বুধবার, ৬ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
দর্শন

আমরা আবার চেষ্টা করে দেখতে পারি

আবু মহি মুসা

আমরা আবার চেষ্টা করে দেখতে পারি

দর্শনগত মূল্যায়নে পৃথিবীর প্রায় শতভাগ মানুষ বুদ্ধিমান, যাদের জ্ঞান চারটি। যেমন, অভ্যন্তরীণ জ্ঞান, অতি সাধারণ জ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান এবং বুদ্ধি। আমরা বুদ্ধিমান। এমন মানুষের সংখ্যা ৯৯.৯৯ ভাগ। দর্শন বলছে, আমাদের চারটি জ্ঞানের মধ্য থেকে একটি মাইনাস। হাঁস-মুরগি, পশু-পাখির জ্ঞান যেমন তিনটি। আমাদের জ্ঞানও তেমনি তিনটি। ওরা যতটুকু চিন্তা করতে পারে ওদের চেয়ে একটুও বেশি চিন্তা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এই তিনটি জ্ঞান থেকে, দর্শন বলছে, আরও একটি মাইনাস। অর্থাৎ আমাদের জ্ঞান হচ্ছে দুটি। এ দুটো মৌলিক জ্ঞান। এ দুটো জ্ঞানের মধ্যে মানুষ জন্মে একটি মাত্র জ্ঞান নিয়ে, (খাদ্যের জ্ঞান) এবং যে প্রাণীর মধ্যে তিনটি জ্ঞান, মাতৃগর্ভ থেকে তিনটি জ্ঞান নিয়ে জন্মে। যার মধ্যে চারটি জ্ঞান মাতৃগর্ভ থেকে চারটি জ্ঞান নিয়ে জন্মে। এবার প্রশ্ন কে শ্রেষ্ঠ? মানুষ, না ওরা? অনেকে হয়তো বলবেন, সে হিসেবে ওরা শ্রেষ্ঠ। তাহলে কেন বলা হয়েছে, মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব? এর মূল রহস্য এখানে।

গত বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় ৩২টি দল অংশগ্রহণ করেছে। ৩২টি দলের মধ্যে একটি দল ছিল শ্রেষ্ঠ, যে দলটি কাপ জিতে নিয়েছে। সে দলটি হচ্ছে জার্মান। এই শ্রেষ্ঠ দলটির মধ্যে একজন বেস্ট প্লেয়ার এবং এর সঙ্গে আরও ৬ জন সেমিবেস্ট প্লেয়ার ছিল। এ ৭ জন প্লেয়ারকে মাঠের বাইরে রেখে জার্মানির দলটি যদি ফুটবল খেলত তবে কি তারা কাপ জিততে পারত? অবশ্যই না। ঠিক তেমনি মানুষ শ্রেষ্ঠ। এই মানুষের মধ্যে এরকম ৭ জন শ্রেষ্ঠ মানব রয়েছেন। যেমন, ধর্মপ্রবর্তক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, লৌহমানব, অলি আল্লাহ, জ্ঞানী এবং লেখক। যাদের আবির্ভাব না ঘটলে আমরা আজও উলঙ্গ অবস্থায় বনে-জঙ্গলে জীবন যাপন করতাম। আফ্রিকার জঙ্গলে যে জনগোষ্ঠী বাস করে তাদের মধ্যে কোনো মহাজ্ঞানী আসেননি। তারা আজও সভ্যতা বিবর্জিত অবস্থায় জীবন যাপন করছে। মনীষীদের বাইরে ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সূরা তিন-এর একটি আয়াতে বলা হয়েছে, 'সুম্মা রাদাদ না হুম আসফালাস সাফেলিন।' অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে, 'বাল হুম আদাল।' অর্থাৎ সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্ট হচ্ছে মানুষ। যাদের জ্ঞান হাঁস-মুরগি, ছাগল, ভেড়ার জ্ঞানের চেয়েও কম। যার প্রমাণ দিয়েছি বিশ্বজিতের ক্ষেত্রে। প্রমাণ দিয়েছি হরতাল চলাকালে বাসে আগুন ধরিয়ে মানুষ হত্যা করে। যিনি পুঁথিগত বিদ্যার্জন করে এমএ পাস করলেন, তাকেও কিন্তু জ্ঞানী বলা যাবে না। এটা তার নিজস্ব জ্ঞান নয়। এটাকে বলা হয় অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। এ জ্ঞান দিয়ে দেশ চালানো যায় না। বলা হয়েছে, বিমান চলে ফুয়েলে, দেশ চলে জ্ঞানে। এমনকি ১০০ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়েও দেশ চালানো যাবে না, যদি জ্ঞান না থাকে। দেশ চালানো যে যায় না তার আর একটি প্রমাণ এখানে। বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ। এদেশের একটি রাজকীয় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পার্লামেন্ট। যেখানে প্রতি মিনিট খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা। এই ৩০ হাজার টাকা খরচ করে আমরা আইন প্রণয়ন করব। তা না করে, কার কবরে লাশ নেই, পা নেই, মাথা নেই, এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে ১২টি ঘণ্টা নষ্ট করলাম, ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এরকম শত শত কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে শুধু জ্ঞানের অভাবে। জ্ঞানের অভাব থাকলে তার মধ্যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দেশপ্রেম থাকতে পারে না। ফলে বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি যা দেখছি, ভবিষ্যতে তার চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ কিছু দেখতে পাবো। এমন একটি পর্যায়ে আমরা পৌঁছে যেতে পারি, যেখানে আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এর সব কিছুর মূলে আমি জ্ঞানকে দায়ী করব। আমাদের মধ্য থেকে কিন্তু জ্ঞানের লেভেল ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। যে কারণে মানবিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। একজন জ্ঞানী কখনই অনৈতিক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারেন না। মাছে ফরমালিন দিতে পারেন না। কাজেই আমাদের অস্তিত্বকে রক্ষার জন্য জ্ঞান বৃদ্ধির প্রয়োজন। ওই জ্ঞান, যে জ্ঞান মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে। ভালোবাসার উপদানগুলো সতেজ করে। আমরা যে পর্যায়ে পৌঁছে গেছি, এ জন্য শুরু করতে হবে প্রাথমিক পর্যায় থেকে। আমি মনে করি, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয়, তা হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ কীভাবে সৃষ্টি করা যায়। একই সঙ্গে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনামূলক পাঠ্যপুস্তক থাকতে হবে। আমরা যখন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র, শিক্ষক জিজ্ঞেস করতেন স্কুলে আসার সময়ে মা-বাবাকে সালাম করে এসেছ কিনা? এখন কি এসব সংস্কৃতি চালু আছে?

সুশিক্ষার অভাব আমাদের কোথায় নিয়ে গেছে একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোধগম্য হতে পারে। বর্তমান সময়ে বোধ করি এমন অভিজ্ঞতা সবারই আছে, বিশেষ করে যারা বাসে যাতায়াত করেন। বাসে একটি সিট খালি হচ্ছে। সিট খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো কথা নেই, কোনো ভদ্রতা নেই, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র আমার মতো বয়স্ক লোককে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে সিটে বসে পড়ে। এ থেকে বুঝতে হবে, ভদ্রতা, নম্রতা, মানবিক মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখাপড়া করে কী শিখল? এরপর ওই ছাত্রটিকে যখন বলি, জ্ঞানের লেভেল যদি পশুর চেয়েও কম হয়, তাদের কাছে আর কী আশা করা যায়? জ্ঞান সম্পর্কে একটি বক্তৃতা দেই সবাইকে শুনিয়ে। আমার কথা শুনে ওই ছাত্রটি লজ্জিত হয়, দুঃখ প্রকাশ করে সিটটা ছেড়ে বিনয়ের সঙ্গে বসতে অনুরোধ করে। আমি মনে করি, কিছুটা হলেও তার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পেরেছি। মানবিক মূল্যবোধের অঙ্কুর শেষ হয়ে যায়নি। ওরা আমাদের কথা বুঝতে পারবে, ওরা আমাদের আহ্বানে সারা দেবে, সে বিশ্বাস আমার আছে। জ্ঞান সমুদ্রে চর পড়েছে। ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন। এ জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে আমরা পারব এ অবক্ষয় রোধ করতে।

লেখক : দার্শনিক।

ই-মেইল : [email protected]

 

সর্বশেষ খবর