সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভাষান্তরের রকমসকম

আবু তাহের

ভাষান্তরের রকমসকম

লেনদেন ভালো যার, সর্বত্র কদর তার। যারা এই গুণে গুণী ব্যাংকাররা তাদের খুব পছন্দ করেন শুনেছি। দোকানিরা পারলে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে যাচাই করতে চান- 'বাকিতে যারে মাল দেব তার 'দেন' নিখুঁত হবে তো!' বাড়িঅলারা এই প্রক্রিয়ায় আগের দিনে বলতেন 'মাসের প্রথম সপ্তাহে ভাড়া দিতেই হবে।' আজকাল সিস্টেম অনেক পাকা। মিনিমাম তিন মাসের অ্যাডভান্স দাও। প্রজা হওয়ার পর চলতি মাসের ভাড়া চলতি মাসের তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে শোধ কর।

তবে ব্যতিক্রমও আছে। এক বাড়িঅলা আমার পেশা জেনে নিয়ে বললেন, 'স্যরি, গতকাল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।' তাহলে 'টু-লেট' ঝুলছে কেন? ষাঁড়ের মতো দেহবিশিষ্ট বাড়িঅলা বলেন, 'তাইলে সাফ কথা কই। সাংবাদিক, পুলিশ আর উকিল- এই তিন কিসিমের মানুষরে বাড়ি দিই না।' কেন? তাদের দোষ কী? তিনি বলেন, 'কোনো দোষ নাই। তানগো লেনদেন খুব ভালা। লেনদেন ভালা এমতো ভাড়াইট্টা আমার পছন্দ না।'

আমার সখা হেলালউদ্দিন মুহাম্মদ বদরুল ইসলাম ছিলেন আমার সঙ্গে। বললেন 'ভালো লেনদেন ডিজলাইক করেন! আশ্চর্য!' বাড়িঅলা বলেন, 'ট্রানস্লেশন জানেন না। জানলে আচাইজ্জ হইতেন না।' ট্রানস্লেশন মানে অনুবাদ করে নিতে কষ্ট হয়নি। 'লেনদেন খুব ভালা' ইজ ইকুয়াল টু 'লেনদেন খুব খারাপ।' বাংলার অনুবাদ বাংলায় করে নিলে ব্যবহারিক জীবন মসৃণ হওয়ার সম্ভাবনা। কোনো কোনো সময় এ ধরনের অনুবাদ আমোদজনক।

আমাদের এলাকার সুলতানউদ্দিন মোক্তার ছিলেন অকৃপণ অতিথিসেবক। গ্রাম থেকে শহরে আসা লোকজন তার বৈঠকখানায় খায়-ঘুমায়, কাজকাম সেরে বাড়ি যায়, আবার আসে খায়-ঘুমায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ গৃহস্বামীর কাছ থেকে পকেট খরচও নেয়। মাগনায় খাওয়ার এবং মাগনায় খাওয়ানোরও সীমা আছে। পরিমাণ বৃদ্ধি মান হ্রাস ঘটায়। প্রতিদিন গড়ে পাঁচজন মেহমান আসে। কোনো কোনো দিন এক এক করে দশজনও হয়ে যায়। যেদিন এমন হয়, সুলতানউদ্দিন গোলাপ ফুলের আশ্রয় নিয়ে অবস্থা সামাল দেন। ছ'নম্বর অতিথির উপস্থিতি ঘটতেই তিনি বৈঠকখানা থেকে হাঁক দিয়ে ভিতর বাড়ির উদ্দেশে বলেন, 'মোবারক! টবের গোলাপে একটু পানি দে রে বাপ।'

মোবারক আলীর বয়স ত্রিশ। ষোল বছর বয়সে সে মোক্তার বাড়িতে রাঁধুনি হয়ে এসেছে। আজও টিকে আছে। গৃহস্বামীর হুকুম পেয়েই টবের গাছে ফোটা গোলাপে একটু পানি দিয়ে রান্নাঘর থেকে ঈষৎ উচ্চৈঃস্বরে বলে, 'দিছি নানাজান'। সপ্তম অষ্টম নবম দশম অতিথি পর্যন্ত এভাবে 'দে রে বাপ' আর 'দিছি নানাজান' চলে। 'পাতিলের ফুটন্ত ডালে এক পেয়ালা পানি দেওয়া'কে বাংলায় বলা হয় 'টবের গাছে ফোটা গোলাপে একটু পানি দিয়েছি।'

অনুবাদের কারবার করে যারা খায় আমি তাদের দলে ঢুকেছি বহুদিন আগে। কিন্তু তারও আগে অনুবাদ দেখেছি। পাকিস্তান আমলে ঢাকা নগরীর বাসে ভ্রমণ করছি। বাসটি আউটার সার্কুলার রোড ধরে মালিবাগমুখো হয়ে অনির্ধারিত জায়গায় থামিয়ে যাত্রী তুলছিল। কন্ডাক্টর হঠাৎ বলল, 'ওস্তাদ! মামা আ রাহা হ্যায়।' ওস্তাদ যে ড্রাইভার তা বুঝলাম। মামা কে? অনুবাদ করে পাওয়া গেল 'ট্রাফিক পুলিশ'। হুঁশিয়ারির জবাবে ড্রাইভার বলল, 'ঘাবড়াও মাত্। মামা কো দো লাড্ডু দে দো।' 'দো লাড্ডু' মানে দু'টাকা। বাসের কিশোর বয়সী হেলপারের হাতে লাড্ডু দুটি দেয় কন্ডাক্টর। হেলপার ছুটে গিয়ে পৌঁছে দেয় মামাকে। প্রকাশ্য দিবালোকে এতগুলো যাত্রীর চোখের সামনে বুক পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তাতে লাড্ডু দুটি ঢুকিয়ে ফেলে ওই বেশরম মামা।

অনুবাদবিষয়ক জটিলতার একটি ঘটনা আমরা শুনেছি কমেডিয়ান কাজলের মুখে। চার বছর বয়সী ছেলেকে কোলে বসিয়ে সিনেমা দেখছেন মা। দারুণ ফিল্ম। খোলা জিপে নায়ক রাজেশ খান্না ছুটছেন আর গাইছেন 'মেরে স্বপ্নে কি রানী তু কব আয়েগি'। রাস্তার পাশ ঘেঁষে রেললাইন। লাইনের ছুটন্ত ট্রেনের জানালায় বসে নায়কের দিকে নায়িকা শর্মিলা ঠাকুরের মুগ্ধ দৃষ্টি। ঠিক ওই সময় 'মা, গান গাইব।' বলল ছেলেটি। 'এখন না বাবা। একটু পরে' বলেন মা। ছেলে বলে 'না, এখনই গাইব।' ছেলে যতবার বলে 'এখনই' ততবারই মা বলেন, 'এখন না, পরে।' তাদের পিছনের আসনের দর্শক ভদ্রলোক বলেন, 'বাহ, কী সুন্দর। এইটুকু ছেলে গান গাইতে চাইছে। গাইতে দিন না আপা।' এ কথা শুনে ছেলেটা কাঁদতে শুরু করে, 'আমি গাইব এখনই গাইব।' মা ধমক দেন, 'চুপ!' ছেলে আর শব্দ করে না। পর্দার গান সাঙ্গ হলে দর্শক ভদ্রলোক বলেন, 'এবার গাও খোকা। গাও।' ছেলেটি বলে, 'গেয়ে ফেলেছি তো!'

'গেয়ে ফেলেছি'র অনুবাদ 'মায়ের কোলে হিসি করে দিয়েছি।' ছেলেটিকে মা শিখিয়েছিলেন, লোকজনের সামনে 'মা হিসি করব' বলাটা বিশ্রী ব্যাপার। পেশাব পেলে বলবে 'গান গাইব।' এই বন্দোবস্তি দর্শক ভদ্রলোকের জানার কথা নয়। তাই তিনি বললেন, 'গেয়েছো? কই, কেউই তো শুনল না।'

যারা বলেন, অনুবাদ বা ভাষান্তর হচ্ছে কমলালেবুর বদলে ভিটামিন 'সি' খাওয়ার মতো, তারা যে বেঠিক বলেন, তা প্রমাণ করার জন্য ভালো লেনদেন, টবের গোলাপ আর গান গাওয়ার কেচ্ছা তুলে ধরব যতবার প্ল্যান করি, ততবারই রুশ নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের কথা মনে পড়ে। ক্রুশ্চেভ কূটনৈতিক শিষ্টতার ধার ধারতেন না। যা ভাবতেন ঠুসঠাস বলে ফেলতেন। পাশ্চাত্যের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তার মুখনিঃসৃত কঠোর বুলিগুলো কোমল মধুর করে উপস্থাপন করতেন দোভাষীরা।

কথিত আছে, ক্রুশ্চেভ এক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে বলেছিলেন, তোমার ফিগার ম্যানার্স এত চমৎকার। তুমি যে ইবলিসদের নেতা একটুও বুঝবার উপায় নেই। দোভাষী ইংরেজি অনুবাদ করল, 'কমরেড বলছেন, তোমার চেহারা, তোমার ব্যবহার খুবই মনোহর। কোনো ইবলিস তোমার ছায়া মাড়াতেও সাহস পাবে না।'

দক্ষ দোভাষী নাকি উপাদেয়। হতেও পারে। তবে কবি সাইয়িদ আতিকুল্লাহ জানিয়েছেন, দক্ষতার সঙ্গে আহাম্মকির সংযোগ ঘটার ঝুঁকি থাকে। যেমন? কবি শোনালেন ডরোথি কাহিনী। ব্রিটিশ ব্যবসায়ী এডমন্ড বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে ফরাসি তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন। তার একান্ত সচিব ডরোথি ফরাসি ভাষায় সেমিপণ্ডিত। এডমন্ডের ডিক্টেশনে তার জবানিতে ফরাসি তরুণীর উদ্দেশ্যে একটা চিঠির খসড়া বানায় ডরোথি। খসড়াটির ইংরেজি অনুবাদ পড়ে ব্যবসায়ী স্তম্ভিত। এডমন্ড বলেন, 'তুমি তো গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলোই লিখলে না।' ডরোথি জানতে চায়, কোন্ কথা। এডমন্ড বলেন, 'ওগো আমার নয়ন তারা। তোমার খিলখিল হাসি যেন ঝরনা ধারার স্নিগ্ধ ধ্বনি। শয়নে স্বপনে নিশি জাগরণে শুধু তোমারেই দেখি...।'

'স্যরি, স্যার!' বলে ডরোথি, 'এত আবেগ দিয়ে বলেছিলেন আপনি! আমার মনে হয়েছে, কথাগুলো দূরের কাউকে নয়, আমাকেই বলছেন। সে জন্য চিঠিতে এসব বাদ দিয়েছি।'

ওমর খৈয়ামের 'রুবাইয়াৎ' জগদ্বিখ্যাত। এর ইংরেজি অনুবাদ অনেকেই করেছেন। এ ক্ষেত্রে সেরা এডোয়ার্ড ফিটজেরাল্ড। পণ্ডিতদের কেউ কেউ সন্দেহ করলেন, ফিটজেরাল্ড মূল ফারসির বৈশিষ্ট্য অবিকৃত রেখেছেন কিনা। বিকৃত না করে এত চমৎকার অনুবাদ কীভাবে সম্ভব? এ বিষয়ে অভিমত জানতে চাওয়া হলে ভারতীয় কবি সমর সেন বললেন : অনুবাদ হচ্ছে নারীর মতো। সত্য হলে সৌন্দর্য থাকে না। সুন্দর হলে সত্য থাকে না।

চিন্তা অনুবাদ করেছিলেন আমাদের বন্ধু হেমায়েত। (এটা বানোয়াট নাম। প্রকৃত নাম প্রকাশ করলে দৈহিক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা আছে)। হেমায়েত ১৯৭৩ সালে আইন পড়তেন; তার বড় ভাই ব্যবসায়ী রাকায়েতের সঙ্গে থাকতেন। রাকায়েত কানাডা থেকে পাইপলাইনের সেফটি বাল্ব আমদানি করে তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে সাপ্লাই করতেন। কানাডীয় কোম্পানির কর্তা রডরিগজ এলেন ঢাকায়, উঠেছেন ইন্টারকন হোটেলে। তার সঙ্গে চটাং চটাং ইংরেজি বলেন হেমায়েত। এক রবিবারে রডরিগজকে দুপুরের আহার গ্রহণের দাওয়াত দিলেন হেমায়েত।

রাকায়েতের বাড়িতে সবাই করছে মেহমানের জন্য অপেক্ষা। বিকাল ৩টা বাজে বাজে অবস্থা। রাকায়েত ফোন করতেই রডরিগজ বলেন, 'তোমার ভাই কোথায়? ওর জন্য অপেক্ষা করছি। এখনো খাইনি।' রাকায়েত বুঝলেন, সমস্যা তার ছোট ভাইটির চিন্তা-অনুবাদে। হেমায়েত চিন্তা করেছেন, বলবেন, 'তুমি রবিবার দুপুরে আমাদের এখানে খেলে সুখী হব।' কিন্তু ইংরেজিতে যা বললেন তা দাঁড়িয়েছিল 'রবিবার তোমার ওখানে যদি খাওয়াও খুবই খুশি হব।'

জাপানের খদ্দেরের সুবিধার্থে বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ডে জাপানি ভাষার সঙ্গে ইংরেজিও থাকে। ফার বিক্রি হয় এমন দোকানে লেখা 'উই মেক ফার আউট অব ইয়োর স্কিন'। চুল কর্তনের নাপিত দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা- 'হেড কাটার্স শপ'। ডিম বিক্রেতার সাইনবোর্ডে 'ডিম' বোঝানোর জন্য লেখা- 'এক্সট্রাক্ট ফ্রম ফাউল।' ভ্রমণকাহিনী পাঠের সময় ভুল ইংরেজির এই বিশুদ্ধ সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। তবে মনে হয়, গরু সম্পর্কীয় অনুবাদটিকে কারও পক্ষে অতিক্রম করা অসম্ভব।

ভারতে এক ব্যক্তিকে 'রিয়ারিং এ কাউ ইজ বোথ য়্যান আর্ট অ্যান্ড সায়েন্স'- এই বাক্যের হিন্দি করতে বলা হয়েছিল। লোকটি হিন্দি করল 'গাই কা পিছ্লা হিসসা কলা আওর বিজ্ঞান দোনো হ্যায়।' অর্থাৎ- 'গাভীর পেছনের অংশ শিল্পকলা ও বিজ্ঞান দুটোই।'

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

সর্বশেষ খবর