শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আমি ভরা তরী করি ভরাডুবি!

গোলাম মাওলা রনি

আমি ভরা তরী করি ভরাডুবি!

আওয়ামী লীগের ভরা তরী কারা ডুবাচ্ছে এমনতরো বোকা সোকা প্রশ্ন যদি আপনার দুর্বল মস্তিষ্কে উদয় হয় তাহলে আপনি সকাল ৯টার দিকে দোয়েল চত্বর, শিক্ষাভবন, মৎস্যভবন, প্রেসক্লাব এবং পল্টন মোড়ে গিয়ে আপনার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে একটু দাঁড়িয়ে থাকুন। তারপর আবার একটু কষ্ট করুন বিকাল ৪টা থেকে ৬টা অবধি। এ সময়ে আপনি মৎস্যভবন, শিশুপার্ক, শাহবাগ মোড় হয়ে হোটেল শেরাটন পর্যন্ত যান। তারপর বাংলামোটর হয়ে সোজা চলে যান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অবধি।  এবার ফিরতি পথে আপনি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকুন হোটেল সোনারগাঁও মোড়ে। এরপর শেরাটনের সামনে দিয়ে মিন্টো রোডের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবন, কাকরাইল মসজিদ এবং সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে মনের আনন্দে কিছু পান করুন অথবা শরীর হালকা করার জন্য কিছু একটা ত্যাগ বা বিয়োগ করুন। সবশেষে আপনি প্রধান বিচারপতির বাড়ির পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে অফিসার্স ক্লাব, মেট্রোপলিটান পুলিশ সদর দফতর, রমনা থানা, রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালকে ডানে-বামে ফেলে মগবাজার মোড়ে যান। তারপর আরও একটু কষ্ট করে হাতিরঝিল মোড় পর্যন্ত ভ্রমণ করে বাসায় ফিরে আসুন। ভালো করে গোসল করে লিখতে বসুন আওয়ামী লীগের অর্জনসমূহকে নষ্টকারী রাজটীকায় দীপ্ত জয়শ্রীদের কৃতী ও কাহিনী।

লিখতে গিয়ে আপনার বারবার মনে পড়বে বিদ্রোহী কবির অমর কবিতা বিদ্রোহীর অনেকগুলো লাইন। সেক্ষেত্রে আপনার মনে পড়া প্রথম লাইনটি হবে- ‘আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ, আনি ত্রাস সঞ্চারী ভুবনে সহসা, সঞ্চরী ভূমিকম্প।’ এমনটি মনে করার কারণ হলো সকাল ও বিকালে আপনি কিছু উদ্ধত, উচ্ছৃঙ্খল এবং অসৎ প্রকৃতির সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী-এমপি, সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা-কর্মী এবং ছাত্রদের দেখেছেন উল্টোপথে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে দুর্বার গতিতে গাড়ি চালিয়ে যেতে। রাস্তার একপাশ যখন সীমাহীন ট্রাফিক জ্যামে আরও হাজারও মানুষের মতো আপনিও আটকা পড়ে রয়েছেন ঠিক তখন উল্লিখিত শ্রেণির লোকরা বিদ্রোহী কবিতার পাঁচটি লাইন মনে মনে উচ্চারণ করতে করতে আপনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে চলে গেল। আপনি কান খাড়া করতেই ইথার থেকে ভেসে এলো- ‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এমন যা, আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা! আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরত্রীর। আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর- আমি চির-উন্নত শির!’

 

 

ইথারের শব্দ শুনে আপনার পাগল মনের কী যেন কী হয়ে গেল। আপনি উল্টোপথে চলা গাড়িগুলোর আরোহীদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য এগিয়ে গেলেন। দেখলেন- ট্রাফিক আইন অমান্যকারী গাড়িগুলোর বেশির ভাগই পুলিশ বিভাগের। গাড়িতে বসা আরোহীদের বয়স দেখে মনে হলো- তারা এসপি পর্যায়ের কর্মকর্তা, কেউ কেউ রয়েছেন ডিআইজি কিংবা তদূর্ধ্ব পদের। কারও কারও গাড়িতে কর্মকর্তাটি হয়তো একা। আবার কারও কারও গাড়িতে রয়েছেন ওয়াকিটকি হাতে বডিগার্ড বা আরদালি জাতীয় কোনো একজন কর্মচারী। একটু উঁচু পদধারীদের গাড়ির আগে ও পিছে রয়েছে পুলিশের আজদাহা প্রকৃতির প্রটোকল ভ্যান। এসব গাড়ির ড্রাইভার, আরদালি কিংবা আগে পিছে থাকা প্রটোকলের সিপাহিবৃন্দের রং ঢং এবং অঙ্গভঙ্গি দেখলে আপনার পুনরায় মনে পড়ে যাবে বিদ্রোহী কবিতার এই চরণগুলো- ‘আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী। আমি নৃত্য পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই। আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস। আমি আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ। আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে উল্কার, আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার!’

আপনি আপন মনে ভাবতে লাগলেন- অনেক বর্ণ, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী এবং দলমত রয়েছে এই বাংলাদেশে। এগুলোর মধ্যে পুলিশও একটি গোষ্ঠী। এদের সম্পর্কে জনপ্রিয় দুটি প্রবাদ রয়েছে- যথা : ‘পুলিশ বাতাসের গলায় দড়ি দেয়’ এবং ‘মাছের রাজা ইলিশ- জামাইয়ের রাজা পুলিশ’। হঠাৎ আপনার চল্লিশ বছর আগের একটি কাহিনী মনে পড়ল যখন আপনার মনে হতো ইস্ পুলিশের বড় কোনো কর্তা যদি আপনার দুলাভাই হতো। কালের বিবর্তনে আপনি এখন বিবাহ উপযুক্তা কন্যাসন্তানের জনক। ব্যস্ত রাস্তায় দুর্বিষহ যানজটে আটকা পড়ে উল্টোপথে চলা আইন ভঙ্গকরী পুলিশদের নিজের মেয়ের জামাই বানানোর কথা মনে আসতেই আপনি লজ্জা-অপমানে দুমড়ে-মুচড়ে যেতে আরম্ভ করলেন। আপনি উঁকি মেরে উল্টোপথে চলা যাত্রীদের ভাবভঙ্গি দেখার চেষ্টা করলেন। আপনি দেখলেন- গাড়িতে বসা সরকারি কর্তাদের বেশির ভাগই টেলিফোনে কার সঙ্গে যেন রঙ্গরসের কথা বলছেন। কথা বলতে বলতে তারা খুশিতে একবার ডানদিকে কাত হয়ে পড়ছেন এবং আবার পরক্ষণেই হেলে পড়ে যাচ্ছেন বামদিকে। তারা একবার আনমনে গাড়ির ছাদে টোকা দিচ্ছেন এবং পরক্ষণেই সেই হাত গাড়ির সিটের ওপর রেখে বিড়ালের মতো খামছা-খামছি করছেন। তারা কথা বলছেন এবং মুখে অদ্ভুত সব শব্দমালা তৈরি করছেন। এই যাহ্- আর না- মরে যাবো তো- উহুহু-ওয়াও এই জান ওরে আমার কুলু-কুলুরে ইত্যাদি শব্দমালার অর্থ এবং কার্যকারণ না খুঁজেই আপনি উল্টোপথের অন্য যাত্রীদের ভাবভঙ্গির দিকে নজর দিলেন।

আপনি দেখলেন কিছু কিছু যাত্রী টেলিফোনে কাকে যেন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছেন। রাগে এবং ক্রোধে তারা এমনভাবে নিজেদের দেহে কম্পন সৃষ্টি করছেন যে, পুরো গাড়িটিতে সেই দেহ ঝাঁকানির নজির স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাদের ড্রাইভার ও আরদালি ও বসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেলিফোনের অপর প্রান্তের প্রাণীটির জীবনে কেয়ামত ঘটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এসব দৃশ্য দেখে ভয়ে আপনার হাত-পা অবস হয়ে আসতে চায়। ভয় এড়ানোর জন্য আপনি উল্টোপথের আরেক দল যাত্রীর দিকে তাকালেন। যাত্রীরা পিঠ টান টান করে নিজেদের সিটে মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। তাদের দেহ স্থির এবং চোখ দুটো দশ ব্যাটারির টর্চলাইটের মতো জ্বলছে। চোখে-মুখে রয়েছে ক্লান্তির ছাপ। মনে স্পষ্ট হতাশা কিন্তু চোখে ক্রোধের আগুন। তারা ত্রিমুখী অগ্নিতে দহন হতে হতে বীরবেশে উল্টোপথ পাড়ি দিচ্ছেন এবং মাঝেমধ্যে বরফের দেশের উল্লুকের মতো কিম্ভূতকিমাকার ভঙ্গিতে রাস্তার বিপরীত পাশে যানজটে আটকে পড়া হতভাগ্যদের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন।

লিখতে খিলতে এক সময় আপনার হাত ভারি হয়ে এলো। আপনি ভাবতে বসলেন- কেন বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে এত যথেচ্ছতা! এরা কেউ কাউকে মানে না। নিজেদের মধ্যে অসংখ্য গ্রুপ গড়ে তুলে তারা সারাক্ষণ পরস্পরের বিরুদ্ধে রেষারেষি করে যাচ্ছেন। পুলিশ হেডকোয়ার্টার, পুলিশ একাডেমি, মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দফতর, এসপি অফিস এবং থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওসিরা যে কে কাকে মান্য করেন তা কেবল তারাই জানেন। প্রত্যেকটি কর্মকর্তা তার নিজের অফিসকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র একটি বলয় গড়ে তুলেছেন। তার নিজ অফিসের জন্য যদি কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তা বা রাজনৈতিক নেতার আনুকূল্য দরকার হয় তবে কেবল সে ক্ষেত্রেই কর্মকর্তাটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি সীমিত আকারে আনুগত্য প্রকাশ করেন। অন্যথায় চলেন নিজের খেয়ালখুশি কিংবা ইচ্ছেমাফিক। সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের অন্যান্য বিভাগ, অনুবিভাগ, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কিংবা মন্ত্রী, এমপি পদবিধারীদের তারা থোড়াই কেয়ার করেন। তাদের নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেকে বহুদিন ধরে পরস্পরের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেন না। শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিরাও অধস্তন কর্মকর্তাকে ফোন করতে গিয়ে ভাবেন যে, কর্মকর্তাটির বাড়ি কোথায় অথবা তিনি কোন গ্রুপ বা লবি মেইনটেইন করেন এবং তিনি ধরেই নেন যে- তার কথার মূল্য ফিফটি ফিফটি অর্থাৎ হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

ঘটনাটি চট্টগ্রামের বাকুলিয়া থানার অধীন। সাতকানিয়ার একটি ধনাঢ্য পরিবারের যুবতী দুই বোন বহুদিন ধরে পৈতৃক সম্পত্তির ভোগদখল নিয়ে বিবাদ-বিসম্বাদ করে আসছে। কিন্তু কেউ কাউকে পরাজিত করতে পারছে না। বড় বোনটি তার ছোট বোনটিকে নাজেহাল করার জন্য অতি সম্প্রতি তার স্বামীকে তালাক দিয়ে মাস্তান প্রকৃতির দুর্ধর্ষ এক যুবককে বিয়ে করে বসে- যে কিনা পুলিশের খাতায় দাগি আসামি বলে চিহ্নিত। এরপর বড় বোন তার সন্ত্রাসী স্বামীকে ছোট বোনের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে চলে যায় আমেরিকায়। যুবক তার শ্যালিকার স্বামীকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে বাসা ছাড়তে বাধ্য করে এবং স্থানীয় বখাটেদের নিয়ে প্রয়াত শ্বশুরের সম্পত্তি দখলের জন্য শ্যালিকাকে তার ছেলেমেয়েসহ প্রায় গৃহবন্দী করে ফেলে। শ্যালিকা যথাসম্ভব হম্বিতম্বি করে তার প্রতিপক্ষকে দমাতে চেষ্টা করে এবং বাকলিয়া থানায় বিস্তারিত জানিয়ে জিডি এন্ট্রি করে। এরই ফাঁকে শ্যালিকা তার দুলাভাইয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে চট্টগ্রাম ডিবি অফিসের একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারের কাছে উপস্থিত হয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে। সেই কর্মকর্তার অনুরোধে বাকলিয়া থানার ওসি তদন্ত ঘটনাস্থলে গিয়ে কথিত দুলাভাইকে অবৈধ অস্ত্রসহ হাতেনাতে ধরে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে আসামির বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করে। মামলাটি যখন বাকলিয়া থানায় পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করে তখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক মতোই এগুচ্ছিল। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বাড়ি গোপালগঞ্জ। তিনি মুচকি হেসে আসামির শ্যালিকাকে আশ্বস্ত করলেন, চিন্তা করবেন না। শ্যালিকা খুশি মনে বাড়ি চলে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগে নির্বোধের মতো থানার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করল না। ফলে পরের দিন থেকে মহিলাটি পড়ল নতুন এক উটকো ঝামেলায়। পুলিশ আসামিকে কোর্টে চালান দিল না বরং অসুস্থ দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করাল। আসামির শ্যালিকাকে বলতে শুরু করল যে, আসামি নির্দোষ! তাকে ফাঁসানো হয়েছে। এরই মধ্যে আসামির স্ত্রী অনেক কিছু নিয়ে আমেরিকা থেকে এলো এবং থানার কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে এমনসব ব্যবহার করল যে পুরো ঘটনার গণেশ উল্টে গেল। বেচারা শ্যালিকা পুলিশি হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য যার কাছেই যায় সে-ই বলে ওরে বাবা! কার দ্যাশের মানুষ! কিছুই করার নেই। এভাবে চেষ্টা-তদবির করার পর মহিলাটি একদিন পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পেয়ে যায়। শীর্ষ কর্তা তাকে আশ্বস্ত করেন এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি হেডকোয়ার্টার্সের সঙ্গে দেখা করতে বলেন।

শীর্ষ কর্তার কথামতো মহিলাটি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে যায় এবং তার মোবাইলে শীর্ষ কর্তার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। এরপর ডিসি ফোন করেন বাকলিয়া থানায়। থানার ওসি ডিসি হেডকোয়ার্টার্সের ফোন পেয়ে যারপরনাই ক্ষেপে যান। তিনি মহিলাটির চরিত্র, তার স্বামীর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে এমন সব আজেবাজে মন্তব্য শুরু করেন যে, ডিসির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তিনি বিব্রত হয়ে টেলিফোনের স্পিকার বন্ধ করে দেন এবং শেষমেশ বলেন, আপনি কোন আইনে অস্ত্রসহ আটক আসামিকে চালান না দিয়ে এখনো হাসপাতালে জামাই আদরে রেখেছেন! অপর প্রান্ত থেকে ওসি কি বললেন তা বোঝা না গেলেও মহিলাটি ঠিকই বুঝল ‘দ্যাশের মানুষ’ কাকে বলে! সে মলিন বদনে আপন আলয়ে ফিরে এলো এবং শীর্ষ কর্তাকে পুরো ঘটনা জানাল। শীর্ষ কর্তা সবকিছু শুনলেন এবং এতটুকু আশ্চর্য না হয়ে ধীরস্থিরভাবে বললেন- ও! আচ্ছা! তাই নাকি! আমি দেখব ব্যাপারটা, মহিলা বলল- স্যার! আমি কি ঢাকায় আসব আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য! শীর্ষ কর্তা বললেন, ওকে! কাম!

পুলিশের কাণ্ড কারখানা এবং কীর্তিকলাপের সাতকাহন নিয়ে মাথা ঘামাতে ঘামাতে আপনি অপরাধ বিজ্ঞানের কিছু বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠলেন। সমাজবিজ্ঞানীদের নানা রকম তথ্য কথা পড়ে আপনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। আপনার মন এ কথা ভেবে বেশ প্রশান্ত হয়ে উঠল যে, সবকিছুতেই তো জ্ঞানীদের প্রদেয় তথ্য এবং সূত্র মতে চলছে আর প্রকৃতিও ধীরে ধীরে আমাদের সম্ভাব্য নিয়তির দিকে এগিয়েই নিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানীরা বলে গেছেন, মালিক যখন তার কর্মচারীদের দিয়ে অন্যায় এবং অনৈতিক কর্ম করান তখন মালিকরা কার্যত চাকর বনে যান আর কর্মচারীরা ইবলিসের চরিত্র নিয়ে প্রভু হয়ে মালিকের ঘাড়ে চড়ে বসে। এ অবস্থায় কিছু দিন চলার পর প্রকৃতি এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে দেয় যে বিশ্বলোক ওইসব মালিক এবং কর্মচারীর ভারমুক্ত হয়ে যায়।

মালিক কর্মচারীর সম্পর্ক নিয়ে প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের অনুসিদ্ধান্ত জানার পর আপনার মন হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গেল। একটু হাওয়া খাওয়ার জন্য চলে গেলেন হাতিরঝিলে। সেখান থেকে একটু এগিয়ে গুলশান লিংকরোডে হাঁটতে গিয়ে আপনার হঠাৎ করেই স্বল্প পরিচিত এক লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। লোকটির নাম রায়হান চৌধুরী, নাছোড় বান্দা এবং চরিত্রহীন হওয়ার কারণে আপনি অতীতে রায়হান চৌধুরীকে সব সময় এড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু কেন যেন আজ আপনি সেটা করতে পারলেন না। রায়হান আপনাকে বলতে গেলে জোর করেই রাস্তার পাশের একটি ক্লাবের ডিসকো ফ্লোরে নিয়ে গেল। জীবনে প্রথম ঢাকা শহরের কোনো ডিসকো ক্লাবে ঢুকে আপনি যতটা না আশ্চর্য হয়েছেন তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হলেন কিছু যুবককে টাইট জিনস, টি-শার্ট এবং দামি কেটস পরিহিত অবস্থায় ড্যান্স ফ্লোরে মেয়েদের সঙ্গে নাচতে দেখে। আপনি ঢাকার রাজপথে সকালে এবং বিকালে দেখা উল্টোপথের যাত্রীদের কিছু মুখ স্মরণ করে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন।

আপনি গম্ভীর মুখে বসে রইলেন এবং আড়চোখে আশপাশের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। হঠাৎ আপনার চোখ পড়ল গিয়ে ৩০-৩২ বছর বয়সী জমকালো পোশাক পরা অনিন্দ্য সুন্দরী এক মহিলার দিকে। মহিলার রাজকীয় চালচলন এবং অভিজাত ভাবসাব আপনাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করল। মহিলাটি দূর থেকে সম্ভবত আপনার মনের অবস্থা টেরে পেল। সে হেলেদুলে আপনার টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো এবং কাছাকাছি এসে বলল হাই। খুশির আতিশয্যে আপনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন আসসালামু ওয়ালাইকুম ম্যাডাম। রায়হান বেশ বিরক্ত হয়ে আপনাকে টেনে বসাল এবং মহিলাকে ধমক দিয়ে বলল এই..., এদিকে অ্যাইছস ক্যান। মহিলাটি রায়হানের মুখের দিকে বিরস বদনে তাকাল এবং সামান্য সরে গিয়ে অন্য একটি পুরুষের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিল।

আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রায়হান বলল ভাই! মনে কিছু করবেন না। মেয়েটি তৃতীয় শ্রেণির সোসাইটি গার্ল। আগে নিয়মিত নাচত আর পাঁচ-ছয় হাজার টাকা পেলেই আমাদের সঙ্গে রাত যাপন করত। ওর নাম বাতাসা (ছদ্মনাম)। গত তিন-চার বছর ধরে নাচে না। আর আমরাও ওসব পুরনো জিনিসের দিকে তাকাই না। তাই বাতাসা টেবিলে টেবিলে ঘুরে ঘুরে কাস্টমার খোঁজে। রায়হানের কথাবার্তা সম্ভবত বাতাসার কানে পৌঁছাল। সে সোজা রায়হানের টেবিলে চলে এলো এবং বলল বস! একটু বাইরে আসুন। রায়হান ওঠে দাঁড়াল আর আপনিও তাদের অনুসরণ করে ক্লাবের সামনে চলে এলেন। ক্লাবের সামনে পার্ক করা ২০১৫ মডেলের সাড়ে চার হাজার সিসির ঝকঝকে কালো রঙের টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার জিপটি দেখিয়ে বাতাসা রায়হানকে বলল, এই গাড়িটি আমার। গত মাসে কিনেছি পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে।  আমার অতীতের সেই দিন আর নেই। এই শহরের পিলে চমকানো অনেক ক্ষমতাধর আমার কাস্টমার আর আমি এক ঘণ্টার নোটিসে যে কোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখি। বাতাসার কথা শুনে আপনার পায়ে কম্পন শুরু হলো।  আপনি এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে চলে গেলেন হাতিরঝিলে এবং নতুন করে ভাবতে লাগলেন ‘এত উন্নয়নের জোয়ারে কোন শ্রেণির উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি হলো?

লেখক : কলামিস্ট।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর