বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শুভ শক্তির প্রতীক দুর্গা

অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী

শুভ শক্তির প্রতীক দুর্গা

চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় দেবী মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্যে ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগৎতে দুর্গতির হাত থেকে জীবন রক্ষা করেন তিনিই মা দুর্গা। শ্রী দেবী দুর্গা, গণদেবতা এভাবে অশুভশক্তি নিধন করে শুভশক্তি তথা ধর্মশক্তির জয় করলেন। “যা দেবী সর্বভুতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা।/নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।/যা দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা/ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।”/ত্রিনয়নী মহাদেবী দুর্গাপূজার সর্বোত্তম পূজাতত্ত্বে বিভাসিতা। তিনি দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে আবিভর্‚তা এ পুজোর মূর্তি কল্পনায় ফুটে উঠেছে শৌর্যবীর্য (কার্তিক), জ্ঞানভক্তি (সরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ), সম্পদ (লক্ষী) এবং মানবজীবনের ইহকালের বস্তুলাভ এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়। আর মায়ের পদতলে মহিষাসুর অশুভ এবং অহংকারের প্রতীক, যা জগতের অমঙ্গলের হেতু। তাকে আবার শাসন করছেন স্বয়ং দেবী, যিনি কল্যাণময়ী বরাভয় দায়িনী হিসেবে জগতের কল্যাণ করে আসছেন। মা দেবীদুর্গার আশীর্বাদে শ্রীরামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করার পর সীতাকে উদ্ধার করলেন সেই থেকে শরৎকালে হয়ে আসছে দুর্গাপূজা। পূজার ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এই ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। পুরনো শাস্ত্রমতে দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। অন্যদিকে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ কদলীবৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়, প্রচলিত ভাষায় একে কলাবউ বলে। পূজার অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে দেবীর বিশেষ পূজা ‘সন্ধিপূজা’। অষ্টমী তিথিতে কোনো কুমারী বালিকাকে পূজা করা হয়। নবমীকে হোমযজ্ঞের দ্বারা পূজার পূর্ণহূতি দেওয়ার রীতি। দুর্গাপূজায় দশমী তিথিতে হয় দেবীর বিসর্জন। পুজোয় দশমী তিথি বিজয়াদশমী নামে খ্যাত। হিন্দুদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এই দিনে শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ নিহত হয়েছিলেন। একই কারণে স্বর্গমর্ত্যওে দুর্দিনে দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আবির্ভাবও হয়েছিল। সব দেবতার সম্মিলিত তেজ সৃষ্টি করেছিল মহামায়াকে। আবার সেই শক্তি বলীয়ান হয়েই দেবী চন্ডী অশুভকে বিনাশ করে স্বর্গ মর্তে ন্যায় আর শান্তি প্রতিষ্ঠা করে ধর্মের অন্তর্নিহিত অর্থকেই আবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরে ছিল। দুর্গা পূজাতে আমাদের বাসায় সব সম্প্রদায়ের লোকই আসত, কারণ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এই ধরণীতে আসেন। তাই সবাইকে সঙ্গে নিয়েই আমরা দুর্গাপূজা করি। আমাদের আনন্দ আমরা সবার সঙ্গেই ভাগ করে নেই। সবার সঙ্গে পুজো করতে আনন্দ করতে আর পুজোর প্রসাদ সবাই একসঙ্গে খেতে কি যে আনন্দ, তা বলে বুঝানো যাবে না। পুজোতে প্রসাদ সবাইকে নিয়ে খাওয়া হতো প্রথম দেওয়া হতো ফলমূল তাতে আপেল, কলা, আঙ্গুর, পেঁপে আর কত কি। দুপুরে দেওয়া হতো ভোগ, তাতে খিচুড়ি সঙ্গে লাবড়া অর্থাৎ নানান রকম শাকসবজি দিয়ে তৈরি নিরামিষ। সবাই প্রসাদ খেয়ে বলত আহা কি মজা, এমন মজার খাবার কতদিন খাইনি। আমরা তাদের এই আনন্দ আর তৃপ্তি দেখে নিজেরাই আনন্দিত হতাম। সন্ধ্যায় হতো আরতি, সেই আরতির সময় ধূপ ধোঁয়ায় চারদিক হয়ে যেত গন্ধময় একটি ধোঁয়াচ পরিবেশ আর ঢাক, ঢোল কাঁসার শব্দ ধ্বনিতে আমরা সবাই নাচতাম। প্রতিমার সামনে হাতে ধূপের পাতিল নিয়ে আমিও নাচতাম। দুর্গাপূজায় সব ধরনের লোকের আগমন হয়। এক কথায় বলা যায় সব স্তরের জনগণের মিলিত প্রয়াসই দুর্গাপূজা। সবার মিলনই দুর্গাপূজার আসল রূপ। তাই তো দুর্গাপূজা সার্বজনীন মহা মিলনোৎসব। বিশ্বমৈত্রী স্থাপনের নিমিত্তেই দুর্গাপূজা মানুষের মহামিলনতীর্থ। প্রতি বছর মা আসেন, ভক্তের পুজো নিয়ে আবার ফিরেও যান কৈলাশে। শরতের কাশবনে যখন ফুলের শুভ্রতা, সনাতনী বাঙালিরা তখন প্রস্তুতি নেয় মা দুর্গাকে মর্ত্যে বরণ করার জন্য। মায়ের আগমনে সন্তানের আনন্দ। যে কোনো সংকটে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াতে পারলেই শুধু সম্মিলিত শক্তিতে অসুর শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব। শরৎকালের দুর্গাপূজায় ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু সবাই মিলিত হয় পরমানন্দে। মায়ের কাছে সন্তানের অধিকার সমান। কারণ তিনি বিশ্বজননী। সনাতন ধর্মশাস্ত্রে দুর্গা নামটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, রেফ রোগনাশক, গ অক্ষর পাপনাশক ও অকার ভয় শত্রুনাশক। তার মানেই দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই শ্রীদুর্গা। অন্যদিকে শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষদেব গণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ বা সবাই দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি। তিনি আমাদের দুর্গতি হতে ত্রাণ করেন বলেই দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা। দেবী মা দুর্গা ব্রহ্মশক্তি স্বরূপিণী, তিনি বিভাসিতা মাতৃশক্তি, তিনি জগজ্জননীরূপে সর্বভূতে বিরাজমান। তিনি সকল প্রাণীতে চেতনারূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে, শান্তি রূপে, শ্রদ্ধারূপে, দয়ারূপে ইত্যাদি নানা রূপে বিরাজিতা সকল প্রকার অকল্যাণের হাত থেকে তিনি আমাদের অর্থাৎ তার সন্তানদের রক্ষা করে থাকেন।  শাস্ত্রমতে দেবতা ও অসুরদের সংগ্রামে শরণাগত শুভবুদ্ধি ও কল্যাণকামী দেবতাদের তিনি সব সময় বরাভয় দান করেছেন।

লেখক : সিনিয়র কনসালটেন্ট, বারডেম হাসপাতাল।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর