সোমবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

পাহাড়ি মানুষের নিরাপত্তাহীনতা : রাষ্ট্র কি পারবে তাদের রক্ষা করতে

অজয় রায়, আনিসুর রহমান মল্লিক, মমতাজ লতিফ, রাজীব মীর, রাশেদ রাইন বুলবুল, দীপায়ন খীসা ও রোবায়েত ফেরদৌস

আমরা পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি গত বিজয় দিবস সকালে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের বগাছড়ি-চৌদ্দমাইল এলাকায় তিনটি পাহাড়ি গ্রাম সুরিদাশপাড়া, বগাছড়ি ও নবীন তালুকদারপাড়ায় আদিবাসীদের সাতটি দোকান এবং ৫৪টি বসতবাড়ি জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে, কুপিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও নিঃশেষ করা হয়েছে। এ ধরনের যে কোনো অন্যায় ও অত্যাচারের খবরে সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা প্রায়শ আসল সত্যটা আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানানোর চেষ্টা করি। সে উদ্দেশ্যেই ২৪ ডিসেম্বর তারিখ সকালে শিক্ষক, রাজনীতিক, অ্যাডভোকেট ও সাংবাদিকদের একটি সমন্বিত দল বগাছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কিন্তু রওনা হওয়ার কিছু সময় পরই মানিকছড়ির সাপছড়িতে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ ও সমঅধিকার নামক দুটো সংগঠন প্রতিনিধি দলের পথরোধ করে এবং ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে দেবে না বলে স্লোগান দেয়। অবশেষে পুলিশের সহযোগিতায় ঘটনাস্থলে গেলে দেখা যায়, দুর্বৃত্তরা প্রায় সাড়ে ৯ একর জায়গায় আনারস বাগান কেটে সাফ করেছে। যেহেতু তারা ১৫ ডিসেম্বর রাতে বিজয় দিবস উদযাপনে ব্যস্ত ছিল তাই কে বা কারা এটা করেছে সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নয়। এই জমির মালিক আফসার মাস্টার ও আসাদ বলে তারা দাবি করেছেন এবং এখানে আনারস ও সেগুনের চাষ করেছেন শাজাহান, নূরুল ইসলাম ও কামাল। এই হলো ঘটনার প্রেক্ষাপট। এর পর শুরু হয় সেটলার বাঙালিদের তাণ্ডব, তখন ১৬ ডিসেম্বর সকাল। শুভেন্দুর দোকানটি মোটামুটি বড়। টিন আর সিমেন্ট ছাড়া সব বিক্রি হতো। সেলাই মেশিন, তেল, জুতো, কসমেটিক্স সব পুড়ে ছাই। ক্যাশ লুটসহ এক দোকান থেকেই ২৫ লাখ টাকার সম্পদ বিনাশ। পাশের দোকান থেকে দোকানে আগুন। বাড়িতে বাড়িতে আগুন। একে একে তিন গ্রাম ছাই। আদিবাসীদের অভিযোগ, আক্রমণের আগে তিন রাউন্ড গুলি হয়, তারা ভয়ে পালায় এবং তারপরই চলে অগ্নিসংযোগ ও নারকীয় হামলা। নিরাপত্তা বাহিনীকে পেছনে থাকতে দেখে তারা আরও ভয়ে মুষড়ে যায় এবং পিছু হটে। তারপর অরূপ চাকমার বাড়িসহ অনেকের গোলার ধান, আসবাব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মাথা গোঁজার স্থান নেই, নেই অন্নের সংস্থান। নিরাপত্তার অভাবে বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয় হারিয়ে দৈন্যদশায় উপনীত পাহাড়িদের এ অসহায়ত্ব দেখে আমরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও লজ্জিত।

প্রিয় পাঠক, আপনারা আশ্চর্য হবেন যে, আক্রমণ থেকে বুদ্ধধর্মের পীঠস্থান কিয়াং পর্যন্ত রক্ষা পায়নি, ভিক্ষুকে পর্যন্ত মারধর করা হয়েছে। উবাসা ভিক্ষু ভয়ে পালায়নি, কিন্তু দেবতা বুদ্ধের মূর্তিকে অসম্মানের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি, মূর্তি চুরি হয়েছে, ভূলুুণ্ঠিত করা হয়েছে। আশি বছরের প্রিয়বালার যাওয়ার জায়গা নেই, দেবরের ছেলে অরূপের আশ্রয়ে আছে। এখন তো আশ্রয়দাতারও আশ্রয় নেই। তাহলে সব প্রশ্নের হয়তো জবাব নেই, কিন্তু সমাধান জরুরি। পাহাড়ে এ ঘটনা নতুন নয়। বাঙালি সেটলারদের পাহাড়ি জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। টিকে থাকার সংগ্রামে তারা জায়গা দখল করে, পুনর্দখল ও জবরদখল চালায়। পাহাড়িরাও ভূমি উদ্ধার, জমি দখল ঠেকাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কার জমি কোনটা এ সমস্যার সমাধান থানায় আর হয় না। প্রথাগত আইন অনুসারে, পাহাড়ের জমির মালিক আদিবাসী জনগণ। সেখানকার প্রথাগত আইনে ভূমি ক্রয়-বিক্রয়ে এ মৌজা হেডম্যানের সুপারিশ বাধ্যতামূলক। কিন্তু পুনর্বাসিত বাঙালিরা দখল বা ক্রয়ের ক্ষেত্রে এ নিয়ম মেনে চলে না। জেলা প্রশাসনও এ নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। তাই ভূমি সমস্যার সৃষ্টি হয়, টিকে থাকে, জিইয়ে রাখা হয়। যেসব বাঙালির আনারস বাগান গেছে তারা কোনো মামলা করেনি। কারণ তারা মনে করে এটায় ঝামেলা। পাহাড়িরাও মামলা করেনি। থানায় একটা জিডি হয়েছে মাত্র। প্রশ্ন হলো, মামলা ছাড়া সমাধান কীভাবে সম্ভব? সরকারিভাবেও কোনো মামলা হয়নি। তাহলে প্রশ্ন থাকে, আন্তরিকতার ঘাটতি আসলে কার?

এখন পাহাড়িদের দাবি, আনারস আর সেগুন বাগানের জমি তাদেরই ছিল, বাঙালিরা দেড় বছর আগে দখল করে নিয়েছে। জেলা প্রশাসন উপজেলা চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করেছে, পাহাড়িদের নগদ এক লাখ টাকা, ত্রাণ ও তাঁবু দিয়েছে। কিন্তু জীবনযাপনের স্বাভাবিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। নাগরিক প্রতিনিধি দলের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে বগাছড়ির নিঃস্ব পাহাড়ি মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। রাষ্ট্র কি তাদের এই নিরাপত্তা দিতে পারে না? আমরা বলব, রাষ্ট্র এবং তার প্রশাসন পাহাড়ি জনগণের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হয়েছে। শান্তি চুক্তি অনুসারে ভূমি কমিশন বাস্তবায়ন হয়নি। তাই বাড়ছে দখল, বাড়ছে বিরোধপূর্ণ ভূমির পরিমাণ। হেডম্যানের পূর্বানুমতি ব্যতীত জমি হস্তান্তরের বিধান না থাকা সত্ত্বেও জমি বিকিকিনি হচ্ছে, বাঙালি ভূমির মালিক বাড়ছে। আধিপত্য আর ক্ষমতার খেলাও জমে উঠেছে। চলছে ষড়যন্ত্র আর রাজনীতির নতুন নতুন মারপ্যাঁচ। আদিবাসীরা ক্রমশ ভূমিহারা হচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের মিথ্যে বড়াই দেশের অনন্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সঙ্কুচিত করছে। আদিবাসী তার নাম নিয়েই ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। এভাবে কোনো জনগোষ্ঠীকে ইচ্ছাকৃতভাবে নিঃশেষ করার অধিকার কি আমাদের আছে? পাহাড়জুড়ে এটা চলছে। চলছে নিধন। গত ১৪ ডিসেম্বর কাপ্তাইতে ছবি মার্মা নামের এক অষ্টম শ্রেণির স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছে। সে পাহাড়ের আব্রু আর আমাদের লজ্জাবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, খুন, লুট, উচ্ছেদ যাদের নিত্যসাথী, তারা কীভাবে টিকে থাকবে বলুন! হামলা, অগ্নিসংযোগ আর পরে লোক দেখানো ত্রাণ বিতরণের নাটক কবে অবসান হবে? এ পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটির ফল জানতে পেরেছেন? ১৬৪ ধারায় দুটো বাঙালি ছেলে ছবি মার্মাকে ধর্ষণের পর খুন করার জবানবন্দি দিয়েছে, তাদের আদৌ বিচার হবে? কেন হয় না, কেন হবে না! ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অর্জিত গৌরবকে এভাবে কারা ম্লান করে দেয়? বিজয় দিবসে পাহাড়ি জনগণের বসতভিটা পুড়িয়ে দেওয়ার এই অমানবিক কর্মযজ্ঞ বন্ধ হওয়া খুবই জরুরি। কারণ আমরা দেশের সব জাতিসমূহের সমমর্যাদা ও সমমৌলিক অধিকারে বিশ্বাস করি। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেই, থাকা দরকার, হওয়া উচিত।

নাগরিক প্রতিনিধি দল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু দাবি ও সুপারিশ উত্থাপন করছে :

১. অবিলম্বে বগাছড়ির ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দ্রুত বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। ২. বগাছড়ি-চৌদ্দমাইলের আক্রান্ত পাহাড়ি জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও খাদ্য, আশ্রয় ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে দ্রুত প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হোক। ৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন আইন সংশোধনপূর্বক যথাযথভাবে দ্রুত জাতীয় সংসদে পাস করা হোক এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে ভূমি কমিশনকে কার্যকর করা হোক।

৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সময়সূচিভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হোক। ৫. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে এ বিষয়ে আরও মনোযোগী হয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহ ফিরিয়ে এনে বিদেশেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার কার্যকর প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখকবৃন্দ : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।

 

সর্বশেষ খবর