শিরোনাম
রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

দ্রুত নতুন নির্বাচনের কথা ভাবুন

কাজী সিরাজ

দ্রুত নতুন নির্বাচনের কথা ভাবুন

প্রশ্নবিদ্ধ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা অব্যাহতই আছে। গণসমর্থিত সব দলের বিশেষ করে 'গৃহপালিত' বিরোধী দল নয়, কার্যকর বিরোধী দলসমূহের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত নজিরবিহীন এবং বিরোধী দলের ভাষায় প্রহসনের ওই নির্বাচনের অপবাদ বইতে হবে বর্তমান লীগ সরকারকে। দেশ-বিদেশের সব গণতন্ত্রপ্রিয় বিবেকবান মানুষ দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে সোচ্চার হচ্ছে। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে বসবাসকারী বাঙালি জনগোষ্ঠীর মাথা হেঁট করে দিয়েছে এই লোক হাসানো নির্বাচন। সর্বত্রই প্রশ্ন উঠেছে, ৩০০ আসনের সংসদে যেখানে ১৫৩ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত (?) হয়ে যায় এবং বাকি ১৪৭ আসনে যেখানে নামকাওয়াস্তে নির্বাচন করিয়ে নেওয়া হয়, সেটা কেমন জাতীয় নির্বাচন? সবাই জানতে চাইছে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে যেখানে লেখা রয়েছে যে, 'একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিতদের নিয়ে (সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্যসহ) সংসদ গঠিত হবে, সেখানে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়, (কোনো নির্বাচন ছাড়া) বিনাভোটে নির্বাচিত ১৫৩ এমপি এবং পুলিশ-র্যাব-বিজিবি পাহারায় ৫ জানুয়ারি ১৪৭ আসনে নামমাত্র ভোটে নির্বাচিতদের নিয়ে গঠিত সংসদের নৈতিক বৈধতা কতটুকু? এই সংসদ নিয়ে লীগ সরকার কোন মুখে বড়াই করছে এবং পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার সদম্ভ ঘোষণা দিচ্ছে? প্রবাসী বাঙালিরা প্রতিনিয়তই বিদেশিদের কাছে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি এবং অপমানিত হচ্ছে।

লীগ সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার এবং শাসক লীগের দায়িত্বশীল (!) নেতারা বলে চলেছেন যে, জনগণ নাকি তাদের পাঁচ বছরের জন্য ম্যান্ডেট দিয়েছে। কিন্তু কোন জনগণ? সরকারি হিসাব অনুযায়ীই তো ৩০০ আসনে সাড়ে ৯ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় আট কোটি ভোটার ভোট দেয়নি, অনেকে সে সুযোগও পায়নি। (১৪৭ আসনে ইসি প্রদত্ত ৪০ ভাগ ভোট হিসাব করলে ৩০০ আসনে মোটামুটি তাই দাঁড়ায়)। সে ক্ষেত্রে তা জনগণের ম্যান্ডেট হয় কী করে? দেশ-বিদেশে সবাই চেয়েছিল দশম সংসদ নির্বাচনটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। এর জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক দলের সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ। কিন্তু তা হয়নি। শাসক লীগ চালাকি করে নির্বাচনটি একতরফা বা একপক্ষীয়ভাবে করিয়ে নিয়েছে। সরকারি পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা হচ্ছে যে, বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করার দায় সরকারের নয়। ছেলে ভোলানো গল্পের মতো বলা হচ্ছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ব্যাপার। সরকার বা নির্বাচন কমিশন কাউকে জোর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে পারে না। ভালো কথা। কিন্তু সরকার কী জোর করে কাউকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দিতে পারে? বিরোধী দল তো বলছে যে, সরকারি অস্ত্রবলে তথা রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতাসীনরা অনেকটা গায়ের জোরেই দশম সংসদ নির্বাচনটা সেরে নিয়েছে। বিরোধী দলের বক্তব্যের পেছনে যুক্তি আছে। দশম সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সূচনা হয় ২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। এর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবলিত সংবিধানের ৫৮ (খ) (গ) (ঘ) ও (ঙ) অনুচ্ছেদ বাতিল করে দেওয়া হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের মূল আপত্তিটাই এখানে। তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। এটা সহজেই বোধগম্য যে, সরকারি দল নিজেদের জয় নিশ্চিত করার ব্যাপারে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনকে নিরাপদ মনে করেনি। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, নিজেদের জয়লাভের একটা নির্বাচন চেয়েছে বলেই তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে মনে হয়েছে। আন্দোলনের প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেনি। শুধু সরকার ব্যবস্থাই নয়, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়েও সরকারবিরোধী দলের সঙ্গে চাতুরী করেছে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি বিএনপিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব দলের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু বিএনপি অভিযোগ করেছে, তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। ই উপলক্ষে একটা সার্চ কমিটিও করা হয়েছিল। কিন্তু 'জনতার মঞ্চের' একজন নায়ককে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে যে কমিশন গঠন করা হয় তাদের অধিকাংশই আওয়ামী পছন্দের লোক বলে অভিযোগ ওঠে। সার্চ কমিটি সার্চ করে বেছে বেছে আওয়ামী পছন্দের লোকদের বাছাই করায় কমিশন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। বিরোধী দলের এতেও ঘোর আপত্তি ছিল। বিরোধীদলীয় নেত্রী (নবম সংসদের) ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এই নির্বাচন কমিশনকে একাধিকবার মেরুদণ্ডহীন বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে সরকারের তৃতীয় কৌশলটি ছিল 'পোড়া মাটি নীতি' গ্রহণ। মামলা-মোকদ্দমা, জেল, জুলুম, গুম-সন্ত্রাস (যাকে বিরোধী দল অভিহিত করেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে) চালিয়ে বিরোধী দলকে হীনবল করা। তা ছাড়া নবম সংসদ বহাল রেখেই করা হয় দশম সংসদ নির্বাচন। সবার জন্য নির্বাচনে 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড' ছিল না। তা ছিল এক অসম যুদ্ধ। বিরোধী দল 'আত্দহত্যা' করতে সম্মত হয়নি। তাই বলা চলে, বিরোধী দল নির্বাচনে আসেনি বলে সরকারি পক্ষ যা প্রচার করছে তা যথার্থ নয়, বরং এটাই বাস্তব যে, বিরোধী দল যাতে নির্বাচনে আসতে না পারে তারই পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করেছিল ক্ষমতাসীন লীগ সরকার। এর মাধ্যমে তারা এটাও প্রমাণ করেছিল যে, ক্ষমতাসীনদের অধীনে বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এখনো অসম্ভব।

সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটাও ছিল অস্বাভাবিক। আগের সংসদ বহাল রেখেই 'নতুন সংসদের' সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা শপথ গ্রহণের পর কয়েকটি দেশ প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানায়। তাতে আত্দবিশ্বাস মনে হয় বেড়ে যায় সরকারের। কারও কারও চেহারায় ফুটে ওঠে উৎফুল্ল ভাব, বিশ্ব বিজয়ের হাসি। জনগণকে বোকা বানানোর জন্য ওই সব অভিনন্দন বাণী ফলাও করে প্রচার করা হয় এবং এমন একটা ধারণা দেওয়া হয় যে, বহির্বিশ্বে দশম সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও নৈতিক বৈধতার সংকট কেটে গেছে। অথচ সবাই প্রধান প্রতিপক্ষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে অতি দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করার ব্যাপারেও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। অভিনন্দনের বিষয়টা একান্তই রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়, সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের নয়- এটা কারও না বোঝার কথা নয়। এ ব্যাপারে সর্বশেষ বোমাটি ফাটিয়েছেন বাংলাদেশস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা। গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, 'আমেরিকা মনে করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটেনি। যুক্তরাষ্ট্র আশা করে, একটি নতুন নির্বাচনের জন্য সংলাপ হবে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলেছেন। এটা একটা ভালো ধারণা। এখন যদি তিনি সংলাপের উদ্যোগ নেন তাহলে সেটাই সবচেয়ে ভালো হয়।' বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে এটাও জানিয়ে দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের সহিংসতাকে সমর্থন করে না। সরকারের উচিত বিরোধী দলকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেওয়া আর বিরোধী দলের উচিত সে সুযোগ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ব্যবহার করা। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ পন্থায় দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচন করার ওপরই জোর দিচ্ছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে মার্কিন সিনেটের শুনানিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল মারাত্দক ত্রুটিপূর্ণ। এতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য নতুন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতাপূর্ণ সংলাপ আয়োজনে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে আরও বেশি চাপ দিতে ওবামা প্রশাসনকে আহ্বান জানান সিনেট। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের দশম সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে একই মনোভাব ইতোমধ্যে ব্যক্ত করেছে। দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে সরকারের উচিত কল্পনার ফানুস না উড়িয়ে বাস্তবের জমিনে পা রাখা। দ্রুত বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে বসে একাদশ সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। তা না হলে দেশের বর্তমান শান্ত পরিস্থিতি হঠাৎই আবার উতলা হয়ে উঠতে পারে। সরকারের মতিগতি কিন্তু ভালো মনে হচ্ছে না। ১২ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে শাসক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জানিয়ে দিয়েছেন ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগে তারা ক্ষমতা ছাড়ছেন না। এটা সম্পূর্ণই দখলদারি মানসিকতা। বিতর্কিত দশম সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর দাঁড়িয়ে এমন সদম্ভ ঘোষণা রুচিহীনও বটে। সৈয়দ আশরাফ সাধারণত আক্রমণাত্দক ও রুচিহীন কথাবার্তা বলেন না। মনে হচ্ছে, এটি তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। দলের মুখপাত্র হিসেবেই তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় পাঁচ বছর দখলদারিত্ব বহাল রাখার ঘোষণাটি দিয়েছেন। আতঙ্কের কারণটা এখানেই। দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে যেখানে এত বিরূপ সমালোচনা, সেই নির্বাচনের ফলাফলকে পুঁজি করে ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে সরকারকে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে হবে। বিরোধী দলও সে ক্ষেত্রে বেশি দিন সরকারকে ছেড়ে কথা বলবে না। সরকার তার জবাবে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবে, এমন প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারিও অনুমান করা যায় তার বক্তব্যে। ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সরকার কারসাজি শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। বিরোধী দল বিএনপি অভিযোগ করছে যে, যৌথ বাহিনীর অভিযানের নামে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এবং তাদের কর্মী-সমর্থকদের হয়রানি করা শুরু হয়েছে। নির্বাচন-পূর্ব আন্দোলনের সময় অনেকের বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা দেওয়া হয়েছিল। একই মামলায় অজ্ঞাত পরিচয় অনেক আসামিও রাখা হয়েছিল। সেই অজ্ঞাত তালিকায় আসামি হিসেবে দাবড়ানো হচ্ছে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল সমর্থিত চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং তাদের জন্য যারা কাজে নেমেছেন তাদের। তারা এখন নির্বাচনী প্রচারণা চালানো দূরের কথা, ঘরবাড়ি, এমনকি এলাকাতেও থাকতে পারছেন না। হয়রানির শিকার প্রার্থীদের একটি তালিকাও বিএনপি গত ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করেছে। বোঝা যাচ্ছে, দশম সংসদের মতো ছলে বলে কৌশলে উপজেলা নির্বাচনেও শাসক লীগ অধিকাংশ আসন দখল করে নিতে চাচ্ছে। প্রমাণ করতে চাচ্ছে দশম সংসদ নির্বাচন যথার্থ এবং তার ঘোষিত ফলাফলও যথার্থ। সরকারের মনে এমন দুরভিসন্ধি আছে বলে সন্দেহটা যদি সত্য হয় তার ফল কিন্তু ভালো হবে না, এটা বলার জন্য দৈবজ্ঞ হওয়ার প্রযোজন নেই।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর