বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জনগণের দেশ আর নাগরিকের দেশ এক নয়

মোশাররফ হোসেন মুসা

ইউরোপিয়ান দেশসমূহ ভ্রমণ করে আসা মানুষের মুখে প্রায়ই  শোনা যায়, ‘কী সুন্দর দেশ দেখে এলাম! রাস্তাঘাট কি পরিষ্কার! সেখানকার মানুষ স্বেচ্ছায় নাগরিক দায়িত্ব পালন করে। কাউকে কিছু বলে দিতে হয় না।’ তারা ভুলে যান যে, সেখানকার স্থানীয় সরকারগুলো কার্যকর থাকায় অধিবাসীরা নাগরিক দায়িত্বাবলী পালন করে নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। এদেশে তার বিপরীত চিত্র লক্ষণীয়। বাড়ির সামনে একটি কুকুরের মৃতদেহ পড়ে থাকলেও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কেউ সেটি মাটিচাপা দিতে গরজ অনুভব করে না। এমনকি স্থানীয়রা ড্রেনের মধ্যে ময়লা-আবর্জনা ফেলাসহ কাঁথা-বালিশ পর্যন্ত নিক্ষেপ করে থাকে। অর্থাৎ স্থানীয় সরকারগুলো সেভাবে কার্যকর না থাকায় জনগণ নাগরিক শ্রেণিতে উন্নীত হতে সক্ষম হচ্ছে না।

সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের অধীনে এদেশের বেশ কয়েকজন উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সরকারি কর্মকর্তা জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, স্পেন ও পর্তুগাল ভ্রমণের সুযোগ পান। সেই ভ্রমণের সূত্র ধরে ল²ত্নীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন টিপু ‘উপজেলা স্বায়ত্তশাসন কতদূর’ শীর্ষক এক লেখায় বলেছেন, ‘পাঁচটি দেশে থাকাকালীন সেখানকার নাগরিকদের কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতির খবর আমাদের চোখে পড়েনি। যে নাগরিক গাড়ি চালাচ্ছেন, তিনি নিয়ম মেনেই গাড়ি চালাচ্ছেন, কোথাও ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লে বা পুলিশ আটকালে তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে চলে যাচ্ছেন। তাছাড়া এসব দেশের নাগরিকদের মধ্যে রয়েছে পরিবেশসচেতনতা। সবখানে চোখজুড়ানো নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। সেখানকার প্রত্যেক নাগরিক পরিবেশ-প্রতিবেশকে ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন বলেই এমনটি সম্ভব হয়েছে। রাস্তার ধারে, বাড়ির সামনের উঠানে, দেয়ালে কিংবা বহুতল ভবনের ছাদে সবুজের সমারোহ আসলেই চোখে পড়ার মতো (যুগান্তর, ৭ অক্টোবর ’১৫)। উলে­খ্য, ইউরোপের নগর রাষ্ট্রের হাত ধরে আধুনিক রাষ্ট্রের জম্নঘটে। তৎকালীন নগর রাষ্ট্রের সব অধিবাসীই নাগরিক ছিল না। অর্থাৎ নারী, শিশু, বিদেশি ও দাসদের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো না। নাগরিকতার অর্থ ছিল নগরের সদস্যপদ লাভ করা। নগরসদস্যরাই কেবল নগরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ পেতেন। পরবর্তীতে নগর রাষ্ট্রগুলো বিস্তৃতি লাভ করে জাতীয় রাষ্ট্রে পরিণত হলেও নগরগুলোর হাতে স্থানীয় কাজগুলো করার ক্ষমতা রয়ে যায়। তখন থেকেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিচ থেকে উপরমুখী (ইড়ঃঃড়স-ঁঢ়) পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে শুরু করে এবং জনগণও একসময় সার্বজনীন ভোটাধিকার লাভ করে। এই নিয়ম দীর্ঘকাল যাবৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু থাকায় সেখানে এখন স্থানীয় সরকারকেই আসল সরকার হিসেবে গণ্য করা হয়। আমাদের দেশে স্থানীয় শাসন থেকে জাতীয় শাসন আসেনি। ব্রিটিশরা তাদের শাসনের প্রয়োজনে স্থানীয় সরকার সৃষ্টি করে। স্বাধীন দেশের শাসকরাও একই উদ্দেশ্যে স্থানীয় সরকারকে দেখতে চান এবং স্বাধীনতা দিতে অনাগ্রহী থাকেন। তারপরও গণতন্ত্র ও জনগণের ক্ষমতায়নের পক্ষে বাস্তবতা তৈরির লক্ষ্যে আমাদের বক্তব্যগুলো যথার্থ হওয়া উচিত। উপজেলা চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন টিপু উপরোক্ত লেখার এক জায়গায় বলেছেন, ‘সরকারি প্রশাসনব্যবস্থায় একেবারে নিচের দিকে হলেও দেশের সার্বিক উন্নয়নে উপজেলা প্রশাসন বা পরিষদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত বা কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবনমান উন্নয়নসহ নানা ইস্যুতে উপজেলা পরিষদকে আরও শক্তিশালী করা গেলে সামগ্রিকভাবে দেশের চেহারাটাই বদলে যাবে।’ উপজেলা ব্যবস্থা আগেকার মহকুমার মতো মধ্যবর্তী স্তর। এরশাদ সরকার মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করায় মহকুমাগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেই সঙ্গে উপজেলা পরিষদ গঠন করে আবারও মধ্যবর্তী স্তর সৃষ্টি করা হয়। উলে­খ্য, উপজেলার নিজস্ব কোনো আয় না থাকায় এটিকে ইউনিয়ন ও কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ে চলতে হয়। ফলে এই স্তরটিতে স্থানীয় সরকার কার্যকর করা সম্ভব কিনা, তা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়। সে জন্য সর্বপ্রথম কাজ হলো নিæতম ও মৌলিক (ইধংরপ) স্তর হিসেবে ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে (প্রয়োজনে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডকে) কার্যকর করা এবং এগুলোকে তও্বাবধান করার জন্য সর্বোচ্চ স্তর জেলা না বিভাগ হবে সেটি নির্ধারণ করা। যদি বিভাগকে সর্বোচ্চ স্তর নির্ধারণ করা হয় তাহলে উপজেলা ও জেলা উভয়ই মধ্যবর্তী স্তর হয়ে পড়বে। তখন স্তর বিন্যাসের বিষয়টি আরও জটিল হয়ে যাবে। সে জন্য জেলাকে সর্বোচ্চ স্তর ঘোষণা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। অথচ সরকার সেটি বিবেচনায় না নিয়ে শুধু সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার আশায় নতুন নতুন বিভাগ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আবার অনেকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য ফেডারেল ব্যবস্থাকে উত্তম ব্যবস্থা মনে করছেন। কেউ কেউ এ বিষয়ে নেপালের নতুন সংবিধানের উদাহরণও দিচ্ছেন। তারা ভুলে যান যে, নেপালে প্রায় ১২৬টি নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী রয়েছে এবং সেখানকার ভূমি অসমতল ও দুর্গম। এদেশে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া সব ভূমি সমতল এবং নৃতাত্তি¡ক বৈষম্য নেই বললেই চলে। সে জন্য এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা বহাল রেখেই বিকেন্দ্রীকরণের চিন্তা করতে হবে (যা অনেকটা স্কেন্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মতো)। আমরা জানি, সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদে ৫৯ ও ৬০ দফায় ‘স্থানীয় শাসন’ কথাটি সংযুক্ত আছে। অথচ সব রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও লেখক সমাজ ‘স্থানীয় সরকার’ বাক্যটি ব্যবহার করে থাকেন। সে জন্য প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে ‘সরকার’ শব্দটি সংযুক্ত করে প্রতিটি ইউনিটকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দেওয়া যেতে পারে (যেমন-ইউনিয়ন সরকার, নগর সরকার, জেলা সরকার ইত্যাদি)। তখন জেলা সরকার এক হাতে গ্রামীণ ইউনিটগুলো এবং অন্য হাতে নগরীয় ইউনিটগুলো তও্বাবধান করবে। জেলার সঙ্গে শুধু কেন্দ্রের সম্পর্ক থাকবে। এ ব্যবস্থা গৃহীত হলে স্থানীয়দের পরামর্শে ও স্থানীয়দের দ্বারা ইউনিটগুলো পরিচালিত হওয়া শুরু হবে। তখন পদ্ধতিগত কারণেই স্থানীয় জনগণ নাগরিক গুণাবলি অর্জন করতে বাধ্য থাকবে। ফলে দেশটি একসময় নাগরিকের দেশে পরিণত হয়ে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

                হলেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

             E-mail : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর