বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভারতের রাজনীতিতে গো-মাতার দাপট

তুষার কণা খোন্দকার

ভারতের রাজনীতিতে গো-মাতার দাপট

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং আমাদের বড় একটি উপকার করলেন। এ বছর পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে তিনি আমাদের শায়েস্তা করার মানসে বললেন, বাংলাদেশের মানুষের গরুর গোস্ত খাওয়ার সাধ তিনি ঘুচিয়ে দেবেন। বিজেপির রাজত্বকালে ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে একটি গরুও আর বাংলাদেশে ঢুকতে পারবে না। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে তিনি সেভাবেই তার নির্দেশ জানিয়ে দিলি­ ফিরে গেলেন। রাজনাথ সিং তার পূজনীয় গো-মাতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে তার ধর্ম পালন করেছেন। রাজনাথ সিংয়ের সদর্প ঘোষণা শুনে আমাদের মনক্ষুণ হওয়ার কারণ ছিল না। তবুও রাজনাথের ঘোষণায় আমাদের দেশের গোমাংসপ্রেমী অনেকের মনে দুঃখ বেজেছিল। তারা ভেবেছিল, আমরা আর এত সস্তায় গরুর মাংস কিনে সাত পদে রেঁধে রসনার স্বাদ মেটাতে পারব না। রাজনাথ সিংয়ের ঘোষণা এবং বিএসএফের কড়া নজরদারির পরে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম বেড়ে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে বলে যারা আতঙ্কিত হয়েছিলেন তাদের আতঙ্ক ইতিমধ্যে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কসাইরা আমাদের দেশে লালন করা গরু জবাই করে সহনীয় দামে সেটি বিক্রি করছে। আমরাও আগের নিয়মে মাঝেমধ্যে দিব্যি মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছি। আসলে আমার দেশের কৃষক প্রমাণ করে দিয়েছে শত প্রতিক‚লতার মধ্যেও তারা আজও যথেষ্ট গরু পালন করছে এবং বাংলাদেশের কৃষক দেশের মানুষের গোমাংসের চাহিদা পূরণ করার সক্ষমতা রাখে।

রাজনাথ সিংয়ের আস্ফালনের পরে আমার দেশের সরকারও কোরবানির ঈদ নিয়ে চিন্তিত ছিল। ঈদের আগে গুজব রটেছিল, শিগগিরই ভারতের বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশে গরুর স্রোত বইবে। বাংলাদেশে কোরবানির ঈদের একদিনের বাজার চাহিদা মেটানোর জন্য কয়েক মিলিয়ন গরুর প্রয়োজন হয়। মানুষ ভেবেছিল, ভারতের গরু ঈদের বাজারে না ঢুকলে গরুর দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। দেশের মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তকে সস্তায় গরু কেনার সুযোগ না দিলে সরকার তার জনপ্রিয়তা হারাবে। বাস্তবে সেটি ঘটেনি। সরকার সস্তা বাহবা কুড়ানোর পথে না গিয়ে কৃষক এবং গরুর খামারিদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে। সরকারের সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তার প্রমাণ এ বছর কোরবানির ঈদের বাজারে গরুর জোগান যথেষ্ট ছিল এবং মানুষ তার সাধ্যের মধ্যে পছন্দসই গরু কিনেছে। বড় কথা, অনেক বছর পরে আমাদের দেশের কৃষক এবং গরু ব্যবসায়ীরা ন্যায্য দামে গরু বেচতে পারায় হাসিমুখে ঈদ শেষ করেছে। রাজনাথ সিং তার গো-মাতাকে রক্ষা করে তিনি তার সনাতনী ধর্র্মে অবিচল ছিলেন। এদিকে আমার দেশের কৃষক আমাদের কোরবানির গরুর জোগান নিশ্চিত করে আমাদের ধর্ম পালনের পথ নিষ্কণ্টক করেছে। এবারের কোরবানির ঈদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে আমাদের কৃষক তার গরুর পাল বাড়িয়ে তুলবে, সরকার প্রাণিসম্পদ বাড়ানোর জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়াবে এবং আমরা গরুর ক্রেতারা প্রাণ খুলে দুটো টাকা বেশি খরচ করে কোরবানির পশু কিনে কৃষক এবং গরু ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগ করে নেব। দেশের ভিতর গরু পালন এবং বাজারে গরুর জোগানের তেজিভাব দেখে আমাদের আÍবিশ্বাস এখন বেশ দৃঢ় হয়েছে। বাংলাদেশিদের আÍবিশ্বাস বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য রাজনাথ সিংকে ধন্যবাদ।

রাজনাথ সিং বাংলাদেশের মানুষের গোমাংস ভক্ষণ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে তার নিজ দেশের মুসলমানদের ওপর সেই ঝাল ঝাড়তে শুরু করেছেন? ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মুসলমান। ভারতে খ্রিস্টানের সংখ্যাও প্রায় আড়াই শতাংশ। দুনিয়াজোড়া মুসলমান, ইহুদি এবং খ্রিস্টান গরুর মাংস খায় এটি কোনো নতুন কথা নয়। গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে মুসলমান, ইহুদি এবং খ্রিস্টান নাগরিক তাদের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মিল রেখে পছন্দমাফিক পশুর মাংস খাবে এটা তাদের নাগরিক অধিকার। কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকার খর্ব করার নৈতিক অধিকার কি ভারতীয় সরকারের আছে নাকি সেটা থাকা উচিত? হিন্দুদের মন-মর্জিতে মিলছে না বলে ভারতের মুসলমান, ইহুদি এবং খ্রিস্টান নাগরিকের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার কি ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের আছে?

ধর্মের দোহাই তুলে গরু জবাই করা বন্ধ করার নামে মোদি সরকার ভারতজুড়ে ভয়ানক অশান্তি ডেকে আনছে। ভারতের অহিন্দু নাগরিকরা কে কি খাবে এবং কি খাবে না সেই সিদ্ধান্ত সরকারের তরফ থেকে চাপিয়ে দিয়ে মোদি সরকার ভারতীয় অহিন্দু নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণœ করছেন। সনাতন ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার অজুহাতে মোদির দলের আইন প্রণেতারা এখন গুণ্ডার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। জম্মু কাশ্মীরের বিধান সভার স্বতন্ত্র বিধায়ক ইঞ্জিনিয়ার রশিদ তার দাওয়াতি মেহমানদের গরুর মাংস খাইয়েছেন এ অপরাধে বিজেপির বিধায়করা পার্লামেন্ট চলাকালীন পার্লামেন্ট ভবনের মধ্যে রশিদের গায়ে হাত তুলেছেন। বিধান সভার কংগ্রেস সদস্যরা ইঞ্জিনিয়ার রশিদকে রক্ষা না করলে বিজেপির উচ্ছৃঙ্খলতা কোথায় গিয়ে শেষ হতো সে কথা বলা মুশকিল। কোনো ধরনের অশুভ বুদ্ধিতে তাড়িত হয়ে বিজেপি সরকার এবং দল গরুর মাংস নিয়ে রাজনীতিতে মেতে উঠেছে সেটা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।

জম্মু কাশ্মীরের বিধানসভার স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার রশিদ বিজেপির কট্টর হিন্দুদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে বলেছেন, ‘আজ মর্মে মর্মে টের পাচ্ছি, মি. জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত¡ সঠিক ছিল’। দ্বিজাতিতত্তে¡র ওপর ভিত্তি করে সাতচলি­শের রক্তাক্ত স্বাধীনতার জম্নহয়েছিল। দ্বিজাতিতত্তে¡র ফলে ভারত ভূমি তিন খণ্ডে ভাগ হয়ে স্বাধীনতা পেয়েছিল। ভারত কেটে তিন টুকরা হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতের মুসলমানরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেলে ভারতে বসবাসকারী মুসলমানের পরিণাম কত নাজুক হয়ে পড়বে সেই ভবিষ্যদ্বাণী কংগ্রেস নেতা মওলানা আজাদ ৪৬ সালেই করে গিয়েছিলেন। তার সত্য ভাষণের উপহার হিসেবে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মুসলিম লীগার ছাত্র এলাহাবাদ স্টেশনে সর্বজন শ্রদ্ধেয় মওলানা আজাদের মুখে থুথু ছিটিয়ে দিয়েছিল। উগ্র মৌলবাদী হিন্দুদের হাতে লাঞ্ছিত, অপমানিত রশিদ মনের দুঃখে যে কথা বলেছেন সেটি সঠিক নয়। রশিদও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বোধ হিংস্র ছাত্রটির মতো ভুলের পাকে আবর্তিত হচ্ছেন। তিনি জানেন না দ্বিজাতিতত্ত¡ জিন্নাহর সৃষ্টি নয়। দ্বিজাতিতত্তে¡র জম্নদাতা হিন্দু মহাসভার দেবতাতুল্য নেতা বীর সাভারকার। ১৯৩৭ সালে আহমেদাবাদে হিন্দু মহাসভার সর্বভারতীয় সম্মেলনে বীর সাভারকার বলেছিলেন, ভারতীয়রা এক জাতি এই সত্য তিনি মেনে নিতে নারাজ। ভারতীয়রা আসলে দুই জাতি, হিন্দু এবং মুসলমান। সে সময় ব্রিটিশের পোষ্য আধা মুসলমান আধা পার্সি জিন্নাহ মৌলবাদী হিন্দু সাভারকারের কথাটি শোনামাত্র লুফে নিয়ে মুসলিম লীগের করাচি সম্মেলনে বলেছিলেন, সাভারকার শতভাগ সঠিক কথা বলেছেন। ভারতীয়রা আসলে দুই জাতি, হিন্দু এবং মুসলমান। তাতেই দ্বিজাতিতত্তে¡র সূচনা হয়ে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিষবৃক্ষ পোতা হয়ে গেল। হিন্দু মহাসভার একবিংশ শতাব্দী সংস্করণ বিজেপি ভারতীয়দের সাভারকারের চেয়ে ভালো কিছু উপহার দিতে অক্ষম। ইঞ্জিনিয়ার রশিদের গায়ে হাত তুলে বিজেপির বিধায়করা সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। কোনো ধর্ম বিশ্বাসের কোনো মৌলবাদী যে গণতন্ত্রমনা হতে পারে না ইঞ্জিনিয়ার রশিদকে মেরে সেটিও তারা প্রমাণ করে ছেড়েছেন। ধর্ম নিয়ে ভারত ভূমিতে আগেও অনেক ন্যক্কারজনক রাজনীতি হয়েছে, যার দায় সব সময় রক্ত দিয়ে শুধতে হয়েছে। বিজেপির শাসন আমলে ভারতে গরুর মাংস খাওয়া না খাওয়ার মতো এমন হীন একটি ইস্যু নিয়ে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংস বিবাদ ঘনিয়ে উঠবে এমন নির্বুদ্ধিতা আমরা আশা করিনি। বিজেপির রাজনীতিকদের জানা উচিত, হিন্দু ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া যেমন নিষেধ তেমনি হিন্দু ধর্মে শূয়রের মাংস খাওয়াও নিষিদ্ধ। বড় কথা, হিন্দু ধর্মের নয় অবতারের মধ্যে এক অবতার শূয়ার যাকে শুদ্ধ বাংলায় বলা হয়েছে বরাহ অবতার। রাজনাথ সিং এবং তার সহযোদ্ধারা গো-মাতার প্রাণ রক্ষায় এমন সহিংস হয়ে উঠলেন অথচ তারা বরাহ অবতারের প্রাণ রক্ষার প্রতি এত উদাসীন কেন? হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির ভারত শাসনামলে ভারতের কোনো রাজ্যে শূয়র হত্যা নিষিদ্ধ হয়েছে বলে শুনিনি।

গরু নিয়ে চরম বাড়াবাড়ি শুরু করার আগে ভারতীয়দের আমি ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ওই সময় গুজব রটেছিল, ব্রিটিশের তৈরি বন্দুকের লিভারে শূয়রের চামড়া ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই সময়ের বন্দুকের লিভার দাঁতে কামড় দিয়ে টানতে হতো। স্বাভাবিকভাবে হিন্দু মুসলমান কোনো সম্প্রদায়ের সৈন্য বন্দুক চালাতে রাজি ছিল না। এমন রটনার ফলে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের সৈন্যরা একযোগে বিদ্রোহ করে সিপাহি বিপ্লবের জম্নদিয়েছিল। স্বাধীন ভারতের রাজনীতিতে এমন কোনো সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করা উচিত হবে না যা সমাজে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। বিজেপির প্রাণপুরুষ মোদি আধুনিক প্রযুক্তির একনিষ্ঠ অনুরাগী। আমরা আশা করব, তিনি তার আধুনিক চিন্তা কারিগরি বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখবেন না। বরং তিনি ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্মবিশ্বাস এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচরণকে আধুনিক উদার মানসিকতা দিয়ে গ্রহণ করবেন। মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্ক এবং দেশের সব সম্প্রদায়ের নাগরিকের নাগরিক অধিকার নির্ধারণ করার সময় তিনি আধুনিকতার পরিচয় দেবেন। মোদি ভারতের নাগরিকদের খাদ্য-অখাদ্য নির্ধারণের সময় ভারতের প্রাচীন ঋষিদের বিধান স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করতে পারেন। ভারতের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ বেদ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থ মূলত সাহিত্যকর্ম। কাজেই সেগুলোকে এক পাশে সরিয়ে রেখে বেদকে আমরা হিন্দু ধর্মের মূল গ্রন্থ হিসেবে ধরে নিতে পারি। বেদের বিদ্যা অংশ সাজিয়ে গুছিয়ে অনেক উপনিষদের জম্নহয়েছে। অনেক উপনিষদের একটি কঠোপনিষদ। যম এবং নচিকেতার মধ্যে যে সংলাপ হয়েছিল তারই মূল অংশ নিয়ে কঠোপনিষদ রচিত। কঠোপনিষদের এক জায়গায় যম নচিকেতাকে বলছেন, ‘আকাশে উড়ন্ত শকুন থেকে শুরু করে মাটিতে বিচরণশীল কুকুর সব প্রাণীর মাংস তুমি তোমার দেহকে খাওয়াতে পার। তবে তোমার আÍার খাদ্য নির্ধারণের বেলায় খুব সাবধান থাকবে। মনে রাখবে, মানুষের দেহ নশ্বর। তাকে তুমি যা খুশি তাই খাওয়াতে পার। কিন্তু মানুষের আÍা অবিনশ্বর। সে কারণে আÍার খাদ্য খুব সাবধানতার সঙ্গে নির্ধারণ করতে হয়।’

জম্মু কাশ্মীরের বিধানসভার সদস্য ইঞ্জিনিয়ার রশিদকে শারীকিভাবে মারধর লাঞ্ছনা করে গরুর মাংস খাওয়ার অভ্যাস ছাড়িয়ে ফেলার কাজে বিজেপির সংসদ সদস্যরা যথেষ্ট নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। বিজেপির সংসদ সদস্যদের এ নিষ্ঠা শরীরের পবিত্রতা-অপবিত্রতার সীমায় আটকে গেছে। বিজেপির সংসদ সদস্যরা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, মুসলমানদের সঙ্গে এমন হিংস্র আচরণ করে তারা নিজেদের আÍাকে কি খাওয়াচ্ছেন? বিদ্বেষের বিষে মজে গিয়ে তারা তাদের অবিনশ্বর আÍাকে নিজেরাই হত্যা করছেন। ঈশ্বর কি তাদের অধর্ম ক্ষমা করবেন?

                হলেখক : কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর