সরকার, এমন হিসাব থেকেই বিরোধী দলনেতা সরকারের নির্বাহী ক্ষমতার বৈধতা শেষ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু পাল্টা চালাকি করলেন সরকারপ্রধান। সংসদের চলতি অধিবেশনের মেয়াদ ৭ নভেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করার ব্যবস্থা হলো। পঞ্চদশ সংশোধনী মোতাবেক ২৭ অক্টোবরের পরে কোনোক্রমেই এই সংসদ অধিবেশন চলতে পারে না বলে মতপ্রকাশ করলেন কয়েকজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ। কিন্তু কে কার কড়ি ধারে!

২৪ অক্টোবর বরিশালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ঘোষণা করলেন, সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন। কোনো দল কিংবা গোষ্ঠী নির্বাচনে না এলে তার জন্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নির্বাচনে আসবে না, কিংবা প্রতিনিধি নির্বাচন করবে না, সেটা হতে পারে না। সারা দেশে আজ সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ। দেশে কোথাও কোনো গোলমাল বা অস্থিরতা কিছুই হবে না। বিরোধী দলের গুটিকয়েক নেতা এ নিয়ে গুজব ছড়িয়েছেন। তারা যাতে দেশে কোনো বিশৃঙ্খলা না করতে পারে, সে জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশালসহ সারা দেশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৮-দলীয় জোটের পূর্ব-নির্ধারিত সমাবেশের জন্য বিএনপিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তার বদলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসমাগমের অনুমতি দেওয়া হলো। সেখানে বেগম জিয়া কঠোর কর্মসূচি দিলেন, ২৭ অক্টোবর রবিবার সকাল ৬টা থেকে ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সারা দেশে লাগাতার হরতাল। সরকারের সঙ্গে তার প্রস্তাবিত নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সম্ভাব্য আলোচনা আর রাজপথে আন্দোলন একই সঙ্গে চলবে। সরকারপ্রধানকে দুই দিনের আলটিমেটাম বা চরমপত্রের ঘোষণা দিয়ে তিনি বললেন : 'জনগণ অনেক আগেই প্রধানমন্ত্রীর (নেতৃত্বে সর্বদলীয় সরকার গঠনের) ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখন আমাদের ফর্মুলা গ্রহণ করতে হবে। সংসদে প্রস্তাব দিতে বলেছেন, দিয়েছি। আমাদের মহাসচিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে চিঠি দিয়ে আলোচনায় বসতে বলেছে। আপনাদের সদিচ্ছা থাকলে এতদিনে আলোচনায় বসতেন। কিন্তু সদিচ্ছার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আপনারা ভাবছেন পুলিশ-র্যাব দিয়ে একতরফা নির্বাচন করবেন, তা হতে দেওয়া হবে না। তাই আমি আপনাদের বন্ধু হিসেবে বলছি, আসুন একসঙ্গে বসে সংবিধান সংশোধন করি। আমি যে ফর্মুলা দিয়েছি, তাতে সংবিধান বেশি সংশোধন করতে হবে না। সামান্য সংশোধন করলেই হয়ে যাবে। প্রতিক্রিয়া এলো প্রধানত অন্য আওয়ামী ও ১৪-দলীয় 'আদর্শিক' জোটনেতা কারও কারও তরফে। তাদের এক কথা : সংবিধান মোতাবেকই নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার অধীনে, প্রধানমন্ত্রীর 'উদার' আহ্বানকে সংসদীয় বিরোধী দলনেতা উপেক্ষা করলে খালেদা অনুসারীদের বাদ দিয়ে অন্যদের নিয়েই নির্বাচন করবে মহাজোট সরকার। তবে ৬০ ঘণ্টার হরতাল শুরু হওয়ার প্রায় ১২ ঘণ্টা আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিভিশন ক্যামেরা এবং উপস্থিত দলীয় নেতাদের সামনে খালেদা জিয়াকে ফোন করে সংলাপে আহ্বান করলেন, গণভবনে সান্ধ্যভোজের দাওয়াত দিলেন। ফোনে অপরপক্ষের জবাব অবশ্য টেলিভিশনে আসেনি। পরবর্তী সময়ে প্রকাশ, দুপুর থেকেই খালেদা জিয়াকে ফোন করছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাষণকে কপট আখ্যা দিয়ে খালেদা বলেছেন : তার লাল ফোন তো খারাপ ছয় মাস ধরে, সেখানে ফোন করলে আওয়াজ হবে কি করে? স্পষ্ট করে বলেছেন, হরতাল চলবে, তবে প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াতও তিনি কবুল করতে রাজি আছেন হরতাল শেষ হলে ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে যে কোনো সময়। নীতিগতভাবে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয় মেনে নিলেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি আন্দোলনের সব ধরনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে সম্মত হবেন।

সুশীলসমাজ, কূটনৈতিক ও মিডিয়া মহলের একাংশ মনে করছেন বা ভান করছেন এভাবে শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতির দুই নেত্রীর প্রারম্ভিক ফোনালাপের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের দ্বার-উন্মোচন হয়েছে। কিন্তু কার্যত দেশবাসী দেখছে, সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। ৬০ ঘণ্টার লাগাতার হরতালের প্রস্তুতির দিনেই দেশের বিভিন্ন স্থান মিলিয়ে অন্তত ছয়জনের মৃত্যু ঘটেছে, আহত হয়েছে পাঁচশর বেশি, গ্যাংকেস বা দঙ্গলের মামলা হয়েছে হাজারো অজ্ঞাতনামা মানুষের বিরুদ্ধে। হরতালের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে অনুরূপ সংখ্যায় সংঘর্ষে বা পুলিশের গুলিতে মারা গেছে হরতালকারী ও হরতালবিরুদ্ধ দুই পক্ষের মানুষ, আহত হয়েছে পুলিশেরও অনেকে। সরকারপক্ষ র্যাব-পুলিশ নিয়োগ ছাড়াও গোপনে দলীয় মাস্তানদের আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রেললাইন উপড়ে ফেলেছে, রেলের বগিতে আগুন দিয়েছে, ভাঙচুর করেছে হরতালকারীরা। দেদার ককটেল ফুটেছে সরকারপক্ষের লোক এবং বিরোধী পক্ষের লোক উভয়েরই কারও কারও বাড়ির সামনে। মারা গেছে উভয়পক্ষ মিলিয়ে চার দিনে সরকারি হিসাবে ২৪ জন। বেসরকারি মতে আরও অনেক বেশি। আগুনে পুড়েছে উভয়পক্ষের কার্যালয়। কোথাও কোথাও পুলিশের হাতে নেতৃস্থানীয় মানুষের অবমাননা কিংবা গ্রেফতারের সম্ভাবনার কথা শুনে গ্রামের মানুষ তীর-ধনুক, লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দেশব্যাপী 'অভ্যুত্থান' ঘটতে শুরু করেছে।

হরতালের 'প্রাথমিক' কর্মসূচির অবসানে ও হরতাল দমনে ঘোর সহিংসতায় এখন বিরতি চলছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের প্রত্যাশা সরকারপক্ষ তার চিঠির জবাবে সংলাপের উদ্যোগ নেবে। গণভবনে মহাজোটভুক্ত বা মহাজোট-বহিভর্ূত কিছু দলের সঙ্গে নির্বাচনকালীন 'সর্বদলীয়' সরকার গঠনের যে আলোচনা প্রধানমন্ত্রী করছেন, তার ধারাবাহিকতায় যেচে কোনো আমন্ত্রণ চাইবে না বিএনপি। তাদের চিঠির জবাবে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণের অপেক্ষা করবে। সেই আমন্ত্রণ না এলে বিরতির পর ১৮-দলীয় জোট নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত 'অভ্যুত্থান' কি রূপ নেবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না দেশবাসী। অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতার সর্বনাশা কালো ছায়ায় আচ্ছন্ন সারা দেশ।

লেখক : সাংবাদিক

 

 

সর্বশেষ খবর