রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

এককেন্দ্রিক আধিপত্যের দিন কি ফুরিয়ে এলো?

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

এককেন্দ্রিক আধিপত্যের দিন কি ফুরিয়ে এলো?

ক্রিমিয়াকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সৃষ্ট সবচেয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির আপাত প্রশমনের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তি বাহ্যিকভাবে মেনে না নিলেও হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব এখন হাঁফ ছেড়ে বেঁচে যায়, যদি রাশিয়া আপাতত আর আগে না বাড়ে। গ্র্যান্ড সামরিক কৌশলের কারণেই ক্রিমিয়া অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়ায় রাশিয়া ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বের দীর্ঘ সীমান্তজুড়ে ব্যাপক হারে সামরিক সমাবেশ ঘটায় মিলিটারি প্রশিক্ষণের নাম করে। ক্রিমিয়ায় যে কোনো দিক থেকে বাধাপ্রাপ্ত হলেই ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বের সীমান্তেও একই সময়ে রুশ সেনাদের সামরিক অভিযান শুরু হতো। তাতে অনেক সহজেই ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ব্যাপক এলাকা রুশ বাহিনীর দখলে চলে আসত, কারণ ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের ৪০ ভাগেরও বেশি রুশ ভাষাভাষী, যারা রুশ বাহিনীকে সব রকমের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। অন্যদিকে কৃষ্ণসাগরের কোলে অবস্থিত ক্রিমিয়ার সেবাস্তোপল বন্দরে রাশিয়ার সর্ববৃহৎ নৌ-ঘাঁটি অবস্থিত সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের শুরু থেকে। ২৫ হাজার রুশ সেনাসদস্য সেখানে সব সময় অবস্থান করে। তা ছাড়া ক্রিমিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর ওডেসায় রাশিয়ার নৌ-বাহিনীর উপস্থিতি আছে। ক্রিমিয়ার দক্ষিণে আজভ সাগরেও রাশিয়ার বড় নৌ-ফ্লিট থাকে, যারা কার্চ প্রণালী দিয়ে দ্রুত ও স্বল্প সময়ে কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ করে সেবাস্তোপলে অবস্থিত নৌ-ঘাঁটির শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। যার ফলে ইউক্রেন রুশ বাহিনীকে ক্রিমিয়ায় বাধা দিলে তেমন কোনো ফল তো হতোই না, বরং দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের বৃহদাংশ ইউক্রেনের হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাব ও একঘরে করার হুমকি দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। এই যে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব শুধু মুখে মুখে হুমকি-ধমকি দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে বসে সব হজম করল তারও অনেক কারণ আছে। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে কেন এ রকম একরোখা ছিলেন তার পেছনেও বহুবিধ কারণ আছে। অনেক কারণের মধ্যে একটি সম্ভাব্য কারণ হলো, পশ্চিমা দেশগুলোকে পুতিন বোঝাতে চেয়েছে পৃথিবীর নেতৃত্বে আমেরিকা আগামীতে এককভাবে আর কিছু করতে পারবে না। এখন থেকে মস্কোকেও হিসাবে রাখতে হবে। ক্রিমিয়াকেন্দ্রিক ইউক্রেনের বর্তমান সংকটটি শুরু হয় ২০১৩ সালের শেষদিকে, যখন রুশপন্থি প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়াকুনোভিসের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদীরা প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনের অজুহাত ছিল ইয়াকুনোভিস ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাবিত একটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে এবং তার বদলে রাশিয়া থেকে সাহায্য গ্রহণে আগ্রহী হয়। কিন্তু ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদীদের দাবি ছিল রাশিয়ার পরিবর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি করতে হবে। আন্দোলনের তীব্রতায় প্রেসিডেন্ট ইয়াকুনোভিস ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতা দখল করেই সরাসরি পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এটা যে পূর্ব ইউরোপের ওপর থেকে রাশিয়ার প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশলেরই অংশ তা রাশিয়ার বুঝতে সময় লাগে না। প্রেসিডেন্ট পুতিন দ্রুতগতিতে রাশিয়ার জন্য স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করে ফেলেন এবং ইউক্রেনের সব সীমান্তে ব্যাপক সামরিক সমাবেশ ঘটান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু হাঁকডাক দিয়ে আপাতত থেমে যেতে বাধ্য হয়। এ ঘটনার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পুতিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বকে যে বার্তা দিলেন তা হলো, রাশিয়া তার হারানো পরাশক্তির মর্যাদা পুনরায় ফিরিয়ে আনার কৌশল ও অভিযান অব্যাহত রাখবে। দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত পর পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট ব্লকের দেশগুলোকে ন্যাটো সামরিক বলয়ের আওতায় নিয়ে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের দ্বারপ্রান্তে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রের আখড়া নির্মাণ করেছে, তাকে আর এগুতে দেওয়া হবে না। যার জন্য দেখা যাচ্ছে ইউক্রেনের পরিস্থিতিকে স্বাভাবিকীকরণে আমেরিকার সঙ্গে আলোচনায় রাশিয়া শর্ত জুড়ে দিয়েছে। প্রথমত, ইউক্রেনে ফেডারেল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে, যাতে রুশভাষী দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের মানুষের স্বার্থ ও অধিকার নিশ্চিত হয়। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে ইউক্রেনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হতে পারবে না। ক্রিমিয়াকে রাশিয়া যে অজুহাতে ও কৌশলে একীভূত করে নিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল প্রায় একই রকম একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তির আওতায় রাশিয়া ও জার্মানি থেকে কিছু ভূখণ্ড কেটে নিয়ে এবং তারপর সেগুলোকে আবার একত্রিত করে পোলিশ ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর জন্য পোল্যান্ড রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয় এবং জার্মানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাল্টিক সাগরের কোলে অবস্থিত ডানজিগ বন্দর পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়, যদিও ডানজিগের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল জার্মান। ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পর ডানজিগের আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনে ন্যাশনালিস্ট পার্টি ৭২ আসনের মধ্যে ৩৮ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জার্মানির সঙ্গে পুনরায় একীভূত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। হিটলার পোল্যান্ডের কাছে দাবি জানায় ডানজিগ বন্দরকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। পোল্যান্ড তা অস্বীকার করলে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে প্রথমেই ডানজিগ দখল করে নেয়। ডানজিগের জনগণ জার্মানিকে স্বাগত জানায়। কিন্তু হিটলারের উচ্চাভিলাষী আগ্রাসন ঠেকাতে কূটনৈতিক যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স দুই দিনের মাথায় ৩ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডের পক্ষে এবং জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই ইউরোপ আর আজকের ইউরোপের মধ্যে অনেক পার্থক্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইংল্যান্ডের সম্মিলিত শক্তির কাছে জার্মানি, ইতালি ও জাপানের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তবে প্রায় পাঁচ বছরের এই দীর্ঘ মানবঘাতী যুদ্ধের ভয়াবহতার রেশ ধরে পুরো বিশ্বব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি এবং ক্ষমতা বলয় ও তার সমীকরণের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। পরাজিত জাপান, পূর্বের মহাদেশ অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী ব্লক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপ সমাজতান্ত্রিক ব্লকে অবস্থান নিলে বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৯১, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ বছর দুই পরাশক্তি সরাসরি কোনো যুদ্ধে না জড়ালেও এশিয়া এবং আফ্রিকার বহু দেশে তাদের নামে ছোট-বড় স্বল্পমেয়াদি অথবা দীর্ঘমেয়াদি প্রঙ্ িযুদ্ধ হয়েছে। সেসব প্রঙ্ িযুদ্ধে কখনো বা সোভিয়েত ইউনিয়ন আবার কখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পিছু হটতে হয়েছে। কোনো পক্ষই সব যুদ্ধে জয়ী হয়নি বা পরাজয়বরণ করেনি। ষাট দশকে শুরু হওয়া ভিয়েতনামের দীর্ঘ যুদ্ধে সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে এসে আমেরিকার শোচনীয় পরাজয় এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাত গুটিয়ে আসা তার অন্যতম উদাহরণ। তবে দীর্ঘ সাধনার পর একজন মিখাইল গর্বাচেভ ও একজন বরিস ইয়েলৎসিন আমেরিকা তৈরি করতে পেরেছিল বলেই ১৯৯১ সালে ওই দুজনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে দিয়ে আমেরিকা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে একক পরাশক্তি হিসেবে আত্দপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়। তারপর থেকে একক পরাশক্তির নেতৃত্বে বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের জন্য ভালো কি মন্দ হয়েছে তার বিচার হয়তো ইতিহাস একদিন করবে। তবে ইরাকের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রকে মিথ্যা অজুহাতে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, প্যালেস্টাইন জনগণের ন্যায্য অধিকারের বিপরীতে যেভাবে আমেরিকা ইসরায়েলকে নগ্নভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং নিজেদের বেনিয়া স্বার্থে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দ্বিমুখী আচরণের মাধ্যমে যেভাবে নিজেদের করায়ত্তে রাখতে চাচ্ছে তা বিশ্বের বৃহত্তর মানুষের কাছে কখনো গ্রহণযোগ্য হয়নি, আগামীতেও হবে বলে মনে হয় না। এখনো আমেরিকা সব বিবেচনায় বিশ্বের এক নম্বর শক্তিশালী দেশ। তবে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের মহাউত্থান, ২০০০ সালে প্রবল জাতীয়তাবাদী নেতা পুতিনের ক্ষমতা আরোহণ ও রাশিয়ার অভ্যন্তরে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, স্নায়ুযুদ্ধ সময়ের চীন-রাশিয়ার দ্বন্দ্বের অবসান, এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর নতুন নতুন অর্থনৈতিক জোট গঠন এবং বিশ্ব ও আঞ্চলিক ক্ষমতা বলয়ের নতুন সমীকরণের দিকে যারা সতর্ক নজর রাখছেন, সেসব বিশ্লেষকের ধারণা, ২০৪০ অথবা বেশি হলে ২০৫০ সালের পর আমেরিকার একক পরাশক্তির কর্তৃত্ব বিশ্বে আর থাকবে না। সে সময় বিশ্বের ক্ষমতা বলয়ের সমীকরণের চিত্র কেমন হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষকের পূর্বাভাস তখন একক পরাশক্তির পরিবর্তে বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হবে বহুমুখী শক্তির সমন্বিত কোনো বলয় কেন্দ্র থেকে। তখন অবশ্যই চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাই একবিংশ শতকের শুরু থেকেই রাশিয়া তার ক্ষমতা বলয় গড়ে তোলার জন্য চীন ও ভারতের দিকেই বেশি নজর দিচ্ছে। রাশিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে বিশ্বের উদীয়মান শক্তির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমন্বয়কারী ব্লক BRICS (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও সাউথ আফ্রিকা)। এ বছরের প্রথমদিকে রাশিয়ায় নিযুক্ত ভারতের নতুন রাষ্ট্রদূত পিএস রঘবনের প্রাথমিক পরিচিতি অনুষ্ঠানে পুতিন ভারতকে সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বৈ থাকা স্ট্র্যাটেজিক অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করেন। ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ফরেন পলিসি জার্নালের অর্থনীতিবিদ রবার্ট ডাবি্লউ ফগেল একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে দেখিয়েছেন ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্বের অর্থনীতি ও মানবসম্পদের চিত্রটি কেমন হবে। তাতে তিনি বলেছেন, ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতির ৪০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করবে চীন একা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির পরিমাণ হবে ১৪ শতাংশ এবং ইউরোপের মাত্র পাঁচ শতাংশ। ২০৫০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মিলে বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র ১২ ভাগ বাস করবে। তাই বলা হয়েছে, তখনকার প্রায় ৯০০ কোটি মানুষের মাত্র ১২ ভাগ অধিবাসী নিয়ে সামরিক কিংবা অর্থনৈতিক কোনো ক্ষেত্রেই আধিপত্য বজায় রাখতে পারবে না আমেরিকা ও ইউরোপ। ইউক্রেন ক্রাইসিস থেকে পিছু হটা সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা বিশ্ব বা আমেরিকার জন্য প্রথম নয়। কয়েক মাস আগে সিরিয়া ইস্যুতে আরও লজ্জাজনকভাবে আমেরিকাকে পিছু হটতে হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বজায় রাখার ক্ষেত্রে এখনো আমেরিকার প্রাধান্য থাকলেও সেটি যে বেশ নড়বড়ে হতে শুরু করেছে তা কিন্তু বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান খুঁটি সৌদি আরবের সঙ্গে আমেরিকার বোঝাপড়া যে ভালো নেই তা সম্প্রতি বারাক ওবামার সৌদি সফরের সময়ই বোঝা গেছে। মিসরে মুহম্মদ মুরসির নেতৃত্বে ব্রাদারহুডের সরকারকে প্রথমদিকে আমেরিকার সমর্থন, সিরিয়ায় আসাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের ঘোষণা দিয়েও পিছুটান এবং সম্প্রতি ইরানের প্রতি নমনীয় ভূমিকা গ্রহণের কারণে সৌদি আরব আমেরিকার ওপর ভীষণ নাখোশ হয়েছে। ২০১০ সালের শেষে ও ২০১১ সালের প্রথমদিকে আরব বসন্তের জোয়ারে তিউনিশিয়া, ইয়েমেন ও মিসরের স্বৈরশাসকরা পদচ্যুতি হয়েছিলেন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের ধাক্কায়। সেখানেও শুরুর দিকে ওইসব দেশের স্বৈরশাসকদের আমেরিকা সমর্থন দিয়ে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের পর জুনিয়র বুশের দুই মেয়াদ এবং বারাক ওমাবার এক মেয়াদ শেষ করে দ্বিতীয় মেয়াদের মাঝামাঝিতে এসেও প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল সংকট সমাধানের কোনো পথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখাতে পারেনি। বিল ক্লিনটনের সময়ে কিছু অগ্রগতি হয়েছিল, কিন্তু তারপর সেই শান্তি প্রক্রিয়াকে পরবর্তী প্রেসিডেন্টদের আমলে আমেরিকা আর এগিয়ে নিতে পারেনি। আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় এবং পরোক্ষভাবে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থকে রক্ষার জন্য যে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) গঠিত হয়েছিল তারও এখন ভগ্নদশা। মিসরে ব্রাদারহুডকে সমর্থন দানের জন্য কাতারকে জিসিসি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ওমান নিজ থেকে কাউন্সিল হতে বেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে পুরো মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইরানকে বিচ্ছিন্ন ও একঘরে করার জন্য ইরাকের মতো একটি সেক্যুলার আধুনিক রাষ্ট্রকে আমেরিকা ধ্বংস করতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ইরাকের শিয়াপন্থি সরকার ইরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করছে এবং ইরাক-ইরান অস্ত্র চুক্তির গোপন খবরও পত্রিকায় এসেছে। আফগানিস্তানে দীর্ঘ ১৩ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষপ্রান্তে এসে আমেরিকারই বসিয়ে দেওয়া প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই প্রকাশ্যে বলছেন, আমেরিকাই আফগানিস্তানের প্রকৃত শত্রু এবং কারজাই-তালেবান ভাই ভাই। গত শতকের আশির দশকের শুরুতে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনীকে বিতাড়িত করার কাজে ইসলাম নামধারী ধর্মান্ধ তালেবান নামক বিষধর শাপের সঙ্গে আমেরিকা গাঁটছড়া বাঁধে। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী ফিরে যেতে বাধ্য হয় ঠিকই কিন্তু নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো নিজেদের লেলিয়ে দেওয়া বিষাক্ত শাপ এখন আল কায়েদাসহ শত শত বাহারি নামে পৃথিবীব্যাপী ছায়ার মতো আমেরিকার পিছু নিয়েছে। এই ছায়াসম কথিত ইসলামিক জিহাদিদের সঙ্গে যুদ্ধে আমেরিকা এখন রণক্লান্ত। এই শত্রুর কোনো সীমানা আমেরিকা এখন আর সুনির্দিষ্ট করতে পারছে না। আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল সম্প্রতি বলেছেন, 'দেশ এখন আর দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল সামরিক অভিযানে জড়িত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে না। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলে আসা যুদ্ধের পর আমেরিকার জনগণ সংঘর্ষে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে এবং যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে রণাঙ্গনের সেনাদের পরিবারের ওপর'। তাই উপসংহারে বলা যায়, আমেরিকা এখনো বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাবান রাষ্ট্র। তবে আমেরিকার অভ্যন্তরে যে ক্ষয়িষ্ণু ধারা শুরু হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে রাশিয়া এবং রাশিয়ার সঙ্গী হিসেবে চীনের ভূমিকার কারণে একের পর এক আমেরিকাকে যেভাবে পিছু হটতে হচ্ছে তাতে এর শেষ কোথায় সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাদের হয়তো আরও কয়েকটি বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

ই-মেইল :[email protected]

 

সর্বশেষ খবর