মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দুর্গাপূজার মাহাত্ম্য

কমান্ডার এইচ ডি সাহা (অব.)

দুর্গাপূজার মাহাত্ম্য

সব দেব-দেবীর পূজা একই সময় আয়োজন করা হয় না। অনেক দেব-দেবীর পূজার জন্য নির্দিষ্ট মাস, সময়, তিথি থাকে।  বিষ্ণু, শিব, লক্ষীর পূজা প্রতিদিনই করা হয়। ব্রহ্মা, কার্তিক, সরস্বতী প্রভৃতি দেব-দেবীর পূজা বিশেষ বিশেষ তিথিতে করা হয়। সামাজিক অংশগ্রহণগত দিক থেকে পূজা দুইভাবে করা হয়- পারিবারিক পূজা ও সার্বজনীন পূজা। পারিবারিক সদস্যদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে পূজা করা হয় তা-ই পারিবারিক পূজা। সমাজের সব মানুষের অংশগ্রহণে যে পূজা করা হয় তা-ই সার্বজনীন পূজা। দুর্গাপূজা মূলত সার্বজনীন পূজা। এ পূজা শুধু বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সম্প্র্রদায়ের গণ্ডি পেরিয়ে দুর্গোৎসব আজ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সার্বজনীন এ দুর্গোৎসবকে ঘিরে সবার মধ্যে গড়ে ওঠে এক সৌহার্দ্য-প্রীতি ও মৈত্রীবন্ধন। অনাদিকাল ধরে এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় আশ্বিনের শুক্লা-পঞ্চমী তিথি থেকে দশমী পর্যন্ত সিংহ বাহিনী দেবী দুর্গার দশভুজা প্রতিমার মাধ্যমে বিশ্বের মহাশক্তির আরাধনা করে আসছে। ঈশ্বর ইচ্ছা করলে যে কোনো কাজ যে কোনো সময়ে সম্পাদন করতে পারেন এবং যে কোনো রূপ ধারণ করতে পারেন। ঈশ্বরের রূপ দুটি- একটি আকার, অন্যটি নিরাকার। আকার রূপের নাম দেবতা এবং তার নিরাকার রূপের নাম ব্রহ্ম। ঈশ্বরের নিরাকার রূপটি নির্দিষ্ট হলেও আকার রূপটি নির্দিষ্ট নয়। ভক্ত যদি ভক্তির সঙ্গে যে কোনো বাস্তব, অবাস্তব ও কাল্পনিক কিংবা অন্য কোনো রূপে তাকে আরাধনা করে; তবে সেই রূপেও ঈশ্বর ভক্তকে কৃপা করতে পারেন। ঈশ্বরের রূপ তাই মুখ্য নয়, ভক্ত কোন আকৃতিতে তাকে আরাধনা করল এটা কোনো বিষয় নয়। ভক্তের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও উদ্দেশ্যই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুরা প্রধানত দুটি রূপে তাকে আরাধনা করে। এর একটি প্রেমিক রূপে, অন্যটি মাতৃরূপে। ঈশ্বরের মাতৃরূপের নাম দুর্গা। হাজারও কণ্ঠের মধ্যে বাঙালিদের মনে একটি আনন্দক্ষণের প্রতীক্ষা, দেবীকে আবাহনের অপেক্ষা। তিনি সবার মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেন। দুর্গা ১০৮টি বিশেষণে ভূষিত। শ্রী রামচন্দ্র ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে অকালে দেবীর পূজা করেছিলেন। আমরা শ্রী রামচন্দ্রের সেই অকালকেই কাল ধরে দেবী দুর্গার পূজা করে আসছি। আর কালের দুর্গাপূজা হয়ে গেছে এখন বাসন্তী পূজা। শরৎকালে শারদীয় যে পূজা অনুষ্ঠিত হয় সেটা হলো অকাল বোধন। নিদ্রিত সময়কালে কোনো দেবতাকে জাগ্রত করার নামই হলো অকাল বোধন । দশানন বীর বিক্রমশীল রাবণের লঙ্কাপুরী থেকে প্রিয়তমা পত্নী সীতা উদ্ধারের জন্য ত্রেতাযুগের ভগবান শ্রী রাম অকালে এ পূজার আয়োজন করেছিলেন। ভগবান রামের এ ঘটনা চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য অকাল বোধনই শারদীয় পূজার প্রচলন ঘটেছে এবং এ পূজা পরিণত হয়েছে হিন্দুদের জাতীয় উৎসবে।

দেবী দুর্গা : মহিষাসুরকে সংহার করেছেন বলে মহিষাসুর মর্দিনী এবং জগতের শক্তি ও মায়ার আধার বলে মহামায়া-মহাশক্তি। তিনি হিংসা নাশকতা ও সব অন্যায় অপকর্মের প্রতীক অসুরের নিধন সাধন করে মানব সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা ও স্বস্তি আনেন। দেবী মানবের স্বার্থবিরোধী অসুরকে বধ করে মানব জাতিকে রক্ষা করেন বলে তিনি রণদেবী দুর্গা।

আবির্ভাব : শ্রী দুর্গা সামরিক, জ্ঞান এবং ধনশক্তির বলে বলীয়ান। পশুরাজ সিংহ তার বাহন, সঙ্গে রয়েছে তার দুই পুত্র-সেনাপতি কার্তিক ও সিদ্ধিদাতা গণেশ। দুই মেয়ে লক্ষী ও সরস্বতী। এই চার সন্তানের সঙ্গে দুর্গার মহাশক্তির চার বর্গ তথা ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ সংশ্লিষ্ট। মহাদেবের বাসগৃহ কৈলাস পর্বত হতে মা দুর্গা প্রতিবছর সন্তানদের সঙ্গে করে পিত্রালয় মর্তে বেড়াতে আসেন, আসেন প্রতিবছর আশ্বিন মাসের পঞ্চমী তিথিতে। দেবীর দশটি হাত তিনটি চোখ রয়েছে। এ জন্য তাকে ত্রিনয়না বলা হয়। তার বাম চোখ চন্দ্র, ডান চোখ সূর্য এবং কপালের ওপর অবস্থিত চোখ- জ্ঞান বা অগ্নিকে নির্দেশ করে। তার দশ হাতে দশটি অস্ত্র রয়েছে যা শক্তির প্রতীক এবং শক্তিধর প্রাণী সিংহ তার বাহন। সিংহ শক্তির ধারক। দেবী হিসেবে দুর্গার গায়ের রং অতসী ফুলের মতো সোনালি হলুদ। তিনি তার দশ হাত দিয়ে দশদিক থেকে সব অকল্যাণ দূর করেন এবং আমাদের কল্যাণ করেন। দেবী দুর্গার ডানদিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলো যথাক্রমে ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, বাণ ও শক্তি। বামদিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলো হলো ডাল, ধনুক, পাশ, অঙ্কুশ, কুঠার। এসব অস্ত্র দেবী দুর্গার অসীম শক্তি ও গুণের প্রতীক। আমাদের দেশে অন্যান্য উৎসবের মতো দুর্গাপূজা ও পালিত হয় উৎসব আকারে। এ উৎসব কেবল একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশী সব সম্প্রদায়ের মাঝে। মহিষাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে বিজয় উৎসব পালিত হয় বলে দশমী বিজয়ের দিন। অন্যায়কে প্রতিহত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিন। তাই বিজয়া দশমী ঐক্যের প্রতীক। এটা পারিবারিক ও সামাজিক জীবন থেকে সব ধরনের অশুভ শক্তিকে দূর করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা দান করে। বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের পরে অনেকে পূর্ব শত্রুতা ভুলে পরস্পর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়। সামাজিক সংহতি দৃঢ়তা করার ক্ষেত্রে সার্বজনীন দুর্গোৎসব তাই অনেক বেশি শক্তিশালী। আর সনাতন ধর্মের বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজাকে ঘিরে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান যুগ যুগ ধরে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে পরস্পরকে বেঁধে রেখেছে ভালোবাসা দিয়ে। আজ আমরা নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ ভুলে গিয়ে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয়ে বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার হীন কর্মে লিপ্ত। অসৎ পথে প্রাচুর্যের পাহাড় গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ সমাজ জীবন থেকে এ ঘৃণ্য দুর্গতি বিনাশ করার জন্য মা দুর্গার আশীর্বাদ আজ আমাদের অপরিহার্য।

আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহিমায় সমুজ্জ্বল এক সুমহান দেশ বলে এতকাল বিশ্ববাসীর কাছে যে পরিচিতি ছিল সেই গৌরবোজ্জ্বল পরিচয় ফিরিয়ে আনার জন্য তাই আসুন দুর্গোৎসবের এ শুভ দিনে মায়ের কাছে আমাদের প্রার্থনা এই যে, আমরা যেন সমাজ জীবন থেকে হিংসা, বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতা ধুয়ে-মুছে ফেলতে পারি এবং আসুরিক শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে মনুষ্যত্বের বেদিমূলে দেশ ও জাতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারি।  জ্যোতির্ময়ী জগজ্জননী মা দুর্গা আমাদের দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গল করুক, তাই হোক আমাদের প্রার্থনা।

E-mail: [email protected]

সর্বশেষ খবর