বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩ ০০:০০ টা

তাল গাছটি কিন্তু আমার!!

শেখ শহীদ

ইংরেজি ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ৪৫ জনের সম্মিলিত একটি দল প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন হিসেবে মোজাম্বিক গমন করে। ওই দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল। আমরা ছিলাম মোজাম্বিকের নামপুলা প্রদেশে। মোজাম্বিকে জাতিসংঘের ওই শান্তিরক্ষী তৎপরতা সর্বতোভাবে সফল হয়। মোজাম্বিকে প্রায় ৫ মাস থাকার পর একই উদ্দেশ্যে আমাদের ওই দলের মধ্য থেকে ২১ জনকে বাছাই করে রুয়ান্ডাতে প্রেরণ করা হয়। ওই ২১ জনের মধ্যে আমিও ছিলাম।

রুয়ান্ডা দেশটা অনেক সুন্দর, চির বসন্তের দেশ। এত সুন্দর আবহাওয়া, অনেক সুন্দর প্রকৃতি, পাহাড় ঘেরা সবুজ দেশটি অনেক প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদেও ভরপুর। রুয়ান্ডাতে দুটি জাতি গোষ্ঠীর বসবাস, হুতু ও তুতসি। হুতুরা সংখ্যায় বেশি আর তুতসিরা সংখ্যায় কম। ভাষা এক, বর্ণ এক, সংস্কৃতি একই, চেহারাও প্রায় একই রকম। শুধু হুতুরা একটু লম্বাটে, তুতসি একটু বেঁটে। অনেক হুতু-তুতসি বিয়ে-শাদী করে বেশ শান্তিতেই ঘরকন্না করছে। তবুও এই দুটি গোত্রের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে বিবদমান গণ্ডগোল ও হানাহানি সেটা মেটানোর জন্য এবং তাদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ, বেলজিয়াম, ঘানাসহ কয়েকটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছাড়াও নানা পেশার বেসামরিক লোকজন, আমরা রুয়ান্ডাতে গিয়েছিলাম শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ, হানাহানি ও ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তপাত নিরসন করতে।

অগ্রবর্তী দল হিসেবে আমরা ২১ জনই প্রথমে রুয়ান্ডার মাটিতে পা রাখি। রুয়ান্ডার সঙ্গে সব যোগাযোগ সড়ক এবং আকাশপথে, তাদের সীমানার সঙ্গে কোনো নৌপথ নেই। এ জন্য তারা কেনিয়া এবং তানজানিয়ার ওপর নৌপথের জন্য নির্ভরশীল। প্রথমে আমাদের থাকার জন্য রাজধানী কিগালি স্টেডিয়ামে ব্যবস্থা করা হয়। পরে আমাদের দলটিকে একটা ভাড়া বাড়িতে রাখা হয়। খাবার জন্য হোটেল 'চি লন্ড'তে ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাসার কাছেই হোটেল, পাঁচ মিনিট লাগত হেঁটে যেতে। আমাদের শুধু কিগালি এয়ার পোর্টে কাজ করতে হতো এবং বাকি সময়টা ছিল অখণ্ড অবসর।

আমরা অবসর সময়ে বিশেষ করে বিকাল ও সন্ধ্যায় আশপাশে হাঁটাচলা করতাম এবং স্থানীয় লোকজনের মধ্যে যারা ইংরেজি বুঝতে পারে তাদের সঙ্গে আলাপচারিতা ও তাদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করতাম। এভাবেই আমার সঙ্গে রুয়ান্ডার আর্মির এক কর্নেলের পরিচয় হয়।

কর্নেল সাহেব ছিলেন খুব আমুদে এবং সোজাসাপ্টা কথা বলতেন, প্রচুর পরিমাণ ড্রিংকস করতেন। কর্নেল সাহেবকে এক দিন জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা ভাইয়ে ভাইয়ে কেন মারামারি হানাহানি করছ? কি লাভ এটা করে? তার যে উত্তর ছিল তা মোদ্দকথা হলো 'ক্ষমতার জন্য'। যারা ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে তাদের কাছে দেশের মানুষ, দেশের অর্থনীতি, এমনকি পুরো দেশটার কি হলো, না হলো, তাতে কিছুই আসে যায় না। ক্ষমতার লোভ খুব খারাপ জিনিস। তাকে আরও জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন আজ জাতিসংঘ মিশনে আসতে হলো রুয়ান্ডার গৃহবিবাদ মেটানোর জন্য! ঘরের বিবাদ মেটানোর জন্য পরের দেশের মোড়লদের ডেকে আনার কি দরকার ছিল? তারা কি নিজেরা পারত না কিছু ছাড় দিয়ে নিজেরা মিলে, নিজেদের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে, একটা মীমাংসায় উপনীত হতে?

তার উত্তর ছিল, না; আমরা তা পারছি না, তুমি বলতে পার আসলে আমরা ইচ্ছে করেই তা করছি না এবং করব না। কারণ আমরা উভয় পক্ষই মনে করছি, আমিই বেশি বুঝি এবং আমিই জিতব। কোনো পক্ষই হারতে চাই না। আমরা একটা 'ইগোর' নেশায় বুঁদ হয়ে আছি। এই যে, তোমরা আজ এখানে এসেছ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, তোমরাও পারবে না। কারণ আমরা তোমাদের সব কথা শুধু শুনব, তোমাদের সব সিদ্ধান্তই মানব, তবে আসল বেলায় আমার পুরনো সিদ্ধান্তেই আমি অটুট থাকব।

আমি তখন সব কিছু ভুলে হঠাৎ করে একটা ক্যাবলা হাসি দিয়ে খাঁটি বাংলায় বললাম, 'মানে তাল গাছটা কিন্তু আমার'। কর্নেল সাহেব আমার ভাষা বুঝতে না পেরে আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। তখন আমি তাকে এই বহুল প্রচলিত বাংলা প্রবাদ বাক্যটি ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলাম। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, 'ইয়েস, দি পাম ট্রি ইজ অলওয়েজ বিলংস টু মি'।

এভাবে কিছুক্ষণ পরে স্বগত ভাষায় আবারও উনি যা বললেন, তার সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে, 'কিন্তু তাল গাছটির উপর তো বজ্রপাত হতে যাচ্ছে।'

আর আপনারা সবাই তো জানেন, যে তাল গাছটির দাবি কোনোক্রমেই আপনারা ছাড়ছেন না, আপনাদের একগুঁয়েমির কারণে যদি তাল গাছটির ওপর বজ্রপাত হয় তা হলে কি দশা হবে; সব কিছুই তো তালগোল পাকিয়ে যাবে। লাভবান হবে কে? কীভাবে? কোন ভাবে?

এর কিছুদিন পর রুয়ান্ডাতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। আমরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাই। আর রুয়ান্ডা নামক দেশটি, রুয়ান্ডার জনগণ, রুয়ান্ডা সম্পদ, অর্থনীতি, তার যে কি হলো তা ১৭ দিন গৃহযুদ্ধের মাঝে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। বাকিটা একটা কলঙ্কিত ইতিহাস, প্রয়োজন হলে সে ইতিহাসও এক দিন আপনাদের শোনাবো। কিন্তু আশা করি, সেই গল্প যেন আপনাদের না শোনাতে হয়।

সর্বশেষ খবর