সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

স্মৃতির মণিকোঠায় হোসনে আরা কামাল

ড. সুফিয়া আহমেদ

স্মৃতির মণিকোঠায় হোসনে আরা কামাল

আগামীকাল ১৫ এপ্রিল হোসনে আরা কামালের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। পাঁচ বছর আগে ঠিক এই দিনে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আমাদের সবাইকে ছেড়ে সে চলে গেছে। মিসেস হোসনে আরা কামালের ডাক নাম ছিল ভিনা। এ নামেই ও ছিল আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ। ভিনার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে। তার বাবা জনাব হাফিজুর রহমান ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আর আমার বাবা জনাব মোহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি। পরবর্তীতে দুজনই আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। সেভাবে তাদের দুজনের মধ্যে সামাজিকভাবে মেলামেশার সুবাদে আমরা একে অপরকে চিনতাম। তবে এ পরিচিতিটা আরও ঘনিষ্ঠ রূপ লাভ করে যখন আমি ও আমার স্বামী ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত সাবেক প্রধান বিচারপতি জনাব মোস্তফা কামালের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ইতোপূর্বে ১৯৫৫ সালেই আমি, আমার স্বামী, আমার ছোটভাই খালেদ ইব্রাহিম ও মোস্তফা কামাল একসঙ্গে একই ফ্লাইটে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে যাই। আমরা তিনজন উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ব্রত হই। আর খালেদ একটা প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি হয়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালীন ১৯৫৭ সালে কামাল ঢাকায় এসে পারিবারিকভাবেই ভিনাকে বিয়ে করে লন্ডনে ফিরে আসে। পরবর্তীতে ভিনা যখন লন্ডনে যায় সেই একই ফ্লাইটে আমার বাবা বিচারপতি ইব্রাহিমও চিকিৎসার উদ্দেশ্যে লন্ডনে যান। লন্ডনে থাকাকালে আমাদের মধ্যকার অন্তরঙ্গতা আরও সুদৃঢ় হয়। ভিনা লন্ডনের বেডফোর্ড কলেজে সমাজবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়। সেখানে ১৯৫৮ সালের মার্চে তাদের প্রথম সন্তান বর্তমানে শিক্ষাবিদ ও সংগীতশিল্পী ড. নাশিদ কামাল জন্মগ্রহণ করে। মজার ব্যাপার এই যে, আমাদেরও প্রথম সন্তান বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি ড. সৈয়দ রিফাত আহমেদ ওই বছরই ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণ করে। প্রবাসে শিক্ষাজীবন শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করে কর্মজীবনে প্রবেশ করলেও আমাদের মধ্যকার সামাজিক বন্ধন অটুট থাকে। ভিনার চরিত্র ছিল নানা গুণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাহ্যিকভাবে সে ছিল যেরূপ সুন্দর তার ভেতরটাও ছিল সেরূপ সহজ, সরল, নির্মল ও কোমল। সব মিলিয়ে সে ছিল একজন উন্নত মনের মানুষ। নিজে সুশ্রী হওয়া সত্ত্বেও সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ ছিল না। সাজসজ্জার প্রতি সে ছিল বরাবরই উদাসীন। বরং মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গুণাবলীর পরিচর্যাই ছিল তার কাছে মুখ্য। সে ছিল স্পষ্টবাদী ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সত্য কথা বলতে সে কখনো কুণ্ঠাবোধ করত না।

তার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও আগ্রহ ছিল পেশাজীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করা এবং স্বামী ও সংসারের ব্যস্ততা সত্ত্বেও তার দৃঢ় সংকল্পই তাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছে দিয়েছিল। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের (তৎকালীন সমাজকল্যাণ কলেজ) লেকচারার হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা। ১৯৯১ সালে সে ওই ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিযুক্ত হয় এবং ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করে। ২০০১ সালে সে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে। ইতোপূর্বে ১৯৭৯ সালে সে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে। কিন্তু পেশাজীবন গড়তে গিয়ে সে পারিবারিক দায়িত্ব পালনে কখনোই শৈথিল্য দেখায়নি। সন্তানদের লালন-পালনেও তার আন্তরিকতার কমতি ছিল না। তার সন্তানরা প্রত্যেকেই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। গুণীজনদের প্রতি ছিল ভিনার অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ। সে সচরাচর বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষের সংশ্রবে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। ভিনার চরিত্রের আরেকটি দিকের প্রতি আলোকপাত না করলেই নয়। তা হলো, সে ছিল একজন নিভৃতচারী সমাজসেবী। সে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন পল্লী শিশু ফাউন্ডেশন, বা.মা.নে., সি.আর.পি.-এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে সমাজের অসহায় ও দুস্থ মানুষের কল্যাণে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল। মানবতার কল্যাণই ছিল তার একমাত্র ব্রত। কিন্তু সে ছিল প্রচারবিমুখ।

তার মতো এ ধরনের ব্যক্তিত্ব সচরাচর দেখা যায় না। যেমনটি আগেই বলেছিলাম, আমাদের মধ্যকার সামাজিক যোগাযোগ সব সময়ই অক্ষুণ্ন ছিল। ভিনার জীবন সায়াহ্নেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। নিজের শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও সে আমাকে দেখতে আসত। বিশেষত আমার স্বামী ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ যখন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন, তখন সে প্রায়ই তাকে দেখার জন্য আমাদের বাড়িতে আসত। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর সে আমাকে মানসিক দিক থেকে শক্তি জোগাত, উজ্জীবিত করত। আমরা পরস্পরের সঙ্গে এতই ঘনিষ্ঠ ছিলাম, পরস্পরকে এত কাছ থেকে দেখেছি, জেনেছি, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করেছি, যে কারণে স্বাভাবিকভাবে মনের অজান্তেই আমাদের দুজনের মধ্যে পরস্পরের প্রতি একটা ভালোবাসা ও মমত্ববোধ গড়ে উঠেছিল। ভিনার আজ পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাই তার স্মৃতি আমার মনের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে। তাকে আমি প্রতিনিয়তই স্মরণ করি। তার শূন্যতা আমি অনুভব করি প্রতি মুহূর্তে যা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়।

লেখক : জাতীয় অধ্যাপক।

 

সর্বশেষ খবর