সোমবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে কেন?

রুহিন হোসেন প্রিন্স

বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে কেন?

জনগণের বিরোধিতার মুখে গত বছরের মার্চে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছিল। তারপরও ক্ষ্যান্ত হয়নি সরকার। আবারও বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে। এ আয়োজনেও সেই পুরনো যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে- বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা না থাকলেও অযৌক্তিক উৎপাদন খরচ দেখিয়ে মূল্য সমন্বয়ের নামে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত রহস্যজনক। মনে হচ্ছে বিদেশি সহায়তা পাওয়া যাবে আর দেশি-বিদেশি লুটেরাদের খুশি করা যাবে এই আশায় দাম বাড়ানোর কসরত চালানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষের পকেট কাটার পুরনো পদ্ধতিই বেছে নিয়েছে সরকার। তাই কোনো যুক্তিতেই এ প্রস্তাব গ্রহণ করা যায় না।

এক. বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বাড়ছে জ্বালানি তেল ব্যবহার ও রেন্টাল, কুইক-রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার জন্য। সম্প্রতি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কয়েক দফা কমেছে। সরকার এ সময়ে ব্যাপক পরিমাণে জ্বালানি তেল মজুদেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিবেচনায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমবে এটাই স্বাভাবিক। আর রেন্টাল ও কুইক-রেন্টাল করা হয়েছে জনমত উপেক্ষা করে কিছু ব্যবসায়ী ও দেশি-বিদেশি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের পকেট ভারী করার জন্য। বিগত দিনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানিতে যুক্তি ও মতামতের ভিত্তিতে সব পক্ষ রেন্টাল ও কুইক-রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর মেয়াদ বাড়ানো বা নবায়ন না করার বিষয়ে একমত পোষণ করে। কমিশনও সে প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারপরও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এমনকি দায়মুক্তি আইনের মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে। সরকারের এ ভুল নীতির দায় জনগণ নিতে পারে না।

বিগত দিনে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর সময় এর উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ বৃদ্ধির বিইআরসিইর যে শর্ত ছিল তাও বাস্তবায়ন হয়নি। প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের কম হয়েছে। এ খাতে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে তথ্যে দেখা যাচ্ছে। এসব বিবেচনায় মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। বরং বিগত দিনে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে বিদ্যুতের দাম কমানোর যে আবেদন করা হয়েছিল, তা নিয়ে গণশুনানি আয়োজনের এখনই সঠিক সময়।

আমরা সবাই এটাও জানি, সরকার বিগত কয়েক বছর আগে থেকে বলে আসছিল ২০১৪ সাল থেকে বিদ্যুতের দাম কমবে। তাই জনমত উপেক্ষা করে এই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব সাধারণ জনগণের পকেট কাটা আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে আত্দসমপর্ণ ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের দেওয়া ঋণের টাকা ছাড় করার জন্য দাম বাড়ানোর চাপ বরাবরই অব্যাহত রেখেছে আইএমএফ। যদিও শর্ত মেনে নেওয়া এই ঋণ দেশের জন্য জরুরি কিছু নয়।

দুই. এখন দেখা যাক, এবার বিদ্যুতের মূল্য বাড়াতে বিভিন্ন সংস্থাগুলো কী প্রস্তাব নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হয়েছে। বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ। আর এই বৃদ্ধি হবেই, এমনটা ধরে নিয়ে খুচরা বিদ্যুতের সরবরাহকারী বিভিন্ন সংস্থা ২২ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।

পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবির) প্রস্তাবিত তথ্যে দেখা যায়, মধ্যবিত্তের ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ২৩ শতাংশ। উচ্চবিত্তের জন্য ১৬ শতাংশ। শিল্পের জন্য ৪০ শতাংশ। গত বছরের মার্চে গণশুনানির মাধ্যমে নিম্নবিত্ত মানুষের ব্যবহৃত ১ থেকে ৫০ ইউনিটকে লাইফ লাইন বিবেচনা করে দাম কম রাখা হয়েছিল। এবার সেই লাইফ-লাইন করা হয়েছে ১ থেকে ৩০ ইউনিট। অর্থাৎ ৩০ ইউনিটের উপরে ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষের জন্য বিদ্যুতের দামও আগের তুলনায় ব্যাপক পরিমাণে বাড়বে। সাধারণভাবে দেখা যায়, প্রতি ইউনিটে ন্যূনতম ১ টাকা ৪০ পয়সা বাড়বে। এর সঙ্গে ভ্যাট তো রয়েছেই। পিডিবি ক্ষুদ্রশিল্পের জন্য বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে ১ টাকা ৫০ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়াও ডেসকো, ডবি্লউজেড ও পিডিসিসহ কয়েকটি সংস্থা সেচের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম ৭০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। সবারই জানা আছে যে, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে প্রতি মাসে গ্রাহকের ব্যয় যেমন বাড়ে, তেমনি সব ধরনের উৎপাদিত পণ্যের খরচ, পরিবহন ব্যয় বাড়ে। এর ফলে দ্রব্যমূল্যও বাড়ে। অর্থাৎ নানাভাবেই জনগণের পকেট থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।

বিইআরসি নামক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে বলে এসেছে যে, তারা ভোক্তা অধিকার রক্ষায় দায়িত্ব পালন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম বিইআরসি সে প্রতিশ্রুতি পালন করছে না। আইন অনুযায়ী বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া বছরে একবারের বেশি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব গ্রহণ না করারই কথা। আইন অনুযায়ী পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরই কেবল বিদ্যুতের খুচরা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়ার কথা। কিন্তু এসব আইন লঙ্ঘন করে গত বছর মার্চে দাম বাড়ানোর ৯ মাসের মাথায় আবারও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এবং পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব একই সঙ্গে গ্রহণ করে আইনের লঙ্ঘন করা হলো। এতে প্রশ্ন উঠেছে, এই প্রতিষ্ঠান কার স্বার্থ রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ?

তিন. দেশের সাধারণ স্বল্প আয়ের মানুষ যখন বছরের শুরুতে বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া, স্কুলভর্তি, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত, তখন বিচারিক আদালতের মতো প্রতিষ্ঠান বিইআরসি একটি কোম্পানি সংস্থার জন্য মাত্র তিন ঘণ্টা করে সময় বরাদ্দ দিয়ে গণশুনানি আয়োজনের খবর পত্রিকায় দিয়েছে। এটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। তিন ঘণ্টায় ভোক্তাদের জন্য যে পর্যাপ্ত সময় বরাদ্দ থাকবে না তা অতীত অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি।

এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাম বাড়ানোর সময় সিস্টেম লস কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে আনার কথা বলা হলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বরং বিদ্যুতের ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়ম-অপচয়ের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। উৎপাদন ব্যয় কমাতে এসব দিকে নজর দেওয়া জরুরি হলেও কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই না।

রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে উৎপাদন ব্যয় এখনো অনেক কম। সামগ্রিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমাতে বন্ধ রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো চালু, রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট আধুনিকায়ন, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বৃহৎ বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ, রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে দেওয়া গ্যাস রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহের কথা অনেক দিন ধরে আমরা বলে আসছি। অথচ সে কথা শোনা হচ্ছে না। শোনা হচ্ছে জনস্বার্থবিরোধী দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কথা। তাই জনগণকে জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।

আর বিইআরসি যদি জনগণের কথা শোনার ন্যূনতম দায়িত্ব পালন করতে চায়, তাহলে অনুরোধ করব- মূল্যহার বাড়ানো নয়, মূল্যহার কমানোর লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে গণশুনানির আয়োজন করুন। জনগণের কথা শুনুন। এর পর জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। তাহলেই কেবল সাধুবাদ জানানো যাবে বিইআরসিকে।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি।

 

 

সর্বশেষ খবর