রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দুই বিদেশি খুনে বাংলাদেশের  'রক্তক্ষরণ’

কাজী সিরাজ

দুই বিদেশি খুনে বাংলাদেশের  'রক্তক্ষরণ’

সম্প্রতি দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশীয় রাজনীতিই হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নিষ্ঠুর এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিদেশিদের, বিশেষ করে বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশিদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মনে হচ্ছে, প্রতিক্রিয়াটা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। একটা কথা সবাইকে স্বীকার করতেই হবে যে, মাঝখানে মাত্র চার দিনের ব্যবধানে দুজন নিরীহ বিদেশির নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক দুর্বলতার চিত্র স্পষ্ট করে দিয়েছে।  বিদেশিরা বর্তমানে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করলেও নিজেদের শঙ্কামুক্ত ভাবছেন না। আমাদের দেশে পাঁচ ধরনের বিদেশি বসবাস করেন। এক. বিভিন্ন দূতাবাসে-কূটনীতিকপাড়ায় কর্মরত কূটনৈতিক মিশনগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দুই. জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচিসহ উন্নয়ন সহযোগী বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তিন. গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসা, যৌথ বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আসা ও দীর্ঘমেয়াদে থাকা ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা। চার. বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিশেষজ্ঞ ও কর্মীরা। এবং পাঁচ. বিদেশি পর্যটকরা। বলা হচ্ছে, সব মিলিয়ে এসব বিদেশির সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে যাবে। দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডে এরা সবাই এখন আতঙ্কিত। সরকার বলছে, বিদেশিদের নিরাপত্তা বিধানে যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে আস্থা রাখতে পারছেন না বিশেষ করে কূটনৈতিক মিশনে কর্মরতরা। হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের দায় স্বীকারের (!) পর তাদের উৎকণ্ঠায় অতিরিক্ত মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে নিজেদের নাগরিকদের সতর্ক করে রাখা পশ্চিমা দেশগুলোর বেশির ভাগই তাদের সতর্কবার্তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করেনি। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে এশিয়ার দেশ- জাপান, কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরও। ঢাকার গুলশান, বনানী ও বারিধারায় বিদেশি নাগরিকদের চলাচল এখন প্রায় চোখেই পড়ে না। এসব অভিজাত এলাকায় বিদেশিদের নিরাপত্তায় সরকার বিজিবি নিয়োগ করার পরও ভয় কেটেছে বলে মনে হয় না। ঢাকার বাইরে অবস্থানরত ও কর্মরত বিদেশিরাও কেউ কেউ ঢাকায় চলে আসছেন বলে শোনা যাচ্ছে। কারণ ঢাকায় সরকার ত্বরিত গতিতে যেসব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, বাইরে তেমন কোনো ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়ায় সেখানে থাকা কতটুকু নিরাপদ, সেই ভাবনা কাজ করছে অনেকের মধ্যে। বিশেষ করে রংপুরের নিভৃত পল্লীতে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিওর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর এমন একটা আতঙ্ক বিদেশিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক যে, যারা এ ধরনের অমানবিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা উদ্দেশ্যমূলক ও খুবই পরিকল্পিত। তাদের কালো থাবা রাজধানী ঢাকা থেকে নিভৃত পল্লী অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকার বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কথা বলছে, সরকারের গৃহীত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্রিফ করছে। সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা আমলে নিলেও খুব যে তার ওপর আস্থা রাখছেন তারা, তা মনে হচ্ছে না। বিদেশিরা, বিশেষ করে কূটনীতিকরা এ ব্যাপারে তাদের নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। বিদেশি নাগরিকদের জন্য সতর্কতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয় সামনে রেখে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন চারজন গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক। তারা হলেন- ঢাকার কূটনৈতিক কোরের ডিন ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডব্লিউ গিবসন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার গ্রেগ উইলকক এবং কানাডার হাইকমিশনার পিয়েরে বেনওয়া নারামে। প্রভাবশালী এই চার রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারই গত সেপ্টেম্বর মাসে সরকারকে আগাম সতর্কতার তথ্য প্রদান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় নিজেদের অবস্থানের প্রেক্ষাপটে সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে চলেছেন। ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রের খবর অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে অস্ট্রেলিয়া ও পশ্চিমা স্বার্থের ওপর বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হতে পারে- এমন তথ্য পেয়েছিল যুক্তরাজ্য। পরে সন্ত্রাস দমনে পারস্পরিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে সে তথ্য অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আদান-প্রদান করা হয়। ২৫ সেপ্টেম্বরের আগে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়ার পরই অস্ট্রেলিয়া সাবধান হয়ে গিয়ে সতর্কবার্তা জারি করে। এ তথ্যের ভিত্তিতেই বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখতে আসেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিরা। তাদের ঢাকায় অবস্থানকালেই গুলশান কূটনৈতিক জোনে খুন হন ইতালিয়ান সিজার তাভেলা। বাতিল হয়ে যায় বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার সফর। পাঁচ দিনের মাথায় আবার রংপুরে খুন হন জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও। সে সময় থেকে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করেছিল। আগের সেই সতর্কতাই আবার হালনাগাদ করে উচ্চ ঝুঁকির কথা বলেছে যুক্তরাজ্য। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা বজায় রেখেছে তাদের সতর্কতা। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সতর্কতা ১ অক্টোবর থেকে হালনাগাদ না করলেও নিজেদের নাগরিকদের বিশেষভাবে সতর্ক রেখেছে। তবে কর্মকর্তাদের সংরক্ষিত এবং অধিকতর নিরাপদ স্থানে সীমিত আকারে যাতায়াতের অনুমতি মিলেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ৬ অক্টোবর মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঢাকার ৪৫ কূটনীতিক ও বিশ্ব সংস্থার প্রতিনিধিদের ব্রিফিংয়ের পরই বিকালে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার উপরোল্লিখিত চার কূটনীতিক। তারা সরকারের সঙ্গে যেমন নিরাপত্তাজনিত বিষয়সহ বাংলাদেশে বিনিয়োগ সংক্রান্ত নানা বিষয়ে আলোচনা করছেন, একইভাবে নিজেদের মধ্যে তাদের করণীয় নিয়েও নিয়মিত সলাপরামর্শ করছেন। বোঝা যায়, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ তারা পর্যবেক্ষণ করছেন এবং এখনো সম্পূর্ণ নিরাপদবোধ করছেন না। তা না হলে এ একই বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে তারা বৈঠকের পর বৈঠকে মিলিত হতেন না। এ প্রসঙ্গে অন্য আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা কথা বলা খুবই জরুরি যে, দেশি-বিদেশি সবার আলোচনায় গুরুত্বসহকারে বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়া ও পশ্চিমা স্বার্থের ওপর সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার ব্যাপারে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার আগাম সতর্কবার্তার কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু এই কথা বলা হচ্ছে না যে, বাংলাদেশি গোয়েন্দারাও নিরাপত্তা শঙ্কার কথা বলেছিল। এতে করে আমাদের দেশের গোয়েন্দাদের সাফল্য ও সক্ষমতাকে ছোট করে দেখা হচ্ছে। ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এক গোয়েন্দা রিপোর্ট মারফত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরে আসার আগের নানা হুমকি ও আশঙ্কার কথা জানায়। দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে হুমকির চিত্র তুলে ধরা হয় ওই প্রতিবেদনে। তাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে ১৮ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর বাতিল, বিনিয়োগ ফোরামের বৈঠক বাতিল, ব্রিটিশ মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর বাতিল, পর্যটনশিল্পে বিরূপ প্রভাব, গার্মেন্টশিল্পে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনাশই শুধু নয়, দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের মধ্যেও নিরাপত্তাহীনতার যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, এসব বিষয় সিরিয়াসলি আমলে নিয়ে বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের প্রতিবেদন কেন গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়নি, এর জন্য কে বা কারা দায়ী তা দেখা দরকার। দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের সমসাময়িককালে আমাদের দেশে আরও অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি হৃদয়বিদারক কয়েকটি শিশু ও নারী এবং ধর্মীয় নেতা হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিরই বহিঃপ্রকাশ। দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডে দুর্বৃত্তরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই দুর্বল দিকটিরও সুযোগ গ্রহণ করেছে নিঃসন্দেহে। সন্দেহ নেই যে, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা দেশের অন্যসব হত্যাকাণ্ডকে ছাপিয়ে গেছে। বলাই বাহুল্য, এটা নিয়ে সরকার এখন বিব্রত, হতচকিত এবং নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে এবং দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে সরকারের নিষ্ঠা ও সক্ষমতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। বলা চলে, সরকার একটা চ্যালেঞ্জের মুখে। দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা কি   টার্গেট কিলিং ছিল? জবাব হ্যাঁ এবং না দুটোই। টার্গেট কিলিং-এ বড়-ছোট, ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, দলগত স্বার্থ জড়িত থাকে। যেমন কোনো দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হত্যার পেছনে থাকে ক্ষমতা দখলের অভীপ্সা, কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা হত্যার পেছনে থাকে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার হীনচক্রান্ত (২১ আগস্ট বাংলাদেশে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল), ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক কারণে এমনকি প্রেমঘটিত কারণেও টার্গেট কিলিং হয়। বিশেষ কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতাবশতও হতে পারে সংশ্লিষ্ট দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনা। কিন্তু যে দুই বিদেশি নাগরিক খুন হলেন, তারা কেউ উল্লিখিত কোনো ক্যাটাগরিভুক্তই নন। তারা দুই দেশের নিরীহ নাগরিক। জাপানি ভদ্রলোক তো মুসলমানই হয়ে গেছেন। তাদের হত্যাকাণ্ডে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার উত্থান-পতন হয়নি, তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী-প্রতিপক্ষ পথের কাঁটামুক্ত হয়নি। আবার এমনও নয় যে, তারা যে দুই দেশের নাগরিক সেই ইতালি এবং জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের চরম শত্রুতামূলক কোনো সম্পর্ক রয়েছে। তাহলে তাদের কেন মারা হলো? অবশ্যই কারণ আছে, উদ্দেশ্য আছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, নারী-শিশু হত্যার মতো দেশে বহু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দুই বিদেশি হত্যাকে মেলানো যাবে না। নিজ নিজ দেশের সাধারণ নাগরিক হলেও এ দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডকেও এক ধরনের ‘টার্গেট কিলিংই বলা যায়। উদ্দেশ্য হতে পারে দ্বিবিধ। এক. ক্ষমতাসীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলা, এই সরকারের কাছে দেশি-বিদেশি কারও জানমালের নিরাপত্তা নেই, তা প্রমাণ করা; দুই. বিদেশি নাগরিক হত্যা করে এদেশে বসবাসকারী সব বিদেশি নাগরিকের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে সরকারকে চাপের মধ্যে রাখা, ডিফেইম করা এবং বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা এবং বাংলাদেশের গার্মেন্ট ব্যবসাসহ অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামিয়ে দেওয়া। এই উভয়বিধ উদ্দেশ্যই সফল হয়েছে বলা চলে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য হত্যার শিকার নিহত দুজন না হয়ে অন্য কোনো নিরীহ দুই বিদেশিও হতে পারতেন। লোকটা বিদেশি হতে হবে, এটাই ছিল হত্যাকারীদের লক্ষ্য। সহজে কাজটা সম্পন্ন করার জন্য নিহত নিরীহ দুজনকে বেছে নিয়ে অনুসরণ করা হয়েছে এবং অতি সহজে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করা হয়েছে। অনুল্লেখযোগ্য লোক হওয়া সত্ত্বেও এ দুই বিদেশির হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষতির বিষয় এবং সম্ভাব্য আরও ক্ষতির ব্যাপারে ধারণাটা সবার কাছেই মোটামুটি পরিষ্কার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে বা কারা করল এমন গর্হিত অপরাধ? সরকারের সুউচ্চ মহল এবং কোনো কোনো মন্ত্রী-মিনিস্টার এবং শাসকদলীয় লোকজন সরাসরি দুষছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তার দলকে। অপরদিকে বিএনপি এর সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা শুধু অস্বীকারই করছে না, এ ব্যাপারে রহস্য উদ্ঘাটন, যথাযথ তদন্ত, অপরাধীদের শনাক্তকরণ ও বিচারসহ উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে।

দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য সরকারপন্থি লোকজন, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী পরিচয়দানকারী সরকারি ‘দলদাসরা’ এ নিয়ে টিপ্পনিও কাটছেন। তবে সাধারণের মধ্যে যে অভিমত জেগেছে, তাতে বোঝা যায়, সরকার পক্ষের এই ‘ব্লেইম গেম’ আসল অপরাধী শনাক্তকরণে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে ক্ষমতার উচ্চাসন থেকে তদন্তের আগেই যদি অপরাধী ‘নির্ধারণ’ করে দেওয়া হয়, তদন্তকারীরা সেখানেই অপরাধী খুঁজবেন এবং সেখান থেকেই কাউকে না কাউকে অপরাধী হিসেবে দাঁড় করাবেন। এতে প্রকৃত অপরাধী আড়ালে চলে যাবে। এরই মধ্যে দুয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল সরকারি অবস্থানের অনুকূলে চেষ্টা করছে এই হত্যাকাণ্ডে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা আবিষ্কার করতে। এটা খুবই খারাপ ও অন্যায় কাজ হচ্ছে। তদন্তকারীরা এতেও বিভ্রান্ত হবেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এই সংকট আমাদের জাতীয় সংকট। জাতীয়ভাবেই তা মোকাবিলার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সরকার এ ব্যাপারে পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণের জন্য একটি সর্বদলীয় কনভেনশন আহ্বান করতে পারে। রাজনৈতিক দলের বাইরের সব সামাজিক ও নাগরিক শক্তিকেও ডাকা উচিত। এতে একদিকে যেমন সবার আন্তরিকতার বিষয়টি স্পষ্ট হবে, অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের মতো জাতীয় ক্রান্তিকালে জাতীয় ঐক্যের আরেক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। দুর্বৃত্তরা এতে সুনির্দিষ্ট বার্তা পেয়ে যাবে এবং জনগণের প্রতিরোধের মুখে পড়বে তারা। অন্যদিকে, বিদেশিদের মধ্যেও এ ধরনের জাতীয় উদ্যোগ আস্থা বাড়াবে, তাদের সব ধরনের আতঙ্ক কেটে যাবে। এখানে কারও কৃতিত্ব বা বাহাদুরি জাহির করার বিষয় নেই, জাতীয় স্বার্থ ও সম্মান রক্ষার এবং পুনরুদ্ধারের বিষয়টিই বড়। পরিস্থিতি এখনই সামাল দেওয়া না গেলে, একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকলে, প্রকৃত দুর্বৃত্তরা আড়ালে থেকে আরও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে।  তাতে শুধু সরকার নয়, কোনো দল বিশেষ নয়, সমগ্র দেশ ও জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দুই বিদেশি হত্যায় আমাদের দেশেরই যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে তা যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে।  তা না হলে এই ‘রক্তক্ষরণ’ দেশে যে ‘রক্তশূন্যতার’ সৃষ্টি করবে তা হবে আরও বিপর্যয়কর।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর