মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
একাত্তর

মুক্তিযুদ্ধের মিনি ক্যান্টনমেন্ট ও মেজর হাই

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার

মুক্তিযুদ্ধের মিনি ক্যান্টনমেন্ট ও মেজর হাই

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য মেজর হাই হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আবদুল হাই ১৯২৭ সালে নরসিংদী জেলার বেলাব থানার উজিলাব গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নওয়াব আলী মুন্সী ও ছমিনা বেগমের একমাত্র সন্তান হাই চরআমলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ শেষে কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর হাইস্কুল থেকে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ঐতিহ্যবাহী গুরুদয়াল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় পিতার মৃত্যু হলে তার পড়ালেখার ইতি ঘটে। বিপ্লবী অখিল দাস, ধরনী বাবু, ফয়েজ মাস্টারের হাত ধরে জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। আভিজাত্যের গণ্ডি ছেড়ে তিনি কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। ১৯৫৩ সালে তিনি এদেশে প্রথমবারের মতো জাপানি পদ্ধতিতে ধান চাষ করে প্রতি একরে ১২০ মণ ধান ফলিয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেন। তার এই কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি জাপানের 'ফার্মার একচেঞ্জ প্রোগ্রামে' আমন্ত্রণ পান। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই বিপ্লবী কৃষক নেতার। কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের নির্দেশে তার এই যাত্রা বাতিল হয়।

নিজে ভূস্বামী হওয়া সত্ত্বেও কৃষকদের সংগঠিত করে ভূস্বামীদের শোষণ-নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৫৬ সালে কৃষকদের স্বার্থবিরোধী ইজারা প্রথা চালু হলে তিনি প্রথম এ প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। নরসিংদীর বেলাব বাজারের লাখ মানুষের সমাবেশ থেকে ইজারা প্রথা বাতিলের দাবি জানান। প্রশাসন এ দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করে কমরেড হাইকে ধরার জন্য ২০ হাজার টাকা পুরস্কার ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের ঘোষণা করে। পুরস্কার ঘোষণা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের এই কণ্ঠস্বরকে যখন পুলিশ ধরতে ব্যর্থ হয় তখন প্রশাসন কৃষকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। সাধারণ মানুষের প্রিয় নেতা কৃষকদের জীবন রক্ষার্থে আদালতে আত্দসমর্পণ করেন। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের নির্দেশে কমরেড হাইকে ঢাকা কারাগারে প্রেরণ করা হয়। নরসিংদীর রায়পুরা, বেলাব, মনোহরদী, শিবপুর ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব, কুলিয়ারচর এবং কটিয়াদিসহ বিভিন্ন এলাকায় কমরেড হাইকে মুক্তির দাবিতে গণআন্দোলন শুরু হয়। তীব্র গণআন্দোলনের ফলে ১৯৬৯ সালে তাকে মুক্তি প্রদান করতে সরকার বাধ্য হয়। দীর্ঘ ১৩ বছর কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে থেকে তিনি বিপ্লবের নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হন। তিনি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে স্থানীয় পর্যায়ে জোরালো ভূমিকা রাখেন। গড়ে তোলেন কৃষকদের নিয়ে বিপ্লবী সংগঠন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। তিনি একাধারে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, পৃষ্ঠপোষক, যোদ্ধা। তার বাড়িতেই গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। ওই ক্যাম্পে প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। একজন বেসামরিক মানুষ হয়েও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি স্থানীয় গণমানুষের কাছে 'মেজর হাই' নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তার বাড়িকে বলা হতো 'মিনি ক্যান্টনমেন্ট।' বেলাব যুদ্ধে শহীদ সুবেদার আবুল বাশার সাতটি গরুগাড়ি বোঝাই করা অস্ত্রশস্ত্রসহ সদলবলে ওই মিনি ক্যান্টনমেন্টে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই অবস্থান করছিলেন। ওই দলে ছিলেন সুবেদার হাকিম, কমান্ডার আবদুল বারিক (ইপিআর ফুলদী ৩), আবদুল কাদির, নায়েক সুবেদার গফুর, নায়েক সুবেদার আকমল, লেফটেন্যান্ট রউফ (ভৈরব) প্রমুখ। সুবেদার বাশার ওই মিনি ক্যান্টনমেন্টে থেকেই নরসিংদী জেলার বেলাব থানার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের দিকে পাকবাহিনীর সঙ্গে বেলাব বাজারের যুদ্ধে সুবেদার বাশার শহীদ হলে মেজর হাই নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে বলিয়ান পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ২৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হলে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে হাইয়ের স্বপ্নের মিনি ক্যান্টনমেন্ট রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী জ্বালিয়ে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের সফল বীর সৈনিক মেজর হাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে তার আন্দোলন চালিয়ে যান। ১৯৭২ সালে বেলাব বাজারে লক্ষাধিক কৃষক ও ক্ষেতমজুরের সমাবেশে তিনি কৃষকদের সহায়তার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। হাইয়ের এমন জনপ্রিয়তায় নব্য মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিবিদরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে তারা রক্ষীবাহিনীর কাছে হাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে। রক্ষীবাহিনী হাইকে গ্রেফতার করে নারায়ণপুর ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং অমানুষিক নির্যাতন করে। জননেতা মণি সিংহের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই ঘটনা অবহিত হয়ে রক্ষীবাহিনীর প্রধান ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামানকে নির্দেশ দেন হাইকে সসম্মানে মুক্তি প্রদানের। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই হাইকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মস্কো প্রেরণ করা হয়। এ মহান বিপ্লবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, কৃষক নেতা মেজর হাই ২০০৭ সালের ১১ মার্চ ৮০ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও এ মহান মুক্তিযোদ্ধার কৃতিত্ব আজও মুক্তিযুদ্ধের এক অজানা অধ্যায়।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

 

 

 

সর্বশেষ খবর