শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

গুম

মাহমুদুর রহমান মান্না

গুম

বাংলা নতুন বছর ভালোভাবে শুরু হলো না। বছরের প্রথম দিনেই কুষ্টিয়ায় জাসদ নেতাসহ খুন হলো কয়েকজন। সেন্টমার্টিন দ্বীপে সমুদ্র ডুবে মারা গেল কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ পর্যন্ত পাওয়া লাশের সংখ্যা চার, নিখোঁজ আরও বেশ কয়েকজন। সবশেষে নতুন বছরের তৃতীয় দিনে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এক সিএনজি স্টেশনের সামনে থেকে প্রকাশ্যে বেলা'র প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণ করে নিয়ে গেল দুর্বৃত্তরা।

রাতে হঠাৎ করেই নুরুল কবির এবং ইত্তেফাকের সালেহসহ একটা আড্ডায় ঢুকে গেলাম। ওখানেই আলোচনা হচ্ছিল এগুলো। কারা অপহরণ করতে পারে রিজওয়ানার স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে? মাস কয়েক আগে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এক পার্টিতে। স্মার্ট, ইয়াংম্যান। কোনো রাজনীতির ধারে-কাছে নেই। অমায়িক, বেশ কথাবার্তা হলো। রিজওয়ানাও ছিলেন সঙ্গে।

রিজওয়ানার সবচেয়ে বড় পরিচয় সম্ভবত একজন পরিবেশকর্মী হিসেবে। র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি, যেটাকে অনেকে এশিয়ার নোবেল বলে অভিহিত করেন। কিন্তু সেটাও বড় কথা নয়। পেশায় আইনজীবী রিজওয়ানা বেলা'র প্রধান নির্বাহী হিসেবে জাহাজ ভাঙা ও প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিগুলোর অনেকের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা করেছেন। যার ফলে এই কোম্পানিগুলো ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরাই কি এরকম একটি ঘটনা ঘটিয়েছে? রিজওয়ানা হাসান তাই মনে করেন। ফতুল্লা থানায় করা মামলায় তিনি সেরকমই বলেছেন। যদিও দুটি বড় ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। সত্যি সত্যি কী ঘটেছে সেটি এই মুহূর্তে বলতে পারব না। রিজওয়ানা বয়সে কম হলেও একজন ভালো আইনজীবী। তার স্বামীর অপহরণের খবর পাওয়ার পরে তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছি আমি। তাছাড়া মামলা করতে, স্বামীর খোঁজে রিজওয়ানা যখন নারায়ণগঞ্জে গেছেন তখন কোনো কোনো টেলিভিশন তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছে। নিশ্চয়ই স্বামীর এই অপহরণের ঘটনায় তিনি বিচলিত, বেদনাহত। কিন্তু তার পরও তিনি ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলেছেন। রিজওয়ানার স্বামী আবু বকর ফতুল্লা পোস্ট অফিস মোড়ে অবস্থিত হামিদ ফ্যাশন লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক। তিনি সম্ভবত এর মালিক নন। এর মালিক বর্তমান সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। প্রতিমন্ত্রী নিজেও হামিদ রিয়েল এস্টেট নামে একটি আবাসন কোম্পানির মালিক ও রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি। জাতীয় শ্রমিক লীগ ফতুল্লা আঞ্চলিক শাখার সভাপতি কাউসার আহমেদ পলাশের নেতৃত্বে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর বন্ধ ছিল। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কারখানাটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন আবু বকর সিদ্দিক। এ পরিচয় থেকে আবু বকর সিদ্দিককে ধনী মানুষ মনে হয় না। ব্যবসাগত কারণে কিংবা কারখানার শ্রমিক অসন্তোষে এরকম হতে পারে তাও মনে হয় না। টাকার জন্য কেউ তাকে অপহরণ করবে তার পক্ষেও যুক্তি দাঁড়ায় না। রিজওয়ানা নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, জানা মতে তার স্বামীর কোনো শত্রু নেই। তাদের এমন কোনো টাকা-পয়সা নেই যে, কেউ তার স্বামীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করবে।

তবে কী? কেন অপহৃত হলেন আবু বকর সিদ্দিক? সেসব নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছিল আড্ডায়। কোনো রাজনৈতিক বিষয় কি? তা তো হওয়ার কথা নয়? বছর দুয়েক আগে রিজওয়ানার কাজকর্মে ক্ষেপে গিয়ে একটি মহল তাকে একটি রাজনৈতিক রং মাখানোর চেষ্টা করেছিল। বলেছিল রিজওয়ানার বাবা একজন রাজাকার ছিলেন, তিনি একজন বিএনপির নেতা ছিলেন, তার মেয়েটিও সেই লাইনেই আছে। সেগুলো আজ থেকে দুবছরেরও আগের কথা। এই সময়ের মধ্যে রিজওয়ানাকে কোনো দলীয় কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি। রিজওয়ানা বিটি বেগুন চাষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঢাকার বাইরে অংশ নিয়েছেন, ধানমন্ডি দখলের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংঘটিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলের কোনো অনুষ্ঠানে তাকে দেখা গেছে এমনটি কেউ বলেনি। তাহলে কেন? কেন তার স্বামীকে অপহরণ? তাও দিনদুপুরে। পুলিশ প্রশাসন কী করছে? সরকার? আজকের পত্রিকার খবর অনুযায়ী পুলিশ অপহৃত আবু বকর সিদ্দিককে খুঁজে বের করার জন্য জোর তৎপরতা শুরু করেছে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) ও র্যাবের মহাপরিচালক এবং পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। অপহরণের ঘটনা তদন্তে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাওয়া যাবে কি আবু বকর সিদ্দিককে। আড্ডার একজন বললেন, পেলে তাকে পাওয়া যাবে আজকের মধ্যেই। রাত পোহানোর আগেই। অপহরণকারীরা ঢাকার অদূরে কোথাও হয়তো তাকে ফেলে দিয়ে চলে যাবে। এ সবই আড্ডার কথা। কথার পৃষ্ঠে কথা। সাধারণত আমি সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। আজকে একটু তাড়াতাড়ি উঠেছিলাম। উঠেই টেলিভিশনটা ছাড়লাম। যদি নিখোঁজ আবু বকর সিদ্দিকের কোনো খবর থাকে। কিন্তু না। গতকালকের অপহরণের সংবাদটাই টিভি স্ক্রলে। পত্রিকাগুলো হাতে নিলাম। প্রায় সব পত্রিকায় আবু বকর সিদ্দিকের অপহরণের খবর বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে আর তার পাশাপাশি ছাপা হয়েছে ইলিয়াস আলীর খবর। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানী থেকে অপহৃত হন ইলিয়াস আলী। দুই বছরে তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। সেই থেকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তদন্ত চলছে। বনানী থানার ওসি বলেছেন, তদন্ত এখনো চলছে। আমরা নিয়মিত আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে যাচ্ছি।

ইলিয়াস আলী এবং আবু বকরের অপহরণ নিশ্চয়ই একসূত্রে গাঁথা নয়। কিংবা উভয় ক্ষেত্রেই তদন্ত করছে তো পুলিশ। হঠাৎ করেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। যদি কাল সকালেও কোনো সংবাদ না পাওয়া যায় আবু বকর সিদ্দিকের। রিজওয়ানা হাসান যেন আমার এই লেখাটি না পড়েন। আর আমার বুকের মধ্যে যে হঠাৎ করে একটি ভয় ঢুকে যায় তা যেন অমূলক প্রমাণ হয়।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে অপহরণ-গুম-খুন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এর ওপর গবেষণা চালিয়েছে। একটি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী কেবল ২০১৩ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অপহৃত হয়েছেন ৩৫ জন। অপহৃতদের পরিবার অভিযোগ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে দুজনের লাশ পাওয়া গেছে। ১৬ জনকে ফিরে পাওয়া গেছে। আর বাকিদের খোঁজ জানা যায়নি। এটি সম্ভবত সবচেয়ে কম সংখ্যার উল্লেখ। কোনো কোনো সংগঠনের রিপোর্টের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়া, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নিপীড়ন, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ- সব মিলিয়ে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের মানুষ চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১৩-তে এই দাবি করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সংগঠনটি। বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে। ২০১৩ সালে পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৩২৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়। পাঁচ বছরে এই সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। এর মধ্যে পুলিশের হাতে সর্বোচ্চ ১৭৫ জন এই হত্যার শিকার হয়। ২০০৯ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা ছিল ১৫৪। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের জড়িত থাকার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে ২০১৩ সালে তারা ১১ জনকে হত্যা করে।

পত্রিকার খবরে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তারা রিজওয়ানাকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ব্যাপারটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালাতে বলা হয়েছে আবু বকর সিদ্দিককে উদ্ধার করার জন্য। সেই কথার সূত্র ধরে নাকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে তথ্য পেয়ে জানি না স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। শীঘ্রই তাকে উদ্ধার করা যাবে। আমরা চাইব তাদের এ আশাবাদ যেন বাস্তবে রূপ নেয়।

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।

ই-মেইল : [email protected]

 

সর্বশেষ খবর