সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

\\\'ভূরাজনৈতিক কেন্দ্রিকতা\\\' : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী

\\\'ভূরাজনৈতিক কেন্দ্রিকতা\\\' : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান পৃথিবীর এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। ভূরাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের এই ভূখণ্ডের 'কেন্দ্রিকতা' বা ‘Nodality’-কে আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান 'প্রাকৃতিক সম্পদ' হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যার সঠিক উপলব্ধি এবং তদনুযায়ী প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কৌশল আমাদের ভৌগোলিক আয়তনের ক্ষুদ্রতা পুষিয়ে দিতে পারে।

আমাদের নীতিনির্ধারক মহলে এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির যথাযথ উপলব্ধি খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। বাংলাদেশকে পরাশক্তির অনুগ্রহ বা ছত্রছায়ায় স্থাপন এবং তদনুযায়ী অাঁক কষার প্রবণতাই সর্বত্র দৃশ্যমান। বিশেষ করে উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ক্রমেই যেন একটি পরনির্ভরশীল ক্ষুদ্র জনপদের প্রান্তিক অবস্থানে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। আমাদের জাতীয় রাজনীতি যেন সেই অবস্থানকে মেনে নিয়েই আবর্তিত হচ্ছে।

এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হলে আমাদের প্রতিক্রিয়ার (Reactive) মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে ইতিক্রিয়ার (pro-active) মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আরও বলিষ্ঠ ও কার্যকর ভূমিকা পালনে দৃঢ়চিত্ত হতে হবে।

২. জনবসতির সুসংবদ্ধতা

আয়তনে ছোট হলেও জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ পৃথিবীর ১০ শীর্ষ দেশের একটি। বর্তমান সময়ে আমাদের জনসংখ্যার এই আধিক্য যে অভিশাপ নয় আশীর্বাদ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অপরদিকে জনবসতির সুসংবদ্ধতার মাপকাঠিতেও বাংলাদেশ অনন্য। এই সুসংবদ্ধতা ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় অবদান রাখতে পারে। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ একটি 'একক বাজার'। পৃথিবীতে এত বেশি মানুষের একক বাজার আর একটিও নেই। আমাদের রাজধানী ঢাকা দেশের কেন্দ্রস্থলে এমনভাবে অবস্থিত যে, এখান থেকে দেশের সীমান্ত এলাকার গড় দূরত্ব ২০০ মাইলের মতো। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘণ্টায় ২০০ মাইলের অধিক গতিতে ট্রেন চলছে। চীন তার ১০ হাজার মাইল রেলপথে এই গতির ট্রেন চালু করে সে দেশের এক প্রান্তকে অপর প্রান্তের সঙ্গে যুক্ত করেছে। আগামী পৃথিবীতে রেলপথই যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলে মাত্র এক ঘণ্টায় ঢাকা থেকে আমাদের যে কোনো সীমান্তে পৌঁছা যাবে।

পাশাপাশি এই সুসংবদ্ধ বিশাল বাজারটিকে চারপাশের অপরাপর অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করে 'বাজারজাত' করাটাও জরুরি।

৩. ‘Heartland' ধারণা : ভূখণ্ডের কেন্দ্রিকতা

ভূরাজনীতির জনক হিসেবে পরিচিত হ্যালফোর্ড ম্যাকিন্ডার (Sir Halford Mackinder, 1861-1947)  ভৌগোলিক অবস্থান, যোগাযোগের কেন্দ্রিকতা এবং প্রাকৃতিক সুরক্ষা বিচারে ইউরেশিয়ার কেন্দ্রীয় অঞ্চলকে (পূর্ব ইউরোপ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়া) পৃথিবীর Heartland বা 'কেন্দ্রীয় ভূখণ্ড' নামে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিসরে সে রকম অবস্থানে চিন্তা করা না গেলেও পৃথিবীর তিনটি বৃহৎ মহাজনপদের 'ত্রয়ী সংগমস্থল' (Tri-junction) হিসেবে তার অবস্থানগত কেন্দ্রিকতা মানচিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। আমাদের পশ্চিমে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশ, অপরদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, উত্তরে অদূরে চীন। পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি এই তিন এলাকায় গাদাগাদি করে বাস করে। আবার আমাদের ঠিক দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর- ভারত মহাসাগর পর্যন্ত প্রসারিত। বঙ্গোপসাগরের 'শীর্ষদেশ' (Apex country) হওয়ার অবস্থানগত সুবিধার কারণে এই জলরাশির ওপর কর্তৃত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ছেদ না করে বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করা সম্ভব নয়। অপরদিকে শীর্ষ দেশ হিসেবে এই উপসাগরের উভয় উপকূলে সরলরেখায় চলাচল করার সুযোগ একমাত্র বাংলাদেশেরই আছে। যে কারণে স্মরণাতীত কাল থেকে বাংলার সওদাগর তার নৌবহর নিয়ে একদিকে সিংহল, অন্যদিকে মালাক্কা প্রণালি অতিক্রম করে দূরপ্রাচ্যে যাতায়াত করেছে। বাংলার বৌদ্ধ যুগে এই দুই পথ ধরেই বৌদ্ধধর্ম একদিকে শ্রীলঙ্কা, অপরদিকে সুদূর ভিয়েতনামের উপকূল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে।

তবে ভূখণ্ডের ভৌগোলিক অবস্থানগত কেন্দ্রিকতা থাকলেও যথাযথ 'পরিচর্যা' ছাড়া তা কার্যকর থাকে না। বিশেষ করে আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ছাড়া তার পরিপূর্ণ সুফল ভোগ করা যায় না। এক্ষেত্রে বর্তমান যুগে স্থল, নৌ ও আকাশপথ- তিন মাধ্যমেই যোগাযোগ ব্যবস্থার যে বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে তার সুফল কাজে লাগানো যেতে পারে।

৪. ভূরাজনীতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য

আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রসমূহ মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ কর্তৃত্বে আসীন। সে কারণে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এখন কেবল পণ্য চলাচল বা অর্থনৈতিক লেনদেনে সীমাবদ্ধ নয়। বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক- সর্বক্ষেত্রেই প্রসারিত। এসব ক্ষেত্রে পারস্পরিক আদান-প্রদানের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সাযুজ্যের পরিমাপক। অর্থাৎ আধুনিক ভূরাজনৈতিক তৎপরতায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পৃক্ততা নিবিড়তর করার বিষয়টিকেও বিবেচনায় রাখা আবশ্যক।

একই কারণে ভূরাজনীতিতে ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে মানুষের গাত্রবর্ণ, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, কিংবা জনজীবনে সামাজিক-পারিবারিক সম্পর্কের ধরন, লোকাচার, রূপকথা-উপকথা, ইত্যাকার বিবিধ ক্ষেত্রে চমকপ্রদ সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। যা সুদূর অতীতকাল থেকে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও আদান-প্রদানের সাক্ষ্য বহন করে। বাঙালি রাজপুত্র (নাকি সওদাগরপুত্র?) বিজয়সিংহের 'লঙ্কা বিজয়'-এর কাহিনী শ্রীলঙ্কাতেও প্রচলিত আছে। বছর দশেক আগে সার্ক সম্মেলনে ঢাকায় এসে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি নিজেই তার উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে ভাষা গবেষক অধ্যাপক লুৎফর রহমান বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার ভাষায় তিন হাজারের বেশি শব্দ শনাক্ত করেছেন যাদের সাদৃশ্য সুস্পষ্ট।

এসব বিষয়ের সম্যক উপলব্ধি ছাড়া জাতীয় রাজনীতি বা উন্নয়নের কোনো মডেল তৈরি করা নিরর্থক। চারপাশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং জনবসতির ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে পরিপূর্ণরূপে অবহিত থেকে তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আদান-প্রদানের কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা জাতি-রাষ্ট্রের উন্নয়ন ভাবনায় অপরিহার্য পূর্বশর্ত। আমাদের রাষ্ট্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এদিকে দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে পৃথিবীর উন্নত ভাষাগুলো শেখার সুযোগ রয়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বেসরকারি পর্যায়েও বিভিন্ন ভাষা শেখানোর কিছু ব্যবস্থা চোখে পড়ে। কিন্তু আমাদের কাছে প্রতিবেশী অসমীয়া, বার্মিজ, মালয়, থাই, নেপালি ইত্যাদি ভাষা শেখানোর বা চর্চার কোনো উদ্যোগ বা সুযোগ কোথাও আছে বলে জানি না। বাণিজ্যিকভাবে আপাতত লাভজনক মনে না হলেও আঞ্চলিক পরিসরে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এসব প্রতিবেশী ভাষার চর্চা বড় ভূমিকা পালন করবে। যা পরিণামে নানা দিক থেকে 'লাভজনক' হবে।

বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক কেন্দ্রিকতা নিয়ে আমরা উপরে যে আলোচনা করেছি তা একবারেই অর্থহীন যদি আমরা তা কাজে লাগাতে না পারি। বলাবাহুল্য, প্রত্যেক দেশই তার নিজ নিজ পরিমণ্ডলে নিজেকে 'কেন্দ্রীয়' অবস্থানে ভাবতে পারে। যদিও বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় সবার অবস্থান সমপর্যায়ে হবে না। তবে এই কেন্দ্রিকতাকে কাজে লাগাতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে 'কানেকটিভিটি'- চারপাশের পৃথিবীর সঙ্গে সরাসরি এবং দ্রুত যাতায়াতের ব্যবস্থা। আমাদের জাতীয় অর্থনীতি ও জনজীবনের নিরিখে চারপাশের কোন কোন অঞ্চল বা নগরীর সঙ্গে কানেকটিভিটি থাকা প্রয়োজন তা প্রথমেই স্থির হওয়া দরকার। এ কাজটি কেবল আমাদের একতরফা ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করবে না। অন্যান্য দেশের আগ্রহ-অনাগ্রহের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

৫. ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে ও এশিয়ান হাইওয়ে

বাংলাদেশের সঙ্গে এই অঞ্চলের অন্যদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে দুটি সুদূরপ্রসারী বৈপ্লবিক সম্ভাবনাময় উদ্যোগ- 'এশিয়ান হাইওয়ে' এবং 'ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে'।

সমগ্র এশিয়া অঞ্চলের সব দেশের রাজধানীগুলোকে সংযুক্ত করে রাজপথ ও রেলপথের নেটওয়ার্ক তৈরির এক মহাপরিকল্পনায় কাজ শুরু হয়েছে ১৯৫৮ সালের দিকে। জাতিসংঘের এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে 'এসকাপ' (ESCAP- Economic and Social Commission for Asia and the Pacific)-এর তত্ত্বাবধানে। এর কর্মসূচির আওতায় ১১টি হাইওয়ে জালের মতো সমগ্র এশিয়ার সব অঞ্চলকে পরস্পর সংযুক্ত করবে। পাশাপাশি অনুরূপ একটি রেলপথের নেটওয়ার্কও নির্মিত হবে। এই উভয় নেটওয়ার্ক আবার যুক্ত থাকছে ইউরোপীয় রোড ও রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে। অতঃপর যে কেউ এই রাজপথ বা রেলপথে ইচ্ছামতো এশিয়া-ইউরোপের যে কোনো শহর থেকে যে কোনো শহরে সরাসরি যেতে পারবেন। ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথে যদি ভবিষ্যতে দ্রুতগতির ট্রেন চালু হয়, তাহলে ৫ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে দিলি্ল এবং ৮-৯ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চীনের কুনমিং বা ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর যাতায়াত করা সম্ভব হতে পারে। এই মুহূর্তে স্বপ্ন মনে হলেও পৃথিবী সেদিকেই চলছে।

৬. রুট নির্ধারণ প্রশ্নে গাফিলতি

সৌভাগ্যবশত এশিয়ান হাইওয়ের ১১টি রুটের মধ্যে দুটি রুট (AH-1I AH-2) বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের রুটেও বাংলাদেশ যুক্ত থাকছে। তবে এই রাজপথ ও রেলপথের সব কটি রুটই এমনভাবে স্থির করা হয়েছে যাতে করে তাদের প্রত্যেকটি মিয়ানমার থেকে সরাসরি বাংলাদেশে না এসে ঘোরা পথে প্রথমে ভারতের মণিপুর রাজ্যের মোরেহ সীমান্ত শহর দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করে অতঃপর নাগাল্যান্ড, আসাম ও মেঘালয় ঘুরে সেখান থেকে সিলেটের তামাবিল দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকবে। তারপর পশ্চিমবাংলার দিকে চলে যাবে। এর ফলে বাংলাদেশ সরাসরি মিয়ানমার বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবে না। বাংলাদেশকে সেসব অঞ্চলে যেতে হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পর্বতসংকুল এলাকা ঘুরে ৬০০ মাইল বাড়তি পথ অতিক্রম করে মিয়ানমারে ঢুকতে হবে। তারপর সেখান থেকে অন্যান্য দিকে যেতে হবে। তদুপরি দুর্গম ও বিদ্রোহকবলিত পার্বত্য এলাকা হওয়ার কারণে ওই এলাকা দিয়ে যাতায়াত হবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে এই রুট কেবল ভারতের পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার করিডর ছাড়া আর কিছুই হবে না। এটা বাংলাদেশের কোনো কাজেই আসবে না। আমাদের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও ট্রান্সপোর্ট বিশেষজ্ঞরা সেই গরল জাতির গলায় ঢেলে দিয়েছেন।

বিপরীত দিক থেকে দেখলেও চীন বা দক্ষিণ-পশ্চিমের থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর এবং অন্য দেশ থেকে পূর্বদিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের প্রকৃতি নির্ধারিত সংক্ষিপ্ততম রুট হওয়া উচিত মিয়ানমার হয়ে টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশ, অতঃপর ভারত। তখন বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল। টেকনাফ হবে এই রুটে দক্ষিণ এশিয়ার 'এন্ট্রি পোর্ট'। তা না হয়ে ভারতের পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চল ঘুরে আসার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ হয়ে পড়বে এই রুটের মধ্যবর্তী অবস্থানে একটি ট্রানজিট স্টেশন মাত্র। এন্ট্রি পোর্ট হয়ে যাবে মণিপুরের সোরেহ। দুইয়ের পার্থক্য কতটা বিশাল ও সুদূরপ্রসারী আমাদের কর্তাব্যক্তিরা তা হৃদয়ঙ্গম করেছেন বলে এখনো মনে হচ্ছে না।

এভাবে ভূরাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে 'এসকাপ' প্রস্তাবিত ও এখন পর্যন্ত স্থিরকৃত রুট বাংলাদেশকে তার প্রকৃতি নির্ধারিত প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবে। বস্তুত এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে টেকনাফ রুটে নির্মিত না হলে সম্ভবত তা থেকে বিযুক্ত থাকাই বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে। তাহলে বাংলাদেশকে অন্তত অন্য দেশের করিডর হওয়ার চাপ বহন করতে হবে না।

অনেকে বলেন, এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে যেভাবেই আসুক না কেন তা মেনে নেওয়া উচিত। না হলে বাংলাদেশ চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, তথা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এই জুজুর ভয় এখন অমূলক হয়ে পড়েছে। কারণ চীন ইতোমধ্যে টেকনাফের অদূরে মিয়ানমারে বঙ্গোপসাগরের তীরে একটি বিশাল গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। লক্ষ্য, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য সরাসরি বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ। সেই লক্ষ্য নিয়ে কুনমিং থেকে ওই বন্দর পর্যন্ত হাইওয়ে-রেলওয়ে-পাইপলাইন সংযোগ স্থাপনের কাজও পুরোদমে চলছে। যা ২০১৫ সালে শেষ হওয়ার কথা। এই প্রকল্প সমগ্র অঞ্চলের অবকাঠামো আমূল পাল্টে দিচ্ছে। আমাদের জন্য যা বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে। চট্টগ্রাম-টেকনাফ রোডকে মিয়ানমারের ভেতরে অল্প কিছু দূর সম্প্রসারিত করলেই আমরা এই রোড-রেল কমপ্লেঙ্রে সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ পেতে পারি। এরকম একটি সড়ক বাংলাদেশের অর্থায়নে নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।

১৯৮৮ সালে যখন এশিয়ান হাইওয়ের রুট নির্ধারণের বিষয়টি প্রকাশ পায় তখনই এর প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ অবজারভার ও সাপ্তাহিক হলিডেতে লিখেছিলাম। তারপর বিভিন্ন সময় ইত্তেফাক, দেশবাংলা, যুগান্তর, দিনকাল, আমার দেশসহ বিভিন্ন কাগজে। কিন্তু আমাদের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা প্রয়োজন মনে করেননি।

৮. এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি

এই রুট নির্ধারণের ক্ষেত্রে এসকাপের নীতি হচ্ছে যেসব দেশের ওপর দিয়ে রুট যাবে সেসব দেশের সম্মতি থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকারের আমলে বাংলাদেশ আদ্যোপান্ত বিবেচনায় না নিয়ে এসকাপ প্রস্তাবিত তিনটি রুটের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন প্রদান করে।

আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের প্রচণ্ড চাপ ও নিরন্তর কূটনৈতিক তৎপরতার কাছে আত্দসমর্পণ করেছেন আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকরা। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, যে সময় 'এসকাপ' এই রুটের নকশা চূড়ান্ত করেছে তখন ওই সংস্থার প্রধান ছিলেন একজন বাংলাদেশি। আরও দুঃখের বিষয়, তখন যিনি এই নকশা তৈরির দায়িত্বে ছিলেন এবং তার পক্ষে জোর ওকালতি করেছেন তিনিও ছিলেন বাংলাদেশি!

২০০৩ সালের দিকে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এ নিয়ে আপত্তি জানায়। কিন্তু যথাসময়ে আপত্তি না জানানো এবং নকশা চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার কারণে রুট পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রাষ্ট্র (এমনকি মিয়ানমার ও চীন) অনীহা প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে অবশ্য পরিস্থিতির বেশ পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে চীন ও মিয়ানমার এখন টেকনাফ রুটে আগ্রহী হয়েছে।

ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে এবং এশিয়ান হাইওয়ের অন্তত একটি রুট (AH-1) টেকনাফ হয়ে আসুক। এশিয়ান হাইওয়ের আরেকটি রুট (AH-2) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ঘুরে আসুক। আমাদের আপত্তি নেই। বাংলাদেশের তরফ থেকে জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ এখন ফলপ্রসূ হতে পারে।

লেখক : রাজনীতিক, ভূরাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক।

[email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর