সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা
প্রসঙ্গক্রমে

ট্র্যাজেডির চেয়েও বেশি কিছু

মোশাররফ হোসেন মুসা

ট্র্যাজেডির চেয়েও বেশি কিছু

মানুষ সংবেদনশীল প্রাণী হওয়ায় সে অতিমাত্রায় দুঃখজনক ঘটনা সহ্য করতে পারে না। সিলেটের হৃদয়বিদারক ঘটনাটি তেমনি একটি উদাহরণ। গত ৮ জুলাই সিলেট শহরতলির কুমারগাঁও এলাকায় চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কতিপয় পাষণ্ড নির্মম ও পৈশাচিক কায়দায় সামিউল আলম (রাজন) নামের একজন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করে। হত্যাকারীদের কোনো একজন ঘটনাটি মোবাইল ফোনে ধারণ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। তিন-চার দিন পর বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ঘটনাটি প্রচার হলে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দেশে প্রতিদিন বহু মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ইদানীংকালের কোনো ঘটনাই রাজনের মতো আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। অর্থাৎ রাজনের ঘটনাটি মানুষের মনে জটিল ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হওয়ায় মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। ট্র্যাজেডি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ 'ট্রাগোজ' অর্থ 'ছাগ' এবং 'ওড' অর্থ গাঁথা থেকে। ছাগলের পোশাক পরে দেবতা ডিওনিসুসের জীবনের করুণ কাহিনীর বর্ণনাই ছিল ট্র্যাজেডির উপজীব্য। পরবর্তীতে ক্ষমতাবান মানুষের জীবনের করুণ ও অসহায় অবস্থার নাট্যরূপই হয়ে পড়ে গ্রিক নাটকের মূল উদ্দেশ্য। অ্যারিস্টটলের মতে- 'জীবনের গরুগম্ভীর বেদনার অনুকরণই ট্র্যাজেডি। নাটকে এমন ব্যক্তির পতন ঘটবে, যার পতনে পাঠকচিত্ত ব্যথিত হবে এবং ব্যক্তির পতনকে পাঠক-শ্রোতা সহজে মেনে নিতে পারবে না। তাদের মনে করুণা, ভীতি ও অনুশোচনা জাগ্রত হবে।' গ্রিক সমাজে সাধারণ মানুষের মৃত্যু নিয়ে কোনো ট্র্যাজেডিমূলক নাটক রচিত হতো না। তাদের বড়জোড় কমেডি চরিত্রে দেখানো হতো। সেসময় রাজা ও সামন্তপ্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্রীতদাসরা মল্লভূমিতে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হতো। তাদের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে শাসক ও সাধারণ দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়ত। আধুনিক ইংরেজ নাট্যকার শেকসপিয়রের নাটকেও শাসক ও অভিজাত শ্রেণির পতন নিয়ে ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের ওরকম বৈষম্যকে অস্বীকার করেই আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম ঘটেছে। যত দিন যাচ্ছে মানুষের মনে ততই গণতান্ত্রিক মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ এখন একজন সামান্য ভিক্ষুকের মৃত্যুতেও দুঃখ পায়। এখানে লক্ষণীয়, রাজন হত্যার ভিডিও চিত্রটি কোনো দক্ষ নির্মাতা তৈরি করেননি। হত্যাকারীদের একজন প্রহার করার ঘটনাটি মোবাইল ফোনে ধারণ করার সময় বলতে থাকে- 'তোর মারের ছবি ফেসবুকে ছাড়ি দিলাম।... মানুষ দেখুক।' ট্র্যাজেডিমূলক নাটকে ঘটনার বর্ণনা থাকে না, উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটে। ভিডিও চিত্রে আরও দেখা যায়, দুর্বৃত্তরা রাজনকে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্যাতন করছে। রাজন বাঁচার জন্য 'মাই গো' বলে আর্তচিৎকার করছে এবং তাকে বাঁচানোর জন্য কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। নির্যাতনকারীরা এক সময় তার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে হাঁটার সুযোগ দেয়। রাজনকে হাঁটতে দেখে দুর্বৃত্তরা বলতে থাকে- 'ওর হাড়গোড় তো দেখি সব ঠিক আছে, আরও মার...।' রাজন কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে- 'আড্ডির মাঝে আর মারিও নারে বা...' (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ জুলাই ২০১৫)। অর্থাৎ ট্র্যাজেডিমূলক নাটকে যেসব উপাদান থাকা আবশ্যক তার সব কিছুই যেন প্রাকৃতিক উপায়ে সমাবেশ ঘটেছে ভিডিও চিত্রটিতে। যারা এই নির্মম নির্যাতনে অংশগ্রহণ করেছে তাদের কেউই এগিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কিংবা শিক্ষিত সমাজের অংশ নয়। তাদের পারিবারিক, ধর্মীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা উল্লেখ করার মতো নয়। তাদের দ্বারা নিষ্ঠুর প্রকৃতির ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজে মাঝে-মধ্যে এদের বিপরীত শ্রেণি কর্তৃক এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা রাজনের চেয়েও ট্র্যাজিক হওয়ার কথা। কিন্তু মিডিয়ার যথাযথ ভূমিকার অভাবে ঘটনাগুলো দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ দু-একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ২ জুলাই রংপুর মেডিকেল কলেজের জিয়া ছাত্রাবাসে চোর সন্দেহে সাবি্বর হোসেন (২০) নামে এক যুবককে শিক্ষার্থীরা পিটিয়ে হত্যা করে। এ বিষয়ে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জাকির হোসেন বলেন, 'বেশ কিছু দিন থেকে ওই ছাত্রাবাসের টেলিভিশনসহ জামাকাপড় চুরি হচ্ছিল। চোর সন্দেহে ছেলেটিকে মারধর করা হয়েছে' (প্র. আলো, ৪ জুলাই '১৫)। ভাবখানা যেন- চুরি হচ্ছিল তাই ছাত্ররা পিটিয়েছে। এর জন্য ছাত্রদের কিংবা কলেজ কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা ঠিক হবে না। প্রায় দুই বছর আগে ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা অনুরূপ অভিযোগে একজন নিরীহ যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। আমরা জানি, মেধাবী শিক্ষার্থীরা মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু তাদের ওই নিষ্ঠুর আচরণে প্রমাণ হয়, তাদের মেধার সঙ্গে মানবিক চেতনার কোনো সংযোগ নেই। রাজন হত্যার বিচার চেয়ে বড় দলগুলো সভা-সমাবেশ না করলেও প্রতিবাদী মানুষেরা ঠিকই রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমগ্র দেশে ব্যানার-পোস্টার টাঙিয়ে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেছে। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও দুজন মন্ত্রী রাজনের বাড়িতে গিয়ে বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১১ জন আসামিকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে তিন-চারজন আসামিকে অভিভাবকরা নিজেরাই ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছে। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সামাজিক চাপের কারণে সরকার এসব করতে বাধ্য হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ সংবিধানে উল্লেখ আছে, প্রতিটি নাগরিকের জানমাল ও ইজ্জতের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেজন্য এ জাতীয় মামলায় উল্লেখ থাকে রাষ্ট্র বনাম অমুক। এখন সময় এসেছে, মানবিক সমাজ গড়ার পক্ষে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। সে কারণে কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার ও মিডিয়াকর্মীদের উচিত নিজেদের ব্যর্থতাকে স্বীকার করে প্রতিটি মর্মান্তিক ঘটনাকে ট্র্যাজেডি আকারে তুলে ধরা।

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

ই-মেইল : [email protected]

 

সর্বশেষ খবর