মঙ্গলবার, ২ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা

উচ্চশিক্ষা : ভর্তি বিড়ম্বনা

বিমল সরকার

ভর্তি নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার যেন কোনো শেষ নেই। একইসঙ্গে রয়েছে দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির বিষয়টিও। ভালো মানের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষাকে আজকাল হরহামেশা ভর্তিযুদ্ধ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। অবশ্য এর পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। ভর্তির আবেদন করা থেকে শুরু করে পরীক্ষা দিয়ে ঘরে ফেরা পর্যন্ত কী লড়াটাই না লড়তে হয় একেকজন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীকে। এছাড়া ওদের সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদের লড়াটাকেইবা খাটো করে দেখার অবকাশ কোথায়। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ফল প্রকাশ হতে না হতেই শিক্ষার্থীদের মাঝে এই ভর্তিযুদ্ধের বিষয়টি ব্যাপকভাবে ঘুরপাক খেতে শুরু করে। উচ্চশিক্ষা স্তর বা পছন্দ অনুযায়ী কোনো প্রফেশনাল কোর্সে ভর্তির জন্য কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অভিভাবকদেরও দু'চারটি মাস হন্যে হয়ে ছোটাছুটি করতে হয় দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ২০১৪ সালে ১০টি বোর্ডে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১১ লাখ ৩০ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে মোট আট লাখ ৮৫ হাজার। তাদের মধ্যে কেবল জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। স্বাভাবিকভাবে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই লক্ষ্য থাকে ভালো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। কিন্তু দেশে ভালোমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এগুলোতে আসনসংখ্যা সীমিত থাকায় অনেকের কাছেই ভর্তিযুদ্ধটি সামরিক যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নেয়। সর্বস্তরে সর্বাত্মকভাবে লড়েও কয়েক লাখ শিক্ষার্থীকে শেষ পর্যন্ত বিফল মনোরথ হয়ে সাধারণ কোনো প্রতিষ্ঠানেই ভর্তি হতে হয়েছে বা হচ্ছে।

এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা পাস করার পর উচ্চতর স্তরে ভর্তি নিয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের প্রস্তুতি-চেষ্টা এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার যেন কোনো সীমা-পরিসীমাই নেই। দেশে বর্তমানে ৩৬টি সরকারি এবং ৮০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সরকারি মেডিকেল কলেজ ২২টি আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৫৩টি। সরকারি ডেন্টাল কলেজ একটি ও ডেন্টাল ইউনিট নয়টি। বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ আছে ১২টি। রয়েছে ১৬টি ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি। এছাড়াও আছে কলেজ অব লেদার টেকনোলজি ও কলেজ অব টেঙ্টাইল টেকনোলজিসহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে সব সময়ই ভর্তির চাপ থাকে বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি পছন্দের প্রতিষ্ঠানগুলো- বিশেষ করে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, বুয়েট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের একেকটি আসনকে সবাই একেবারে সোনার হরিণ বলে জ্ঞান করে থাকেন। কি শিক্ষার্থী, কি অভিভাবকদের; যত সব স্বপ্ন, যত সব প্রতিযোগিতা মূলত এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরেই।

আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে, বিশেষ করে বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরবরাহকৃত ফরম পূরণ করে ভর্তির জন্য আবেদন করতে হতো। এখন কেবল আবেদন নয়, গোটা ভর্তি প্রক্রিয়াটিই সম্পন্ন করা হয় অনলাইনের মাধ্যমে। ভর্তি ফরমের দাম নির্ধারণ কিংবা ভর্তি পরীক্ষা বাবদ নির্ধারিত টাকা আদায়কে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত অনেক অবাঞ্ছিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এ নিয়ে আন্দোলন, বাদানুবাদ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, অবরোধ-মারামারি, কাঁদানে গ্যাস ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ অনেক কিছুই হয়েছে উচ্চশিক্ষাদানকারী একেকটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বছরের পর বছর বলতে গেলে পৌনঃপুনিকভাবে চলেছে এসব। লক্ষ্য করার বিষয় যে, মৌসুমটি এলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি ফরমের দাম বাড়িয়ে দেয়। ভর্তি ফরমের দাম শতকরা ১০ ভাগ, ২০ ভাগ, ৩০, এমনকি অবলীলায় ৫০ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে দেখা দেয় নানা ধরনের অসন্তোষ ও ক্ষোভ। অতঃপর শুরু হয় আন্দোলন। ভর্তি ফরমের মূল্য কমানোর আন্দোলন এবং ওই আন্দোলন দমন করতে সময় সময় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কত ধরনের বিপত্তিরই না সৃষ্টি হয়েছে। আবার অনেক সময়ই আন্দোলনের মুখে কর্তৃপক্ষকে বর্ধিত মূল্যের পুরোটাই প্রত্যাহার কিংবা আংশিক হলেও কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা ইনস্টিটিউশন সব মিলিয়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এগুলোতে আসন সংখ্যা শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুপাতে না হলেও একেবারে কম নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা বলে কোনো লাভ নেই। কারণ এগুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই রয়েছে নানা প্রশ্ন এবং একেকটি প্রতিষ্ঠান গড়েই উঠেছে বাণিজ্যিক মনোভাব নিয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একেকটিতে চারটি, ছয়টি, আটটি, এমনকি এর চেয়েও বেশিসংখ্যক অনুষদ রয়েছে। সব মিলিয়ে বিভাগ রয়েছে ২০, ৩০, ৪০, ৫০ কিংবা এরও বেশি করে। একজন শিক্ষার্থীর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ইউনিট বা বিভাগে আবেদন করার সুযোগ থাকে এবং তারা পুরো সুযোগটিই গ্রহণ করতে চায়। প্রথম পছন্দ ও শেষ পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিট বা বিভাগ এভাবে তাকে অনেকগুলো আবেদনই করতে হয়। প্রতিটি আবেদনের সঙ্গে ৩০০, ৪০০, এমনকি ৮০০ বা এক হাজার টাকা করে ফিস জমা দিলে একেকজন আবেদনকারীর মোট টাকার অঙ্কটি কী দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমেয়। এইচএসসি পরীক্ষার পর কোচিং সেন্টারে ভর্তি, তিন/চার মাসের থাকা-খাওয়া এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক পৃথক ইউনিট ও বিভাগে ভর্তির আবেদন এবং পরীক্ষা বাবদ একেকজনের পকেট থেকে ৫০-৬০ হাজার, এমনকি এরও বেশি পরিমাণ টাকা অবলীলায় খরচ হয়ে যায়। ভর্তির মৌসুমে লাখ লাখ তো বটেই, এমনকি কোটিরও বেশি টাকা আদায় হয় কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। আদায়কৃত ওই টাকা খরচ বা নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করতে গিয়ে অনেক সময়ই দেখা দেয় নানা ধরনের বিপত্তি। ভর্তি ফরম বিক্রি করে কিংবা ভর্তি পরীক্ষা বাবদ আদায় করা কোটি কোটি টাকা শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে নানা দেনদরবার, অভিযোগ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও হতাশার বিষয় অনেকবার পত্রপত্রিকার খবর হয়েছে। শুনেছি আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন ফরমের জন্য কোনো টাকা দিতে হতো না। মাত্র এক টাকা দিয়ে ফরম কিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য আবেদন করা গেছে। আমাদের সময় (১৯৭৭-৭৮) প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরী (প্রয়াত) উপাচার্য থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি ফরম ও পরীক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় খরচ বাবদ ফিস ধার্য করা হয় মাত্র তিন টাকা। দেশের অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়েও (রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, বাংলাদেশ প্রকৌশল এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) তখন ভর্তি বাবদ বলতে গেলে এমন পরিমাণ টাকাই আদায় করা হতো। কিন্তু গত তিন-সাড়ে তিন দশকে কখনো গাণিতিক আবার কখনো জ্যামিতিক হারে বাড়তে বাড়তে ধার্যকৃত ভর্তি ফিসের টাকার অঙ্কটি কোথায় গিয়ে উঠেছে তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তিচ্ছু পাঁচ-সাত লাখ শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরাই ভালো বলতে পারবেন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাজিতপুর কলেজ, কিশোরগঞ্জ।

 

সর্বশেষ খবর