বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ যেন লঙ্কাপুরী না হয়

ড. মোয়াজ্জেম হোসেন মাতুব্বর আমিনুল

রামায়ণে বলা হয়েছে, 'যদ্ যদ্‌চরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ'- মহান ব্যক্তিরা যে আদর্শ স্থাপন করেন, সাধারণ মানুষ তা অনুসরণ করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবে দেশবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। তিনি বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে তিনি এক চুলও নড়বেন না। মনে করা হচ্ছে- সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ও গ্রহণীয় নির্বাচন প্রশ্নে সংলাপের দ্বার উন্মোচন করেছেন। যদিও তার ভাষণ নানা প্রশ্নবিদ্ধ। বেগম খালেদা জিয়াও ২১ অক্টোবর হোটেল ওয়েস্টিনে সে সংবাদ সম্মেলনে '৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে উভয় দলের পাঁচজন করে মনোনয়নের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন- তাও সংলাপের ক্ষেত্রে মাইলফলক। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ-নিয়ন্ত্রণ করায় বা বিএনপির প্রস্তাব সরকার অগ্রহণযোগ্য বলায় আন্দোলনের নামে সংঘাতের পথ বেছে নিতে পারত। '৯৬ এর নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, তিনি এ নির্বাচন মানেন না। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও ছিল প্রায় এক ও অভিন্ন। যেহেতু নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি, সেহেতু উপদেষ্টারা কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নন, যা সহজেই অনুমেয়। এ ছাড়া দুই মেয়াদের উপদেষ্টাদের ২০ জনের অর্ধেকের বেশি প্রয়াত-অসুস্থ, বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। এ ধরনের প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়, কাল্পনিক। তারপরও বলতে হবে, সংলাপের নামে দেশে আজ সুবাতাস বইছে। ইতোমধ্যে মহাসচিব পর্যায়ে কথা হয়েছে, চিঠি দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে ইতোমধ্যে কথা বলেছেন। এগুলো অবশ্যই দেশের স্বার্থে মহান দুই নেতার মহান ভাবনা হিসেবে আপাতত লক্ষণীয়। সংলাপে একটি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারলে দেশের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ হিংসাত্দক-ধ্বংসাত্মক-আক্রমণাত্মক। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়বে বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধির বড় দুটি খাত রেমিট্যান্স ও পোশাকশিল্পে মারাত্দক ধস নামবে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা হবে রীতিমতো ভীতিপ্রদ।

যুদ্ধাপরাধীরা কারাগারে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। তাদের সতীর্থরা-হিতৈষীরা এই সময় দেশের অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা ও মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্টে জানা যায়। ৫ মে হেফাজতের ঘটনার পর পুলিশের মুখপাত্র বলেছেন, ১৩ জন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউমান রাইটসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৫০ জন ও মানবাধিকার সংস্থা 'অধিকার' বলেছে মারা গেছে ৬১ জন। বিএনপি-জামায়াত বলে চলছে নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটির নাম ব্যবহার করে সারা দেশে ১০ লক্ষাধিক পোস্টার ছাপার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জামায়াত। লক্ষ্য, আওয়ামী লীগকে ইসলামবিরোধী হিসেবে দেশবাসীর কাছে প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। দুবাই থেকে প্রকাশিত গালফ নিউজের নিবন্ধে বলা হয়েছে, জামায়াত আর হেফাজত মিলে জোট বেঁধেছে বিএনপির সঙ্গে। অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালীন যে একটা লঙ্কাকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তা প্রায় দেশের ১৬ কোটি মানুষের বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন। এ সরকারের শাসনামলে বিভিন্ন পর্যায়ের ছয় হাজার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ করতে পারেনি বিএনপি। আটটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গোহারা হেরেছে আওয়ামী লীগের নেতারা। জঙ্গিবাদ আর ধর্মান্ধতার দোহাই দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে অর্জিত সুনাম যাতে ম্লান করতে না পারে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াও সম্ভবত এ কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করতে চাইছেন এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলোর দায়িত্ব নিতে পারেন বিএনপি মনোনীত সদস্যবর্গ। প্রধান শর্ত সংলাপ। তথ্যপ্রবাহের এই যুগে শেখ হাসিনা প্রকাশ্য দিবালোকে ভোট চুরি করবে আর এ দেশের মানুষ, মিডিয়া ও দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা দাঁড়িয়ে চোখ বুঁজে থাকবে- এমনটা চিন্তা অবান্তর। উদাহরণস্বরূপ, সাভারের রানা প্লাজা ধসের ১৭ দিন পর রেশমাকে জীবিত উদ্ধারের প্রায় দুই মাস পর পুরো ঘটনাকে নাটক বলে প্রতিবেদন ছেপেছে বিদেশি পত্রিকা সানডে মিরর। জানা যায়, জামায়াত নাকি তাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে মোটা অঙ্কের অর্থের মাধ্যমে এই কাজটি করিয়েছে। সব মিডিয়া সাক্ষী থাকায় বিষয়টি নিয়ে সেনাবাহিনী বা সরকারকে বেশি দূরে যেতে হয়নি। এটা যে বাস্তব সত্য, তা ঘটনাকালীন সময়ে পৃথিবীর প্রায় সব ইলেকট্রনিক মিডিয়া সরাসরি প্রচার করেছে।

নভেম্বর-ডিসেম্বরে সারা দেশের স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা। ভর্তি পরীক্ষায় অভিভাবকদের দৌড়-ঝাঁপ ও টাকার অঙ্কের প্রতিযোগিতা। প্রয়োজন প্রশস্ত দীঘির জলের মতো শান্ত পরিবেশ ও অর্থনৈতিক সচলতা। যদি সংলাপে ইতিবাচক সমাধান না হয়ে সংঘাতের দিকে যায়, তবে রামায়ণের লঙ্কাপুরীর ধ্বংসের কথা মনে পড়বে। বীর হনুমানের লেজের আগুনে রাবণরাজ্য লঙ্কাপুরী জ্বলে ছাই হয়ে যায়। শুধু বাকি ছিল বিভীষণের বাড়ি আর সীতাদেবী যেখানটায় বন্দী রয়েছেন। সুতরাং মাননীয় দুই নেতার দায়িত্বশীল সমঝোতা না হলে সংঘাতের অঙ্গারে জ্বলে পুড়বে এ দেশের নিরীহ মানুষ- যা কারও কাম্য নয়। তাই আজ দেশবাসীর ঐকান্তিক প্রত্যাশা সংলাপের মাধ্যমে নীরব পরিবেশ ও গ্রহণীয় নির্বাচন।

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী

ই-মেইল : [email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর