প্রবীণ সাংবাদিক এরশাদ মজুমদার খাজা আহমদের মৃত্যুর পর ফেনীর রাজা নেই নামের লেখাটি লেখেন। তবে তিনি লেখেন 'ফেনীর রাজা নেই। এক নয়, দুই নয়, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে যে রাজা তার রাজ্য চালিয়েছেন তিনি আর নেই।' খাজা আহমদের কর্মজীবনের কিছু অংশ পাঠকদের জন্য দেওয়া হলো। (১৯২০-১৯৭৬)। মরহুম খাজা আহমদ ১৯২০ সালে ফেনীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফেনী মডেল ও ফেনী হাইস্কুলে শিক্ষা লাভ করেন। বাল্যজীবন থেকে সমাজসেবামূলক কাজে আত্দনিয়োগ করেন। ১৯৩০ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক ঘোষিত ভারতের পৃথক স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেন এবং ওই সালের ২৬ জানুয়ারি পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। ১৯৩৪ সালে নোয়াখালী জেলা কৃষক সমিতির কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৩৬ সালের খাদেমুল ইসলাম ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পুরোপুরিভাবে সমাজসেবায় আত্দনিয়োগ করেন। ১৯৩৭ সালে ফেনীতে খাকছার আন্দোলন সংগঠন করেন। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং ফেনী শহর মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪১ সালে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত করার অপরাধে প্রথমে তাকে স্বগ্রামে এবং পরে স্ববাড়িতে অন্তরীণ করা হয়। ১৯৪২ সালে তিনি ভারত রক্ষা আইনে গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৪ সালে কারামুক্তি লাভ করেন। ১৯৪৬ সালে তার সম্পাদনায় ফেনী থেকে সাপ্তাহিক সংগ্রাম নামে প্রগতিশীল পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮-১৯৪৯ সালে অস্ত্র আইন ও ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৫০ সালে মূলনীতি আন্দোলন, ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের (ক) ধারার, ১৯৬০ সালে সামরিক আইনে, ১৯৬১ সালে সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে মরহুম খাজা আহমদ কারাবরণ করেন। ১৯৬২ সালে কুখ্যাত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ফেনীর দুর্বার গণআন্দোলন শুরু করেন এবং পুনরায় পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে কারারুদ্ধ হন। ১৯৬৮ সালে জনৈক সরকারি কর্মচারী কর্তৃক জনৈকা মেয়ের শ্লীলতাহানির জন্য ওই কর্মচারীকে মারার অপরাধে পুনরায় কারাবরণ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বারাহিপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে নোয়াখালী স্কুল, ১৯৫২ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল বোর্ডের সদস্য, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য, ১৯৫৭ সালে জিলা স্কুল বোর্ডের সদস্য, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মরহুম খাজা আহমদ ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান গণতন্ত্রী দলের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। খাজা সাহেব ফেনী মহকুমা 'কপ'-এর এবং ১৯৬৪-৬৯ সালে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগের পুনর্জীবনের সময় মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি মহকুমা রিকশাচালক সমিতি, বিড়ি শ্রমিক সমিতি, দোস্ত টেঙ্টাইল মিল শ্রমিক ইউনিয়ন, জাতীয় শ্রমিক লীগসহ বহু শ্রমিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। সমবায় আন্দোলনের পুরুধা হিসেবে ফেনী সমবায় ব্যাংকসহ অসংখ্য সমবায় প্রতিষ্ঠানের তিনি চেয়ারম্যান বা সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
একজন বিদ্যানুরোগী হিসেবে মরহুম খাজা সাহেব দীলপুর খাজা আহমদ উচ্চবিদ্যালয় ও রামপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ফেনী সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, সহকারী পাইলট হাইস্কুলের সভাপতি এবং ফেনী কলেজ গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ তার নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ফেনীতে অবস্থানরত ১৪০০ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ ফেনীতে শুরু হয়। ওই তারিখেই তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সচিন্দ্র লাল সিংয়ের সঙ্গে মুক্তিকামী বাঙালিদের পক্ষে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে ফেনী এলাকা সর্বপ্রথম ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্ত হয়। মরহুম খাজা আহমদ ভারত সরকার এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য ব্যতিরেকে ৪টি রিক্রুটিংমরহুম খাজা আহমদ পূর্বাঞ্চল মুক্তিফ্রন্টের সদস্য, আঞ্চলিক মুক্তিফ্রন্টের অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান, মুক্তাঞ্চলের পরিচালক ছিলেন। এছাড়াও খাজা সাহেব মুক্তিযুদ্ধ শেষে ফেনীতে বহু জনহিতকর কাজ করেছেন যা এখনো তাকে অমর বানিয়ে রেখেছে। ফেনীবাসীর এই নেতার অবদান আবালবৃদ্ধবনিতা একবাক্যে স্বীকার করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ মে তিনি রাত ২টা ১০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। আজ খাজা আহমদের বড়ই প্রয়োজন। খাজা সাহেবের মৃত্যুর পর যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা কেউ খাজা আহমদের মতো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেননি। বর্তমান নেতারাও স্থায়ী বন্ধু চান না।
লেখক : খাজা আহমদ পরিষদের সভাপতি