বুধবার, ৪ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা
শিক্ষাঙ্গন

শিক্ষাক্ষেত্রে আবারও ছন্দপতন!

বিমল সরকার

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গ/পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপিত হলে গোটা পঞ্চাশের দশকজুড়ে এসএসসি (ম্যাট্রিকুলেশন) এবং সমমানের পরীক্ষা গ্রহণ করতে সময় লাগত ১২/১৩ কিংবা বড়জোর ১৫ দিন। এ ছাড়া দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ছিল একটি স্বাভাবিক রেওয়াজ। টানা নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই কিছু অসঙ্গতি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তা সত্ত্বেও শিক্ষা বোর্ডগুলো মাত্র ১৫-১৬ দিনে এসএসসি এবং ২০-২২ দিনে এইচএসসি পরীক্ষা সম্পন্ন করে দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে এসবের ফলাফলও জানিয়ে দিতে পেরেছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর আমলে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল মাত্র ১৫ দিনে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, এমনকি পরবর্তীতে ১৯৮২ সালেও ১৫-১৬ দিনে এসএসসি, ২৫-২৬ দিনে এইচএসসি এবং ৩০-৩২ দিনে ডিগ্রি (পাস ও সাবসিডিয়ারি) পরীক্ষা গ্রহণ এবং দুই কিংবা আড়াই মাসের মধ্যে এসব পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এরশাদের শাসনামলে এসব কিছু একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে।

বেগম খালেদা জিয়ার 'গণতান্ত্রিক সরকার' (১৯৯১-১৯৯৬) এবং শেখ হাসিনার 'ঐকমত্যের সরকারের' (১৯৯৬-২০০১) আমলে দেশে অনেকটা প্রতিযোগিতামূলকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের চিত্রটি যত দৃশ্যমান এর বিপরীতে সেশনজট নিরসন, সময়মতো পরীক্ষা গ্রহণ এবং ফলাফল প্রকাশ, অবাধ নকল বন্ধকরণ এসব ক্ষেত্রে নিছক বাগাড়ম্বর ও অন্তঃসারশূন্যতার চিত্রটিই ফুটে ওঠে।

তবে একুশ শতকের শুরু থেকেই রাজনীতিকদের বোধকরি কিছুটা বোধোদয় ঘটে। সর্বশেষ বিএনপি (২০০১-২০০৬) এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে (২০০৯-২০১৩ ও ২০১৪ - চলমান) শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কিছু ইতিবাচক বিষয় চালু হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় ব্যাপক গণটোকাটুকির বিরুদ্ধে সর্বাত্দক অভিযান এবং এক্ষেত্রে অনেকাংশেই সাফল্য অর্জন, অপেক্ষাকৃত কম সময়ে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া, ৬০ দিনে ফলাফল প্রকাশ করা, স্কুলের সব শিক্ষার্থীর মাঝে নতুন বই বিতরণ ও ১ জানুয়ারি দেশজুড়ে একযোগে ক্লাস শুরু করা, একইভাবে ১ জুলাই থেকে সর্বত্র একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু করা, প্রাথমিক সমাপনী ও ইবতেদায়ী সমাপনী এবং জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা চালুকরণ, বছর বা সেশনের শুরুতে অথবা প্রথমার্ধেই এসব পাবলিক পরীক্ষার তারিখ জানিয়ে দেওয়া, একই সময়ে ও অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া, সর্বোপরি পরীক্ষার হলে ব্যাপক গণটোকাটুকি বন্ধ করার ব্যাপারে তাদের উদ্যম ও কার্যক্রমকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

সবারই মনে থাকার কথা ২০১৩ সালে বিরোধী দলগুলোর ডাকা হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি তথা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে একে একে মোট পাঁচবার পেছাতে হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষে) অনার্স প্রথমবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা। কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছিল অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রমেও।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনার কোনো শেষ নেই। ১৪ দল আগেই ঘোষণা দেয় যে, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি তারা 'গণতন্ত্রের বিজয় দিবস' হিসেবে পালন করবে। ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার, যাতে ভাষণ দেবেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে ২০ দল ঘোষণা দেয়, ৫ জানুয়ারিকে তারা 'গণতন্ত্র হত্যা দিবস' হিসেবে পালন করবে। এ উপলক্ষে নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে ভাষণ দেবেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এ নিয়ে ডিসেম্বর থেকেই উভয় শিবিরে বলতে গেলে একেবারে রণসজ্জা। উপক্রম হয় যে কোনো সময় যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার। হুইসেল বেজে উঠতে না উঠতেই শুরু হয়ে যায় সে দামামা। বিক্ষোভ-অবরোধ। হরতালের পর হরতাল। ককটেল বিস্ফোরণ আর এসিড নিক্ষেপ। সন্ত্রাস-নৈরাজ্য আর নাশকতা। জনজীবনে সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর আতঙ্ক। ইতিমধ্যে গত দেড় মাসে একে একে ঝরে গেছে একশর মতো নিরীহ তাজা প্রাণ। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ-সম্পত্তি বিনষ্ট। আর শিক্ষাক্ষেত্রে?- আবারও ছন্দপতনের শুরু। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ গত বছর ঘোষণা দিয়েছিলেন ভবিষ্যতে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বিভিন্ন স্তরে বিরাজমান দুই বছরের সেশনজট আগামী তিন বছরের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে নিরসনের লক্ষ্য নিয়ে 'ক্রাশ-প্রোগ্রাম'-এর আওতায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু মূলত ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে বীভৎস প্রতিযোগিতা চলছে তা আরও কিছু দিন অব্যাহত থাকলে শিক্ষাক্ষেত্রে আবারও ছন্দপতন অবশ্যম্ভাবী। চলমান এসএসসি পরীক্ষাটির দিকে খেয়াল করলেই এ বিষয়ে কিছুটা আন্দাজ করা যাবে। এটা ২০১৫ সাল। ২০১৩ সালের ডিগ্রি (পাস) পরীক্ষা কবে নাগাদ শুরু হবে আনুমানিক সাত লাখ পরীক্ষার্থী ও তাদের উদ্বেগাকুল অভিভাবকদের আজও তা অজানা। আগামী ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু নিয়েও সংশ্লিষ্ট সবার মাঝে ইতিমধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং দুর্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ১৫/০২/২০১৫

লেখক : কলেজ শিক্ষক।

সর্বশেষ খবর