মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

দিল্লি থেকে আকাশপথে রেহানা

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

দিল্লি থেকে আকাশপথে রেহানা

দেশে ভীষণ রাজনৈতিক উত্তেজনা। তার মধ্যে গিয়েছিলাম খাজা বাবার পবিত্র রওজা জিয়ারত এবং দিল্লি সফরে। আগে অনেক কিছুতে রাগঢাক ছিল। এখন কেন যেন সবই ওপেন সিক্রেট। সবার ধারণা, ঢাকা-দিল্লি একটা দলিল হয়েছে মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে, যা কিছু করা দরকার ভারত করবে। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে অনেক বছর ভারতে ছিলাম। আদর-যত্ন, মান-সম্মান, অবহেলা কম-বেশি সবই পেয়েছি। যে কারণে ভালো-মন্দ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছে। ৪-৫ দিন ইল্লি দিল্লি কত জায়গায় হাতিপাতি করলাম কিন্তু সে রকম কোনো দলিল পেলাম না। বুঝলাম মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে ভারতীয় কংগ্রেস এবং কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক রেখেছে। সে সম্পর্ক কখনো বাংলাদেশকে ছাপিয়ে যায়নি। বাংলাদেশের মানুষের তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে ভারত খুব একটা কিছু ভাবে বা করতে চায় কখনো তেমন মনে হয়নি। ভারতপ্রেমীরা যেমন সবক্ষেত্রে ভারতের জুজুর ভয় দেখায়, ঠিক তেমনি ভারতবিদ্বেষীরা সব সময় হক নাহক নিন্দা করে। এর কোনোটারই সার্থকতা নেই। যখন নির্বাচন আসে তখন এসব কথা বাতাসে উড়ে। ভারত বিরাট দেশ, সারা পৃথিবীতে তার প্রভাব, সে প্রভাব নিশ্চয়ই খাটাতে পারে। তাতে যা হওয়ার হবে। এ ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা অংশ ভারতীয় নির্দেশনায় কিছুটা চলে। তাতেও মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ লাভবান হয়। কিন্তু নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলে সেটা অন্য কারও ফেরানো মুশকিল। বহু বছর ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের যে ভোট আওয়ামী লীগের ঘরে ছিল এবার তাতেও অনেকটা টান পড়েছে। হিন্দু ভোট আওয়ামী লীগ একটাও পাবে না তা বলতে চাচ্ছি না। বলতে চাচ্ছি নানা কারণে অনেক হিন্দু ভোট এবার আওয়ামী লীগ পাবে না। অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে খেলা হয়েছে, যেভাবে হিন্দু সম্প্রদায় বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। সাময়িক উত্তেজনা ছড়াতে কৌশলে আওয়ামী লীগের লোকেরাই যেভাবে মন্দির ভাঙছে এসব কারণে হিন্দুরাও বীতশ্রদ্ধ। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে নেতা-কর্মীরা বিত্তের সংস্পর্শে মফস্বল ছেড়ে উন্নত জীবনের আশায় শহরে এসেছে। গ্রাম-গঞ্জের অজোপাড়াগাঁয়ের সাধারণ হিন্দু পরিবার এতদিন যারা আগলে রাখত তারা নেই। যারা আছে তারা আগলে রাখছে। স্বাভাবিক কারণেই তাদের অনেকেই এখন যাদের কাছে ছায়া পায় তাদের সঙ্গে থাকবে।

কৌশল করে অনেক কিছুই করা যায়, কিন্তু সব কিছু করা যায় না। বাস্তবতা বড় কঠিন। বাস্তবতা পাশ কাটিয়ে কত আর চলা যায়। স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষ আশা করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি সম্মান দিয়ে পাঁচ বছর অন্তর অন্তর একটা বিশ্বাসযোগ্য অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে তারা রাষ্ট্র চালাবে- এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু না, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ একটা নির্বাচনের পথ যতভাবে বন্ধ করা যায় তার বিরামহীন চেষ্টা চলেছে। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যের, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, রাজনৈতিক নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এক দল আরেক দলকে, এক নেতা আরেক নেতাকে বিশ্বাস করে না, স্বাভাবিক মর্যাদাও দেয় না। যে কারণে জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের বিজয়ের মধ্যদিয়ে সংবিধানে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্থান করে নিয়েছিল। কিন্তু মহাজোট ক্ষমতায় এসে তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনের কথা বলে চলছে। অথচ কেউ তাকে বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। সবার দাবি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, তিনি করলেন সর্বদলীয় সরকার। নামে সর্বদলীয় সরকার হলেও সেটি কোনো সর্বদলীয় রূপ পায়নি। সংবিধানে সর্বদলীয় সরকারের কোনো বিধান নেই। কিন্তু তারপরও সর্বদলীয় সরকার নাম দিয়ে আগে জাতীয় পার্টির ছিল একজন, এখন যুক্ত করেছেন আরও ৫ জন। প্রবীণ নেতা আমীর হোসেন আমু যাকে এতকাল চরম অবহেলা করা হয়েছে তাকে ৪০-৫০ দিনের সরকারে বহাল করে জ্বালার বোঝা আরও বাড়ানো হয়েছে। জনাব তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেননকে কিছু দিন আগে মন্ত্রিসভায় আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। তারা দুজনই তা অস্বীকার করে বেশ আলোচনায় এসেছিলেন। তারা দুজনই শেষবেলায় মন্ত্রিসভায় গিয়ে সমালোচনার স্বীকার হয়েছেন। এ এক মজার সর্বদলীয় সরকার, যারা আগে ছিলেন মহাজোটে তারাই এখন সর্বদলে, একজনও বাইরের নেই। কতটা অনুভূতি ভোঁতা হলে এসব করেও লোকজন বাহবা কুড়াতে পারে? চেষ্টা করা হচ্ছে যাদের নবম সংসদে আসন আছে তারা সবাই মন্ত্রী হবে আর যেসব নিবন্ধিত দলের আসন নেই তারা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হবে। এখন মনে হয় সব মিলিয়ে ৪০-৪২টা নিবন্ধিত দল। মন্ত্রী এবং উপদেষ্টা মিলে শতাধিক তো হবেই। গরিবের রক্ত পানি করা পয়সা ধ্বংসে বাধা দেবে কে? আমাদের দেশে কোনো অন্যায় কাজে বাধা দেওয়ার এখন কেউ নেই। সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। গত দুই সপ্তাহ আমাকে উপদেষ্টা বানাতে টানাটানি হয়েছে। আমি নিজেও অবাক হয়েছি, ওই প্রচেষ্টা কেন? আমার উপদেষ্টা হওয়ার কি যোগ্যতা আছে? জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হয়েছেন। তিনি হতেই পারেন। পদ-পদবি পাওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন করেন, আমি করি না। তাই তিনি হতে পারেন, আমি পারি না। ওয়ান-ইলেভেনের সময় আর রাজনীতি করবেন না বলে মুচলেকা দিয়েছিলেন, আমি দেইনি। হ্যাঁ, স্বাভাবিক সময় হলে না হয় বিবেচনা করে দেখা যেত, কিন্তু এ তো নির্বাচনের সময়। বিএনপি এলে নির্বাচনে যাব, না এলে যাব না- আমি তেমন ভাবি না। আমি সব সময় নির্বাচনে যেতে চাই, শুধু নির্বাচন করার মতো পরিবেশ থাকলেই হলো। আমার আপত্তি আমি পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না। জনাব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভাগ্যবান। তিনি গোড়াও কাটেন, মাথাও খান। এতদিন মহাজোটে ছিলেন, এখন মহাজোট ছেড়ে মহাজটের সর্বদলীয় সরকারে যুক্ত হয়েছেন। শোনা যাচ্ছে-আওয়ামী লীগের নৌকা, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের লাঙল নিয়ে নির্বাচন হবে। চিন্তা করতে দোষ কি? চিন্তা আর বাস্তব তো এক নয়। দেশের জনগণ কি অতই দুর্বল? আওয়ামী লীগ ৩০০০ মনোনয়ন বিক্রি করেছিল তার ৯০ শতাংশ বাদ। তালিকাটি গভীরভাবে দেখেছি অনেকেই আছেন যারা কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলেও একাই হারবেন। জাতীয় পার্টির এক সময়ের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যতই ভাবুন তিনি যা খুশি তাই করতে পারেন, কিন্তু তা যে করতে পারেন না তা তো দেখতেই পাচ্ছি।

আসলে দেশের অবস্থা ভালো না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলাম, এখন সমগ্র জাতি দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বিএনপি। এভাবে আরও কিছু দিন চললে আওয়ামী মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ এমনকি কবরস্থান আলাদা হবে। আওয়ামী গোরস্থানে বিএনপির জায়গা হবে না, বিএনপির গোরস্থানে আওয়ামী লাশের দাফন হবে না। আমরা বড়ই শঙ্কিত। যেভাবে দিনের পর দিন হরতাল, অবরোধ চলছে তাতে দেশের অর্থনীতি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। গরিবের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বিরোধী দলকে যেমন এ ব্যাপারে ভেবে দেখা উচিত, সরকারেরও কানে পানি যাওয়া উচিত। সবকিছু মানুষের সহ্যের বাইরে চলে গেলে এক গণবিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবী। তখন কেউ কূল পাবেন না। যে যাই বলুন, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব স্বীকার না করে জামায়াত-শিবির এ দেশে রাজনীতি করতে পারে না। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সঙ্গে আমার দল সব সময় সম্পৃক্ত, কিন্তু অকার্যকর কোনো আন্দোলনকে আমরা সমর্থন করি না। খুব দ্রুত সরকার এবং প্রধান বিরোধী দল দেশে শান্তি স্থাপনে কার্যকরী ব্যবস্থা না নিলে এক সময় তারা চোখে অন্ধকার দেখবেন, পথ খুঁজে পাবেন না। পাতানো নির্বাচনের নকশা করার সময় নয়, এখন দেশকে বাঁচানো, জাতিকে উদ্ধারের সময়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বিজ্ঞ অভিজ্ঞ জাতীয় নেতৃবৃন্দ দেশবাসীর আকুলতা বুঝতে ভুল করবেন না। শুরু করেছিলাম খাজা বাবার পবিত্র রওজা জিয়ারতের কথা দিয়ে। স্বাধীনতার পর থেকেই নিয়মিত আজমীরে যাতায়াত করি। সেখানে খুবই প্রশান্তি পাই। কোনো শুভ কাজে সিলেটের হজরত শাহ জালাল (রা.)-এর দরগা জিয়ারত করি। সবার আগে ছুটে যাই মা-বাবার কবরে- এটা আমার একটা বাতিক। তারই সূত্র ধরে সেদিন দিলি্ল গিয়েছিলাম। আজমীর যাওয়ার আগে অনেক রাতে এই প্রথম ভারতের একজন বাঙালি রাষ্ট্রপতিকে দেখতে গিয়েছিলাম। বীরভূমের কির্ণাহারের সন্তান শ্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বহুদিনের আত্দিক সম্পর্ক। যা অনেক উজান-ভাটির মধ্য দিয়ে অনেকটাই শক্ত পোক্ত হয়েছে। তাকে বহুবার বহু জায়গায় বহুভাবে দেখেছি। এই প্রথম ৩৬০ কক্ষের রাষ্ট্রপতির ভবনে দেখলাম। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন আগেও দেখেছি। '৭২ সালের কোনো একদিন গিয়েছিলাম। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন শ্রী ভি ভি গিরি। এরপর '৭৭-'৮০ এই সময় সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের স্নেহের কারণে ভারতীয় উচ্চ পর্যায়ে ভীষণ গুরুত্ব পেয়েছি। কিন্তু মনে হলো এবার গেছি একেবারে নিজের বাড়ি। আমি যখন মহামান্য রাষ্ট্রপতির ঘরে যাই তিনি তার টেবিলে কাজ করছিলেন। আমাকে দেখেই উঠে জড়িয়ে ধরেন। যে এডিসি ক্যাপ্টেন আমায় নিয়ে গিয়েছিল সে কিছুটা অবাক হয়। তার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল রাষ্ট্রপতিরা বোধহয় খুব একটা কাউকে জড়িয়ে ধরেন না, সে রকম বিধান নেই। এর পর পাশাপাশি সোফায় বসে অনেক আলাপ করেছি। ভালো লাগছিল রাষ্ট্রপতি হয়েও তেমনই আছেন। কোনো পরিবর্তন নেই। সব কথা বলব না, বলা যায়ও না, বলা উচিতও না। দিল্লিতে, রাজস্থানে আরও যেন কোথায় কোথায় নির্বাচন চলছে। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে আম আদমি পার্টি (AAP) নামের এক নতুন দলের সৃষ্টি হয়েছে। যারা এক সময় আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে শরিক ছিল। হঠাৎ জন্ম নেওয়া আম আদমি পার্টি দিল্লিতে সাড়া ফেলে দিয়েছে। কেন্দ্র শাসিত দিলি্লর বিধানসভার ৬০-৬৫ সিটের জনমত জরিপে ১৫-২০টি তাদের পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। শ্রী প্রণব মুখার্জি বিজ্ঞতার ভাণ্ডার। আমাকে তিনি ভালোবাসেন কারণ আমি অনেক ঘটনার সাক্ষী। এক পর্যায়ে উঠি উঠি করছিলাম। তিনিই বললেন, 'তোমার দিদিকে দেখেছ? কথা হয়েছে? কুয়ার ব্যাঙ ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের মতো সাগরে পড়ে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বেল টিপলে প্রথম এসে দিদির কাছে নিয়ে গেল। বাঘা বাঘা বলে তার বিছানায় বসালেন। বসতে বসতেই নাসরীনের কথা, দীপ-কুঁড়ি-কুশির কথা, কত কথা একসঙ্গে বলতে চেষ্টা করলেন। তাদের একমাত্র মেয়ে মুন্নীকে টেলিফোনে ধরে দিলেন। বহুদিন পরে ভারত নাট্যমের এক নামকরা শিল্পী সংগঠক শর্মিষ্ঠা মুখার্জি মুন্নীর সঙ্গে কথা হলো। ফোন ধরেই বলল, 'কাকু, ছোটবেলায় কত কাঁধে নিয়ে ঘুরেছ। ছবিগুলো দেখে বড় ভালো লাগে।' মুন্নীর কথা শুনে আমারও ভালো লাগছিল। অনেক দিন অস্বস্তিকর সময় কাটাতে কাটাতে সব কিছুতেই কেমন যেন একটা বিষাদের ভাব দেখছিলাম। একটু বড় হয়েই অনেকে অতীতের দিনগুলো কেন যেন বেমালুম ভুলে যায়। মুন্নীর মধ্যে, মুন্নীর মা শ্রীমতি শুভ্রা মুখার্জি গীতার মধ্যে এমনকি ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জির মধ্যে অতীত ভোলার কোনো প্রবণতা দেখলাম না। বরং ২৫-৩০ বছর আগে কোথায় কি হয়েছিল সে নিয়ে আলোচনা। এ যেন অতীতে ভর করে ভবিষ্যতে এগুনো।

যাওয়ার পথে দেরিতে বিমানবন্দরে পৌঁছেছিলাম। সেজন্য দিল্লিতে সে ঝকমারি পোহাতে চাইনি। তাই একটু আগেই ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রওনা হয়েছিলাম। আগে পালামে ছিল দিলি্লর বিমানবন্দর, এখন গোরগাওয়ে বিশাল ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এদিক থেকে ওদিক প্রায় ২-৩ কিলোমিটার লম্বা। বোর্ডিং ব্রিজ যে কতগুলো হিসাব করতে পারিনি। বিমানে উঠতে একদিক থেকে আরেকদিকে হেঁটে যেতে প্রায় আধ ঘণ্টার বেশি লাগে। কম করে ৩০-৩৫টি গেট তো হবেই। গিয়েছিলাম জেট এয়ারে 9W 271-এ, ফিরতি ফ্লাইট ছিল 9W 272। ১৫-২০ মিনিট আগে বিমানে বসেছিলাম। বেশ জুতজাত হয়ে স্বস্তি করেই বসেছিলাম। শতেক সোয়া'শ বাঙালি প্যাসেঞ্জার ছিল। যে কারণে যাত্রীদের জন্য দারুণ সুন্দর বাংলায় ঘোষণাও শুনেছি। চুপচাপ বসেছিলাম। কোনো কাজ ছিল না, জানালা দিয়ে কড়কড়ে রোদ দেখছিলাম। হঠাৎ সামনের এঙ্িিকউটিভ ক্লাসে এক ঝলক রেহানার মতো কাকে যেন দেখলাম। পরে বুঝলাম সত্যিই রেহানা। ফরিদকে বললাম, রেহানা না? সে কি দিল্লি এসেছিল নাকি লন্ডন থেকে দেশে ফিরছে? কত আর হবে ৩-৪ মিনিটের মধ্যে হঠাৎ মাথার কাছে 'মামা কেমন আছ? মা বলল মামার কাছে যা। দেখ তোকে চিনতে পারে কিনা?' ববির হাত চেপে ধরে গালে লাগিয়ে ছিলাম, চুমু খেয়েছিলাম। স্নেহে বাচ্চাদের অমন করতে আমার খুবই ভালো লাগে। বাড়িতে থাকলে দিনে কম করে ৫০ বার কুশিমনির হাত কপালে ঠেকাই, চুমু খাই। তাতে বড় আনন্দ পাই। অনেক কথা হলো। মনে হলো, ববি যেন আমারই কেউ। বলল, 'মা আসবেন কথা বলতে।' ববি আর ২-৪ মিনিট দেরি করলে সৌজন্যের খাতিরেই কুশল জানতে রেহানার কাছে আমি যেতাম। ববি আসায় রেহানার খবর নেওয়া দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। গিয়েছিলাম রেহেনার কাছে। যেতে যেতেই নাতি কোলে দিয়ে বলল, 'ভাই, দেখেন তো ববি অতটুকু ছিল কিনা?' আসলে লন্ডনে ববির যেদিন জন্ম হয়, জন্মের বার্তাসহ ওরা স্বামী-স্ত্রী কার্ড পাঠিয়ে ছিল। যা এখনো আমার কাছে আছে। নাতি কোলে নিয়ে ভালো করে লক্ষ্য করলাম ববিও অমনটাই ছিল। মনে হচ্ছিল ববি অনেকটা উত্তেজিত, উৎফুল্ল। বলেছিল, 'মামা তোমার কোলে আমার অনেক ছবি আছে। কাঁধে নিয়ে ঘুরছো, আমি খেলা করছি। ছবিগুলো খুব যত্ন করে রেখেছি।' অবাক হয়ে বললাম, কি বলিস? এত বড় হয়ে মামার কথা মনে পড়ে? ববি বড় দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, 'সব সময় মনে পড়ে। তোমার ছবি দেখলে ভালো লাগে।' ববির কথায় অভিভূত হয়েছিলাম। রেহানাকে ববির চেয়েও আন্তরিক, স্বতঃস্ফূর্ত মায়ের পেটের বোনের মতো মনে হয়েছিল। বলছিল, 'জানেন আপনার সব চিঠি আমার কাছে আছে। শুশুমা, শাহানার চিঠিগুলো যত্ন করে রেখেছি। যত কিছুই হোক আপনার জায়গা আমাদের বুকের মধ্যে।' কেন জানি বারবার মনে হচ্ছিল রেহানার কথায় কোনো ছলনা, কোনো প্রবঞ্চনা ছিল না। দুপুরের যাত্রা, তাই সবাই ক্ষুধার্ত। খাওয়া শেষে হঠাৎ রেহানা এসে হাজির। রেহানা বসেছিল এক্সিকিউটিভ ক্লাসের একেবারে প্রথম সারিতে, আমি ছিলাম ইকোনমিক ক্লাসের ৬-৭ সারি পেছনে। তাতে দূরত্ব ছিল ২০-২৫ ফিট। রেহানা যখন আসে আমি তখন আনমনে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। রেহানাকে দেখে ফরিদ তড়াক করে দাঁড়িয়ে যায়, তখনই বুঝতে পারি রেহানা এসেছে। আমি ডানে, ফরিদ বামে মাঝের সিট খালি। রেহানা বসে অনেক কথা বলছিল। তার কথাতে আন্তরিকতা ছিল। কোনো ঔদ্ধত্য ছিল না, কোনো কপটতা ছিল না। ছেলে, নাতি-নাতকুর, ছেলের বউ অল্প সময়ে অনেক কথা। কীভাবে আমিও যেন বলেছিলাম, আপদে-বিপদে লাঞ্ছনা-গঞ্জনায় আল্লাহর দয়ায় ভালোই আছি। কিন্তু ছেলেমেয়ে দুটোর বিয়ে হলে ভালো লাগত, শান্তি পেতাম। আজ ১৩ বছর বাবা নেই, মা নেই সেও ৮ বছর। বড় ভাই আওয়ামী লীগ করে, ছোটরা যার যার নিজের মতো। তাই উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়ার তেমন কেউ নেই। কেমন যেন একেবারে মায়ের মতো রেহানা বলে বসল, 'ভাই, চিন্তা করবেন না। সন্তান আল্লাহর ধন। আল্লাহর জিনিস আল্লাহই দেখবেন। এক সময় দেখবেন বিয়েশাদি ঠিক মতোই হয়ে গেছে।' রেহানার কথায় এক নির্মল প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম। বিমান যাত্রা খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। পৌনে দুই ঘণ্টার পথ ৭-৮ মিনিট আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। বিমান বোর্ডিং ব্রিজে না দাঁড়িয়ে খোলা মাঠে দাঁড় করেছিল। নেমে দেখি রেহানা দাঁড়িয়ে। বলল, 'ভাই এদিকে আসেন। একসঙ্গে বেরুই।' ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে সরাসরি নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলী গণহত্যা দিবসের স্মরণসভার পথে কয়েক পা এগুতে রেহানা বলেছিল, 'ভাই, দোয়া করে গেলেন না।' কয়েক পা ঘুরে ওর মাথায় হাত রেখে এসেছিলাম। মনে হচ্ছিল আমারই কোনো বোন রহিমা, শুশুমা, শাহানাদের কেউ উদগ্রীব আকুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লেখক : রাজনীতিক।

 

 

সর্বশেষ খবর