বুধবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র রক্ষা : গণতন্ত্র হত্যা

মাহমুদুর রহমান মান্না

গণতন্ত্র রক্ষা : গণতন্ত্র হত্যা

গণতন্ত্র রক্ষার এমন অভূতপূর্ব নজির পৃথিবীতে সম্ভবত আর কেউ কখনো দেখেনি। স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদের কথা এলেই আমরা হিটলার মুসলিনির কথা বলি। কিন্তু তারাও এভাবে গণতন্ত্র রক্ষার নাম করে স্বেচ্ছাচার চালিয়েছেন বলে জানা যায় না। নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতায় নিশ্চয় তখনকার সঙ্গে এখনকার তুলনা চলে না। এখন তো গণতন্ত্রের যুগ। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। এক নদী রক্ত পাড়ি দিতে হয়েছিল। আজ ৪৩ বছর পরে বাংলাদেশের আপামর জনতার মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এই কি গণতন্ত্র? এই জন্য কি লাখো মানুষ শহীদ হয়েছিল, মা-বোন ইজ্জত দিয়েছিল। শুরু থেকেই ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। এক বছর আগে ৫ জানুয়ারি কি হয়েছিল তা সবার জানা। শত সমালোচনার মুখেও যে অনুগত বুদ্ধিজীবী সরকারের সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, এটা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি, যেহেতু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এতে অংশ নেয়নি। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দশম সংসদের নির্বাচন করতে হচ্ছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনে। এটা নিয়ে এখন আর কথা বলে লাভ নেই। আলোচনা করতে হবে একাদশ সংসদ নিয়ে।

৬৫ বছরের দল আওয়ামী লীগ। কোটি কোটি মানুষ তার সমর্থক। কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন ৫ তারিখ নির্বাচন যে ছিল প্রায় ভোটারবিহীন। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ জন নির্বাচিত বলে ঘোষিত হলো বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়। অতসব জোগাড় যন্ত্র করার পরও ৬০টির মতো কেন্দ্রে কোনো ভোটই পড়ল না। এর পরও এটি একটি যথাযথ নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ও সরকার যথার্থ বলার কি কোনো অবকাশ আছে? অথচ সরকার এখন তাই বলার চেষ্টা করছে। ৫ জানুয়ারির আগে শেখ হাসিনা যে কথা বলেছিলেন (আমি যা উল্লেখ করলাম) তা এখন বেমালুম গিলে খেয়েছেন। সবাই মিলে বলতে শুরু করেছেন পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছি আমরা। পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকব। তার আগে কোনো কথা নয়।

এই কথার মধ্যেই নিহিত আছে অশান্তির বীজ। এমনকি বৈধভাবে নির্বাচিত একটি সরকারেরও বিরোধিতা হয়। সংসদের ভেতরে বাইরে তার পদত্যাগের দাবিও ওঠে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিধান পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই আছে। যারা রাজপথে আন্দোলন করছেন সেই বিএনপি এখন আর সংসদে নেই। সরকারি দল স্নো-পাউডার মাখিয়ে ফিডার খাইয়ে যে বিরোধী দল নামের পুতুল সাজিয়েছে তারা পর্যন্ত সব কিছু দেখে-শুনে 'ক্ষেপিয়া গিয়াছেন'। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তো বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সমালোচনা করেছেন। এখন তদীয় পত্নী সংসদের বিরোধী দলের 'নেতা' বেগম রওশন এরশাদও পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন।

সরকার যে রীতিমতো নার্ভাস এটা এবার স্পষ্টত বোঝা গেল। বড় গলায় কথা বললে যে সেটা সাহসের লক্ষণ তা তো সব সময় নয়। অন্ধকার রাস্তায় পথ চলতে গিয়ে মানুষ যখন গান গায় সেটা তার সংগীত পিপাসা নয়। সাপের ভয় থেকে রক্ষা। এক বছর ধরে সরকার যখন লাগাতার প্রচার চালিয়েছে যে বিএনপি আন্দোলন করতে ব্যর্থ, জনগণ তার সঙ্গে নেই তখন গত বছরের শেষের দিকে বেগম জিয়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় জনসভার কর্মসূচি দিয়েছেন। সবশেষ কর্মসূচি দিয়েছিলেন গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠে। কলেজ কর্তৃপক্ষ বিএনপিকে তাদের কলেজ মাঠে জনসভা করার অনুমতিও দিয়েছিল। তার পরের ঘটনা সবার জানা।

কি হতো বেগম জিয়াকে সেই জনসভা করতে দিলে। সরকার পড়ে যেত। নিশ্চয়ই না। কিন্তু এক বিশাল জনসভা হতো সেখানে। যে রকম কাঁচপুর, নাটোর, কুমিল্লা এবং অন্যান্য জায়গায় হয়েছিল। সরকার বলছে বিএনপির ডাকে মানুষ আসে না। তাহলে জনসভায় আসা এরা কারা? সরকার যে সত্যের অপলাপ করছে এটা খুবই নগ্নভাবে ধরা পড়ে যায় না!

গাজীপুরের ঘটনা বিএনপিকে এ কথা আরও দৃঢ়ভাবে বলার সুযোগ করে দিয়েছে যে, এ সরকারটি অগণতান্ত্রিক। এই পরিস্থিতি সামনে এলো ৫ জানুয়ারি। বিএনপি তো প্রথম থেকেই বলে আসছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অবৈধ। সে কথা তারা বছর ঘুরে আসার পর আবার বলছে। গাজীপুর তো সামনে আছেই। গাজীপুরে তারা পিছু হটেছে। অতএব, ঢাকায় তাদের দৃঢ়তার কথা বলতে হয়েছে। বেগম জিয়া তো রংপুরের জনসভায় গিয়ে বলেই এসেছিলেন, আপনারা (ঢাকার বাইরের সবাই) আপনাদের কাজ করেছেন। এবার রাজধানীর পালা।

কি হতো বেগম জিয়াকে ঢাকায় জনসভা করতে দিলে? প্রথম কথা হলো সরকার বিএনপিকে জনসভা করতে দেবে না কেন? তাদের ঘোষিত জায়গা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তো আপনারা দখল করেই নিয়েছেন? অন্য কোথাও জনসভা করতে দেবেন না কেন? এটা তো সংবিধানে স্বীকৃত অধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন। তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুকে রাজাকার বলেছেন তাই? তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিন। ছাত্রলীগ বলল এই কারণে বিএনপিকে সভা করতে দেবে না আর তাই আইন হয়ে গেল। গণতন্ত্র রক্ষা করার এই একটা তরিকা? তাহলে স্বৈরতন্ত্র কাকে বলে? আওয়ামী লীগ কি বুঝতে অক্ষম যে এতে করে দিন দিন দলটি তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারাচ্ছে।

সর্বোপরি বেগম জিয়াকে তার অফিসে আটকে ফেলা তো রীতিমতো মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের আচরণ কি কেউ কল্পনা করতে পারে? সরকার বলছে নাশকতার মোকাবিলায় এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বেগম জিয়ার নিরাপত্তার জন্য করা হয়েছে এটি।

অদ্ভুত না। নাশকতার আশঙ্কাটি কোথায়? যেহেতু এটি মানে নিরাপত্তার প্রশ্নটি তোলা হয়েছে তাহলে ধরেই নেওয়া যেতে পারে সে জন্য এই হাজার হাজার পুলিশ। তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকার কত চিন্তিত। বোঝা গেল না নাশকতাটি কি বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে হতো নাকি তিনি করতেন সেই নাশকতা? যদি তার উপরে নাশকতা হতে পারে বলে সরকার মনে করত তাহলে তাকে ওই অফিসে আটকে রাখা হলো কেন? আর প্রধানমন্ত্রী কি কারণে বললেন, বেগম জিয়া নাটক করছেন। ইনাকে কেউ আটকে রাখেনি- ইনি চাইলে যেখানে খুশি যেতে পারেন। অথচ পরের দিন দেখা গেল বেগম জিয়া চেষ্টা করলেও অফিস থেকে বের হতে পারলেন না। উল্টো বাইরে থেকে পিপার স্প্রের শিকার হতে হলো তাকে। টেলিভিশনে নিশ্চয়ই দৃশ্যটি দেখেছেন পাঠকরা। মানুষের মধ্যে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আসলে নাটক করল কে? সব মিলে একটি হৃদয়হীন বিয়োগান্তক নাটক মঞ্চস্থ হলো না গত দুই দিনে। শুধু একজন মানুষকে জনগণের কাছে যেতে বাধা দেওয়ার কারণে দেশব্যাপী যে নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি করা হলো তা একটি গণতান্ত্রিক দেশে কল্পনাতীত।

সরকার সম্ভবত মনে করেছিল এভাবে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলা যাবে বিএনপির আন্দোলনের উদ্যোগ। কিন্তু অফিস থেকে বেরুতে ব্যর্থ হওয়ার পরে বেগম জিয়া যে শান্ত-অকম্পিত কণ্ঠে দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছেন তাতে তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপি কি পারবে অনির্দিষ্টকাল এ অবরোধ চালিয়ে যেতে? এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু সরকারের আত্দপ্রসাদ লাভ করার সুযোগ নেই। গত দুই দিন বিএনপির নেতাকর্মীরা আগের তুলনায় মাঠে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছেন। মানুষ সামগ্রিক ঘটনায় সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ। সরকার যা করেছে তাতে মানুষের দুর্ভোগ এত বাড়িয়ে দিয়েছে তা বর্ণনার অতীত।

এ কথা ঠিক, বিএনপি যে আন্দোলন করার চেষ্টা করছে সেটা কেবল একটি নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন এখানে স্পষ্ট নয়। তারপরও সরকারের এখানে জেদ করার কোনো অবকাশ নেই। গণতন্ত্রে এমনিতেও জেদাজেদির কোনো অবকাশ নেই। সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে বিরোধী দলসহ সবার সঙ্গে একটি জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া। পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আগে সরকারের বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর শুভবুদ্ধির উদয় হলেই মঙ্গল। প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে খালেদা জিয়াকে নাশকতা ছেড়ে শান্তির পথে আসার আহ্বান করেছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানাই- আপনি জেদ ছেড়ে শান্তির পথে আসুন।

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর