শনিবার, ১০ মে, ২০১৪ ০০:০০ টা

ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক কী হওয়া উচিত?

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক কী হওয়া উচিত?

গত কয়েক দিন বারডেম, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড মিটফোর্ড হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত অনেক হাসপাতালে রোগী, রোগীর আত্দীয়স্বজন, স্থানীয় মস্তান, রোগীর দালালসহ অনেকের সঙ্গে ডাক্তারদের সংঘর্ষ হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ডাক্তাররা সমাজের সব শ্রেণি-পেশার শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। শত্রু বলছি কারণ, সামান্যটুকু শ্রদ্ধা ডাক্তাররা পাচ্ছেন না। সব টেলিভিশন চ্যানেলে রীতিমতো প্রতিযোগিতামূলক আলোচনা, সমালোচনা, কী হওয়া উচিত 'ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক'।

তথ্য স্বাধীনতা বা বাক-স্বাধীনতার ফলে আলোচনার সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে, দুই পক্ষের জন্যই। চিকিৎসক-রোগীর দ্বন্দ্ব বা দুর্ব্যবহার মিডিয়ার কল্যাণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব বিবেকবান ব্যক্তির মুখে ঘুরে-ফিরছে। চিকিৎসকরা আতঙ্কিত, রোগীরা ভীত-সন্ত্রস্ত এবং দ্বিধাগ্রস্ত। আমি এখানে শুধু চিকিৎসক ও রোগী নিয়েই কথা বলতে চাচ্ছি না। স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব যদি আমি চিকিৎসক ও জনগণ নিয়ে কিছু অবতারণা করতে পারি।

চিকিৎসকের ইংরেজি শব্দ Doctor, Latin ‘Docere' শব্দ থেকে গৃহীত, যার অর্থ হলো- 'A learned and authoritive person।' আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, কোনো অভিভাবক ডাক্তার বা প্রধান শিক্ষককে এসে জিজ্ঞাসা করতেন, আমার ছেলে এসএসসিতে এই ফলাফল করেছে, এখন তাকে কীসে পড়াব। প্রধান শিক্ষক বা সমাজের গুণী সেই ডাক্তার ছাত্রের মেধা, মা-বাবার আর্থিক সঙ্গতি, সামাজিক পরিবেশ সব বিচার করে যে উপদেশ দিতেন, তা-ই অভিভাবকরা মেনে নিতেন।

'Patient' শব্দটা গ্রহণ করা হয়েছে Latin Patiere শব্দ থেকে। যার অর্থ হলো 'who seeks help for illness'। তাহলে Doctor- Patient-এর শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায় 'একজন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি অন্য একজন জ্ঞানী বা দক্ষ ব্যক্তির কাছে রোগ নিরাময়ের জন্য অসহায়ের মতো সাহায্য প্রার্থনা করছেন।' এ প্রসঙ্গে Childern of the lesser god ছবির অভিনেত্রী জন্মগত বোবা ও বধির Ms. Marlee Matlin এর ২০১১ সালের সানফ্রান্সিসকো সম্মেলনের সহস্রাধিক নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞের উদ্দেশে বলা কটি শব্দ আমার কানে এখনো বাজে। যা হলো 'Support the patient, not just treat।' সুতরাং দুয়ের মধ্যে ডাক্তারের দায়িত্ব রোগীর চেয়ে শতগুণ বেশি। মনে রাখতে হবে, যে কোনো দিন যে কেউ রোগী হতে পারেন, এমন কি ডাক্তার সাহেব নিজেও, তার নিকটাত্দীয় স্বজনও। কিন্তু যে কেউ চাইলেই যখন-তখন ডাক্তার হতে পারেন না। তাকে একটা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে, ধাপে ধাপে, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে কঠোর পরিশ্রম এবং সাধনার মাধ্যমে ডাক্তার হতে হয়। চিকিৎসক হতে হলে মেডিকেল কলেজে ভর্তি থেকে শুরু করে, প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতি পর্যন্ত প্রতিটি স্তর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বিবেচনায় হতে হবে। যেহেতু আমি একজন চিকিৎসক, তাই ডাক্তারদের ভর্তি, লেখাপড়ার পদ্ধতি, সুযোগ-সুবিধা, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতিসহ চাকরির সব দিকগুলো নিয়ে আগে লিখতে চাই।

একটি শিশু জন্ম নেয় মানুষের আকৃতি নিয়ে, মানবীয় গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ হতে তাকে সাহায্য করে পরিবার, পরিবেশ ও সমাজ এবং সর্বোপরি শিক্ষা। তেমনি একজন চিকিৎসক হওয়ার জন্য একজন ছাত্রকে আমি যখন মনোনীত করব, শুধু তার তাত্তি্বক দিক বিবেচনা করলে চলবে না, যে সমাজকে চিকিৎসক হয়ে সেবা প্রদান করবে, সেই সমাজের উপযোগী ছাত্রকেই নির্বাচিত করতে হবে। প্রথমত, দেখতে হবে সেই ছাত্রটি কোনো সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল কিনা। প্রাথমিকভাবে তার অথবা ওর স্কুল শিক্ষকের কাছ থেকে একটি রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে, যাতে তার মেধার সঙ্গে এ দেশের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে সে খাপ খাওয়াতে পারে, এ ধরনের একটি দর্শন উপস্থাপিত হবে। অষ্টম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সমাজকল্যাণমূলক কাজের পরিধি দেখতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে তুলনামূলক মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।

সবশেষে মেডিকেল পরীক্ষার মাধ্যমে তার স্বাস্থ্যগত, মানসিক এবং Aptitude-এর দিক দেখতে হবে। সব মিলিয়ে সত্যিকারের সুস্থ, মেধা-মননসম্পন্ন, সমাজসচেতন এবং সেবামূলক কাজে আগ্রহী একজন ছাত্রই চিকিৎসক হওয়ার যোগ্যতা পাবে। চারদিকে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের ছড়াছড়ি। এক সময় গুটিকয়েক সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ছাত্ররা, যারা শিক্ষা, সেবা আর আদর্শকে বড় করে দেখত এবং গ্রামগঞ্জের স্কুল থেকে উঠে আসত।

এখনকার প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোর অধিকাংশ (সব নয়) ছাত্রই বড় হয়েছে বিত্তবৈভব আর আরাম-আয়েশের মধ্যে। শহরের গণ্ডির বাইরে, কখনো অজপাড়াগাঁয়ের বাপ-দাদার ভিটায় তারা যাননি। অনেকের ধারণা, পরিবারের মর্যাদা বাড়ে যদি পরিবারের একজন সদস্য চিকিৎসক হয়। আবার একই প্রতিষ্ঠানে ৫% ছেলেমেয়ে ভর্তি হচ্ছে দরিদ্র মেধাবী কোঠায়। তাই যারা অতি দরিদ্র কিন্তু মেধাবী কোঠায় ভর্তি হয়েছেন, তারা ধনীর সন্তানদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে মনের দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েন। এই কোঠাটা বাড়াতে হবে।

সুতরাং চিকিৎসকদের মর্যাদা বাড়াতে, সত্যিকার চিকিৎসক তৈরি করতে হলে ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য চিকিৎসা (মেডিকেল অ্যাডুকেশন) ও গবেষণা আলাদা করে নিলে মনে হয় ভালো হবে। চিকিৎসাসেবাকে পণ্যের সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। তারপরও যদি পণ্য মনে করা হয়, তাহলে ভালো পণ্যের জন্য দক্ষ কারিগরের দরকার। আর গবেষণা এবং সাধনা হচ্ছে পণ্যের গুণগত মান বাড়ানোর একমাত্র পথ, যা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। তাই মন্ত্রণালয়ের উচিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, মেডিকেল অ্যাডুকেশন ও গবেষণা আলাদা করে সাজানো। ভালো চিকিৎসক হতে প্রয়োজন ভালো শিক্ষা, শিক্ষা দেওয়ার জন্য যদি পর্যাপ্ত শিক্ষক বা উপকরণ না থাকে, তাহলে ছাত্র কী করবে?

একজন রোগী এই সমাজেরই অংশ, সমাজের অস্থিরতা, সমাজের অবক্ষয় তাকেও অস্থির করে তোলে। তাই জনগণকেও চিন্তা করতে হবে চিকিৎসক শুধু চিকিৎসকই নন, তিনিও জনগণের একটি অংশ। মাঝে-মধ্যে ডাক্তার-রোগীর অসামঞ্জস্য দ্বন্দ্বের পেছনের সামাজিক অবস্থাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আমাদের জীবনযাপন, জীবনদর্শন আর সামাজিক অবস্থানের উন্নতির মাধ্যমে আমরা ডাক্তার হই বা রোগী হই, নিজেদের জন্য একটা সম্মানিত অবস্থান তৈরি করতে পারব। সামাজিক পরিবর্তনের মতো বিজ্ঞানও পরিবর্তিত হয়। উচ্চতর প্রশিক্ষণ একজন চিকিৎসকের জন্য অপরিহার্য। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন চিকিৎসক তার কর্মদক্ষতা বাড়াতে পারেন। এমনকি নিজের ব্যবহারেরও পরিবর্তন ঘটাতে পারেন।

প্রত্যেক ছাত্রের সামনে একজন রোল মডেল শিক্ষক থাকতে হবে। আমাদের বেলায় কিন্তু তাই ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে ছাত্র অবস্থা থেকে আমার রোল মডেল হিসেবে অধ্যাপক নূরুল আমিন স্যারকে বেছে নিয়েছিলাম। এ ছাড়াও অধ্যাপক এ এস এম ফজলুল করিম স্যার, অধ্যাপক নূরুল হক সরকার স্যার, অধ্যাপক এ এস মিঞা, অধ্যাপক মির্জা মাজহারুল ইসলাম, অধ্যাপক এস জি এম চৌধুরী, অধ্যাপক মান্নান স্যার, অধ্যাপক নূরজাহান ভূইয়া, অধ্যাপক জাহানারা বেগম, অধ্যাপক কাজী আতাহার উদ্দীন, অধ্যাপক ডিপি বড়ুয়া, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম (ফরেনসিক মেডিসিন), অধ্যাপক নূরুল আনোয়ার এবং অধ্যাপক কাশেম স্যার, অধ্যাপক আবদুল মান্নান সিকদার এমন কি অধ্যাপক সামসুজ্জোহা স্যারসহ অনেকেই রোল মডেল ছিলেন। এ ব্যাপারে ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপক নূরুল ইসলাম স্যারের একটা ঘটনার অবতারণা করছি। শেষ পর্ব ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষার স্ত্রী রোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিষয়ের Viva, Practical এবং Clinical পরীক্ষা দিয়ে বের হতেই, স্যারের সামনে পড়লাম। প্রিয় ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের দায়িত্ব হিসেবে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, পরীক্ষা কেমন হয়েছে? আমি জবাব দিলাম আবার দিতে হবে ছয় মাস পরে। স্যার বললেন কেন? বললাম কারফিউ স্যার। স্যার বললেন বুঝলাম না। তখন জিয়াউর রহমানের শাসন, যখন-তখন অস্ত্র উদ্ধারের নামে ছাত্রাবাস, আবাসিক এলাকাসহ যেখানে-সেখানে কারফিউ দেওয়া হতো। বললাম মেহেদিবাগে কারফিউ দিয়েছিল সকাল থেকে, তাই পরীক্ষক (বহিরাগত-External) আসতে পারেননি। নূরজাহান ম্যাডাম, আর.এস. ফারুক ভাইকে নিয়ে পরীক্ষা শুরু করে দিয়েছিলেন। ১২টার দিকে কারফিউ ওঠার পর তিনি এলেন এবং প্রথম তার সামনে ভাইভার ডাক আসে আমার। তারপরও স্যার বললেন অন্য টেবিল কেমন হয়েছে? আমি বললাম ভালো, কিন্তু তারপরও পাস করব না স্যার। স্যারের কাছ থেকে প্রণাম করে বিদায় নিয়ে ynae এবং Obs-এর সব বই নিয়ে আমি বাড়ি চলে আসি। ওই বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার ছিলেন ট্যাবুলেটর। ফলাফল টেবুলেশনের পর শুধু পাস নয়, মেধা তালিকায় আমার স্থান দেখে তিনি আমার হবু স্ত্রী জয়াকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কি প্রাণ গোপালের বাড়ির ঠিকানা জান? সে লজ্জায় লাল হয়ে বলেছিল, স্যার সুজিত জানে। সুজিত ওর এলাকার। তারপর ফল প্রকাশের আগেই তিনি একটা ধারণা দিয়েছিলেন, আমি উতরে গেছি মেধা তালিকায় স্থান নিয়ে। যেহেতু দ্বিতীয় পেশাগত পরীক্ষায় স্যারের হাতেই আমি তৃতীয় স্থান পেয়েছিলাম, তাই স্নেহের কমতি ছিল না।

মুষ্টিমেয় কিছু প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ বাদ দিয়ে অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে যেমনি রয়েছে শিক্ষক স্বল্পতা তেমনি রোগী সংকটও তীব্র। ফলে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও ব্যাহত হচ্ছে। একজন চিকিৎসকের বৈশিষ্ট্য শুধু চিকিৎসাসেবা প্রদান নয়, রোগীর বিশ্বাসভাজন হয়ে রোগীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে রোগীকে মানসিক প্রশান্তি দেওয়া। Sir William Oslar-এর মতে 'Patient does not care how much you know, rather how much you care them' কিন্তু যেখানে রোগী-ই নেই পর্যাপ্ত, ছাত্ররা কী করে শিখবে-জানবে ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক কি?

রোগী আসে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা আর সহায়তার জন্য, কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। চিকিৎসকও একজন মানুষ, সুতরাং রোগী তথা জনগণ যদি চিকিৎসকের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হয় সময় আর অবস্থানের কথা চিন্তা করে, তাহলে মাঝে-মধ্যে ঘটে যাওয়া অপ্রাসঙ্গিক ঘটনাগুলো নতুন করে ঘটার সম্ভাবনা নেই।

Medical Ethies বলে একটা শব্দ আছে Medical Ethies অনুযায়ী : I will respect the privacy of my patients, for their problems and not disclosed to me that the world may know. Most especially must I tread with care in matters of life with death. If it is given me to save a life, all thanks. But it may also be within my power to take a life; this awesome responsibility must be faced with great humbleness and awareness of my own family. Above all, I must not play at god". একজন চিকিৎসক চিকিৎসা জীবনের শুরুতেই Medical Ethies আর Hippocrates Oath সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন, জনগণকেও সেই সঙ্গে অংশগ্রহণ করা উচিত। একজন চিকিৎসক নয়, নাগরিক হিসেবে আমার একটা প্রশ্ন- Ethies কি সব পেশার জন্য প্রযোজ্য নয়। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাহিত্যিক, এমনকি ধর্মগুরু বা যাজক সবারই Ethies থাকা উচিত। কথায় কথায় বাংলাদেশের সবাই চিকিৎসকদের Moral ethics নেই বলে সমালোচনা করেন।

ডাক্তার-রোগীর সুসম্পর্কের মূল ভিত্তি হচ্ছে- আস্থা, বিশ্বাস, পরস্পরের প্রতি সম্মান, জ্ঞানবুদ্ধি এবং রোগ আর জীবন সম্পর্কে মূল্যবোধের এই ভিত্তিগুলো যার আছে তিনি ডাক্তার। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসককে পিতার স্থান দখল করে নিতে হয়। রোগীর বয়স শিক্ষা, মানসিক অবস্থা চিকিৎসকের অবস্থানের কথা ভেবে একটা সুসম্পর্ক তৈরি করা যায়। এতে করে রোগীর আত্দবিশ্বাস জন্মায়, ভালো স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা যায়। আমাদের দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠী অর্ধশিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত, যখনই কেউ রোগে আক্রান্ত হয় সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে চিকিৎসকের উচিত তাদের নিজেদের অবস্থান ও ক্ষমতার কথা রোগীকে জানানো এবং সীমিত ক্ষমতার কথা চিন্তা করে তাদের প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা। রোগীদেরও উচিত ডাক্তারের আস্থাভাজন হওয়া, নিজের মতামত দূরে রেখে চিকিৎসকের প্রতি অনুগত হওয়া। Ethies প্রসঙ্গে মাহাত্দা গান্ধীর সেই বিখ্যাত সাতটি Deadly Sin-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। যার দ্বারা গান্ধীজি সমাজের সব পেশার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন, যা বর্তমানে বিরজমান সর্বত্র।

Wealth without work
Pleasure without conscience
Science without humanity
Knowledge without character
Politics without principle
Commerce without morality
Worship without sacrifice.

ডাক্তার এবং রোগীর সুসম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে মিডিয়া একটা ভালো ভূমিকা নিতে পারে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়া সঠিক ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। যেমন গত ২৩ এপ্রিল মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি ওপিডিতে একটা ছোট্ট ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে। আমি যখন আমার প্রো-ভিসি শহীদুল্লা, পরিচালক হাসপাতাল ব্রি. জে. (অব.) মজিদ ভূইয়া এবং উপ-পরিচালক ডা. নাজমুল, রোগী পক্ষ এবং ডাক্তারদের নিয়ে আলোচনা করে মীমাংসার পর চা খাচ্ছি বেলা ৩.৩০টার দিকে, তখন ETV-তে স্ক্রল নিউজে ভেসে উঠল 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে।' কত মারাত্দক একটা সংবাদ, এই সংবাদ শুনে শাহবাগ মোড় থেকে হাজার হাজার লোক এসে হাসপাতালটা গুঁড়িয়ে দিতে পারত।

এ কথা কি একবার তারা ভেবেছেন? নাকি তারা তাই চেয়েছেন? অন্য টিভি চ্যানেলগুলো কিন্তু এসে আমাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তথ্য উপস্থাপন করেছে। গুজব যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, বীভৎস রূপ নিতে পারে, ইতিহাসের পাতায় তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। সুতরাং ইচ্ছা করে ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে সমাজে শান্তি আনা সম্ভব হবে না। ২৩ এপ্রিলের এই স্ক্রল সংবাদটির জন্য একবারও কি ভুল স্বীকার করে আরেকটি সংশোধনী স্ক্রল দেওয়া যেত না। উদার বাক-স্বাধীনতার দেশেও 'D-notice' বলে একটা শব্দ আছে, যার অর্থ হলো দেশের নিরাপত্তা বিঘি্নত করতে পারে এমন কোনো সংবাদ প্রকাশে সম্পাদকের ওপর নিষেধাজ্ঞা। একইভাবে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে এমন সংবাদও প্রকাশ করা ঠিক নয়। চিকিৎসক হিসেবে আমি বলব ডাক্তার, রোগী, হাসপাতাল এর যে সম্পর্ক সেটা হওয়া উচিত পূজারি, দেবতা, মন্দির বা উপাসনালয়ের মতো।

লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

 

সর্বশেষ খবর