শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা
স্মরণ

স্মৃতিতে ভাস্বর : বিচারপতি মোরশেদ

বেগম সুফিয়া কামাল

স্মৃতিতে ভাস্বর : বিচারপতি মোরশেদ

নির্ভীক, ন্যায়নিষ্ঠ, দৃঢ়চেতা একজন বিচারপতিরও ছেলেবেলা ছিল। সেই ছেলেবেলা, তার কৈশোর জীবনের মধুর স্মৃতিটুকু আমার মনের গভীরে উজ্জ্বল হয়ে আছে। জাস্টিস সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ভাগ্নে। এই পরিবারটির সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটি অচ্ছেদ্য বন্ধন ছিল। মাহবুব মোরশেদ ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে মামা বাড়ি বরিশালে বেড়াতে গেলে সেখানে আমাদের সঙ্গে প্রথম দেখা। সেই যে আপা ডেকে আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু হলো। প্রাণ-চঞ্চল দুরন্ত হাসিমুখের একটি কিশোর বাড়ির সবাইকে হাসি-খুশিতে আনন্দ দান করত। তার দুরন্তপনা ছিল গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ার, ঝাঁপিয়ে পড়ে গোসল করার, লাগামহীন ঘোড়ায় চড়ে বরিশালের পথে পথে ছোটাছুটি করার। পোষা কুকুর, বিড়াল নিয়েও আমরা অনেক দিন খেলা করেছি। সেই প্রাণ-চঞ্চল কিশোরটি উত্তরকালে মাননীয় বিচারপতিরূপে আসীন হয়েও আগের মধুর সম্পর্কটি ভোলেননি। নবাব আগা বাকেরের বংশধর এরা, শিক্ষা, তাহজীবে, আদব, তমিজে চিরকাল মানুষের সম্মান অর্জন করেছে। সেই কালে তার পিতা সৈয়দ আবদুস সালেক সাহেব নারী শিক্ষা ও নারী প্রগতির পক্ষপাতী ছিলেন এবং তার বড় ভাই মনজুর মোরশেদ বিচারপতি হয়ে সত্য সত্যিই এই মানুষটি ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে সোচ্চার কণ্ঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। দেশের সংকটকালে ন্যায়ের ভূমিকা পালন করে ধন্যবাদাহ হয়েছেন। তার অন্তরে ছিল একটি কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীর চরিত্র। যেখানে শিল্প-সাহিত্য-কাব্যের আলোচনা হয়েছে সেখানে মাহবুব মোরশেদ মধুর ভাষণ দিয়ে জনগণকে মুগ্ধ করেছেন।

তার অসুস্থকালে যখন তাকে একবার নার্সিং হোমে দেখতে গেলাম, তখনো তিনি ফার্সিতে কবিতা আউড়িয়ে আমাকে বলেন : আপা ভালো হয়ে উঠে আবার মোশায়রার আয়োজন করব। সুশিক্ষিত সাহিত্যরসিক এ মানুষটি আমার মনে মমতায় অমর হয়ে আছেন। ঢাকায় নানা অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমাকে ডেকে নিয়ে গেছেন, অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে আমাকে বড় বোনের আসন দান করেছেন। তার সুযোগ্য সহধর্মিণী লায়লা মাহবুব অনেক মহিলাদের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, যেখানে যোগ দিয়েছেন সেখানেও তাদের আদব, তমিজ, আপ্যায়ন আমি লাভ করেছি। আজ যে মাহবুব মোরশেদ সেই এ কথাটি আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় কখনো এসে আপা বলে ডাক দিয়ে হাসিমুখে সামনে দাঁড়াবে। দেশব্যাপী বিচারের নামে বর্তমানে যে প্রহসন চলছে তার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াবে- কিন্তু সে স্বপ্ন আর সফল হয় না। আজ বিচারের নামে, সংস্কৃতির নামে, সমাজকল্যাণের নামে যেসব ঘটনা ঘটছে- এই একটি মানুষই তার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াতে পারত। আমাদের পরম দুর্ভাগ্য জাস্টিস মাহবুব মোরশেদ আজ আমাদের মাঝে নেই। আমি সুগভীর মমতায় তাকে স্মরণ করি, আল্লাহ তার রুহের মাগফিরাত কামনা করুক, অবিস্মরণীয় সেই মানুষটি আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে থাকুক।

[কবি বেগম সুফিয়া কামালের রচনাবলী থেকে সংগৃহীত]

 

 

সর্বশেষ খবর