শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তো এখন রাজনীতিরই অংশ

মইনুল হোসেন

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তো এখন রাজনীতিরই অংশ

বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ক্ষমতাসীন দলের অংশ হয়েও প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ না করে আর নিশ্চুপ থাকতে পারেননি। তবে এখন তার বক্তব্যের গুরুত্ব তার নিজ লোকেরাও বুঝতে প্রস্তুত নন। রাজনৈতিক বাণিজ্যের দ্বারা যারাই লাভবান হতে চাইবেন তাদের জন্য সুযোগ উন্মুক্ত। রাজনীতি তাই শুধু সন্ত্রাসনির্ভর নয়, পুলিশি শক্তিনির্ভরও।  রাজনৈতিক বাণিজ্য রক্ষার জন্য পুলিশি শক্তির প্রয়োজন হয়। দুঃখজনক হলেও অনেকে মিলেই বাণিজ্য রাজনীতির ফায়দা ভাগাভাগি করছে। ক্ষতি হচ্ছে সমগ্র জাতির। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সমগ্র জাতি। খুনখারাবি গুপ্তহত্যা তো দেশে বেড়েই চলছে। এটা বাণিজ্য রাজনীতিরই পরিণতি।

স্বীকার করি দেশে জঙ্গিবাদ নেই। কিন্তু খুনখারাবি, গুম ও গুপ্তহত্যার মতো সন্ত্রাসী তৎপরতা, কর্মকাণ্ড তো নতুন কিছু নয়। এ ধরনের কাজের জন্য বাইরের জঙ্গিবাদদের আসার প্রয়োজন তো দেখছি না। তবে একপর্যায়ে সন্ত্রাসবাদ যে বড় আকারে জঙ্গিবাদ হিসেবে দেখা দেবে তা নিয়ে যে কোনো সুস্থ চিন্তার লোক উদ্বেগের মধ্যে আছে।

প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ খোলাখুলিভাবেই জানালেন আমাদের রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে। অর্থাৎ দেশে চেকবুকের রাজনীতি চলছে। জনসেবার রাজনীতি নেই। আমি আর একটু এগিয়ে বলে আসছি রাজনীতিই এখন বাণিজ্য। জনসম্পদ নিয়ে সহজ বাণিজ্য। পরিণতি হিসেবে দেশে দুর্নীতি বাড়ছে, বাড়ছে লুটপাটের নৈরাজ্য। ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমেই রাজনৈতিক বাণিজ্য চালাতে হয়। তাই সন্ত্রাসী কার্যক্রমই এখন আমাদের রাজনীতি। জনগণের সম্পত্তি নিয়ে রাজনৈতিক বাণিজ্য শান্তিপূর্ণ বা নিয়মতান্ত্রিক হতে পারে না। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নৈরাজ্য এভাবেই দেশকে গ্রাস করেছে।

 

 

রাস্তায় শক্তির প্রদর্শনী গুপ্তহত্যার রক্ষাকবচ হতে পারে না। বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তা বাড়াতে রাজধানী শহরে সীমান্ত রক্ষীদের ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও মোটরসাইকেলে সারিবদ্ধভাবে রাজধানীতে টহলদানের কাজ করে যাচ্ছে। যা দেখে মনে হতে পারে গুপ্তঘাতকরা সংঘবদ্ধভাবে এসে তাদের মোকাবিলা করবে। হঠাৎ করে দুজন বিদেশি নাগরিক খুন হওয়ার পর সরকার আকস্মিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। আমাদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে সরকারকে দুশ্চিন্তা করতে দেখা যায়নি।

এটা এখনো উপলব্ধি করা হচ্ছে না যে, যোগ্যতার সঙ্গে সরকার পরিচালনার জন্য সৎ ও যোগ্য লোক অপরিহার্য। দুঃখজনক হলেও সত্য, অযোগ্য লোকদের মিথ্যাচারের ওপর ভর করে সরকার পরিচালনা করা হচ্ছে। বিরোধীদের নির্মূল করার রাজনীতি এমন এক রাজনৈতিক আবহাওয়া তৈরি করেছে, যা শুধু বিরোধীদের মনে নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তা নয়; এভাবেই সরকার সারা দেশে নিরাপত্তাহীনতার রাজত্ব কায়েম করেছে। সরকার অস্বীকার করতে পারবে না যে, মানবাধিকার সংস্থার লোকেরাসহ আমরা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নামে সরকারি সংস্থা কর্তৃক বিচারবহিভর্‚ত হত্যা ও জোরপূর্বক অপহরণের প্রতিবাদ করেছি। যখন সন্ত্রাসবাদের অস্তিত্ব নেই তখন দেশে সন্ত্রাসবাদ খুঁজতে গিয়ে আমরা নিজেরা প্রতারিত হতে পারি কিংবা ভয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হতে পারি। সন্ত্রাসবাদ খুনখারাবির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি। কিন্তু সহিংস রাজনীতিকে যে উৎসাহিত করা হচ্ছে, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দলে অস্ত্রধারীদের পালা হচ্ছে। মাস্তানী শক্তি প্রশ্রয় পাচ্ছে। তারাই পাড়ায় পাড়ায় চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গোড়ার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে দখলবাজি আর লুটপাট- যা আদতেই রাজনীতি নয়। প্রায় সব সংসদ সদস্যই নিজেদের সেভাবেই তুলে ধরছেন এবং অনেকের রয়েছে নিজস্ব সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। সরকার এবং প্রতিটি রাজনৈতিক নেতা এ রকম লোকদেরই পছন্দ করে থাকেন। জঙ্গিবাদ নেই কিন্তু আমাদের দলীয় রাজনীতিতেই রয়েছে সহিংস সন্ত্রাসী তৎপরতা। পুলিশি শক্তির অপব্যবহারও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি নয়। দেশে পুলিশি শক্তির অপপ্রয়োগ সন্ত্রাসবাদী শক্তির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে। তাই সন্ত্রাস দমনের পথ পুলিশি শক্তি নয়, সমঝোতার রাজনীতি। গণতান্ত্রিক সহনশীলতা। পুলিশের রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে সরকারের দলীয় রাজনীতির শক্তি হিসেবে পুলিশকে ব্যবহার করার জন্য। তারা সরকারের রাজনীতির প্রয়োগকারীতে পরিণত হয়েছে। তারা না পারছে তাদের পুলিশি যোগ্যতা দেখাতে, না পারছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অঙ্গীকার পালন করতে। এভাবে অবহেলায় ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে।  রাতারাতি বিপুলসংখ্যক বিলবোর্ডের মাধ্যমে জনগণকে বিশাল উন্নতি-অগ্রগতির ছবি দেখানো হচ্ছে। এ এমন উন্নয়ন যা জনগণ দেখতে পাচ্ছে না, তাদের বিলবোর্ডের মাধ্যমে জানাতে হচ্ছে, এটা আর যাই হোক জনগণের উন্নয়ন হতে পারে না। সরকারকে তার ব্যর্থতা সম্পর্কে অন্ধকারে রাখার জন্য এ বিভ্রান্তিকর প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। নিরাপত্তার বিষয়টিকে অনিশ্চিত রেখে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না। মিথ্যা প্রতারণা মিথ্যাই থেকে যাবে।

এভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সরকার চালানো হলে একসময় সরকার অচল হয়ে পড়বেই। মিথ্যাচারিতার কারণে কর্তৃত্ববাদী শাসন সর্বত্র বিপজ্জনকভাবে ব্যর্থ হয়। উন্নয়নের মিথ্যা প্রচারণা ব্যর্থ সরকারেরই লক্ষণ। চারপাশের সুবিধাভোগী আমলারা এ কাজে পটু। তারা ক্ষমতাসীনদের জন্য এবং জাতির জন্য চরম হানাহানি ও রক্তপাত ডেকে আনেন। শুধু বিদেশিদের জন্য নয়, আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে সরকারের সাফল্য দেখতে চাই। কিন্তু আমরা এ কথা বলছি না যে, সরকারে যারা যোগ্য লোক রয়েছেন তারা জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সমঝোতার কথা ভাববেন না। আমরা এ কথাও বলছি না যে, এখন যে আঙ্গিকে ও অবস্থায় বিএনপি আছে তার মাধ্যমে কোনো সমাধান সম্ভব। সরকার যতই শত্রু হিসেবে দেখুক না কেন বিএনপি শত্রুতা করার মতো শক্তি রাখে না। সরকারের জনপ্রিয়তাহীনতাই বিএনপির শক্তি। দেশে আসলে সত্যিকার কোনো দলীয় রাজনীতি নেই যার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। রাজনৈতিক সংকটের ভয়াবহতা যখন আমলে নেওয়া হচ্ছে না এবং সমাধানের কথাও যখন তারা জানতে চান না তখন কে কী বলছেন এবং সরকারের ভিতরে কে কী করছেন জনস্বার্থ রক্ষায় তার কোনো গুরুত্ব থাকতে পারে না। আমাদের আদতে চোখ বাঁধা অবস্থায় ভয়ঙ্কর বিপদের এক মৃত্যুফাঁদে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।  যে কথা আমরা বারবার বলেছি এবং আবারও বলছি, জাতি হিসেবে আমরা স্বাধীন ও নিরাপদ জীবনযাপন করার যোগ্যতা রাখি। দেশ স্বাধীন হয়েছে ভারতের সাহায্যে এ কথা সত্যি।  কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা তো আমাদের নিজস্ব, তা মিথ্যা হতে পারে না। সুতরাং আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর