শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আশুরা ও কারবালার শিক্ষা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আশুরা ও কারবালার শিক্ষা

পবিত্র আশুরা আজ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আশুরা একটি স্মরণীয় দিন। এ দিনেই আল্লাহ পাক পৃথিবী সৃষ্টি করেন। দুনিয়ার প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয় এ দিনে।  শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করায় এ দিনেই হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়াকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নির্বাসিত করা হয়। আল্লাহর নির্দেশ ভঙ্গের অপরাধের ক্ষমা পেতে দিনের পর দিন আহাজারি করেন হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)। মহররমের ১০ তারিখে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন। বিশ্ববাসীদের আদি পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সঙ্গেও ১০ মহররমের সম্পর্ক রয়েছে। রাজা নমরুদ আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেন। আল্লাহর নবীকে আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করতে চেয়েছিল ক্ষমতাদর্পী রাজা। কিন্তু আল্লাহ আশুরার ১০ তারিখে তাঁর প্রিয় নবী ও বান্দাকে রক্ষা করেন আগুন থেকে। হজরত নূহ (আ.)-এর নবুয়তের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ১০ মহররমের স্মৃতি। এ তারিখে মহাপ্লাবন থেকে মুক্তি পায় হজরত নূহ-এর আমলের মানুষ। নূহ (আ.)-এর কিস্তি এই পবিত্র দিনে মাটি স্পর্শ করে। মাটিতে মানুষ আবার আবাদ শুরু করার সুযোগ পায়। হজরত সুলাইমান (আ.) মহররম মাসের ১০ তারিখে তাঁর রাজত্ব ফিরে পান। ফেরাউনের দম্ভ চূর্ণ হয় মহররম মাসের ১০ তারিখে। ফেরাউন মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের মিসর ত্যাগের অনুমতি দিলেও তার বাহিনীকে মুসা (আ.)-এর পেছনে লেলিয়ে দেন। তারা ধাওয়া করে হজরত মুসা (আ.) এবং তাঁর অনুসারীদের। আল্লাহ তাঁর তার প্রিয় নবীকে সে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন। সাগরের মাঝে রাস্তা সৃষ্টি হয় আল্লাহর কুদরতে। সে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যান হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা। ফেরাউন বাহিনী তাদের পিছু নিলে সাগরের পানি তাদের গ্রাস করে। আখেরি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উন্মতদের জন্য ১০ মহররম বা আশুরার দিনটি একটি শোকাবহ দিন। হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম ইরাকের ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার লেলিয়ে দেওয়া বাহিনীর হাতে শহীদ হন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) ও তার অনুসারীরা।

 

 

ইসলামের ইতিহাসে উমাইয়া শাসনামল ছিল এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। চতুর্থ খলিফা ও রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামাতা হজরত আলী (রা.)-এর আমলে খেলাফত নিয়ে হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। ইসলামী খেলাফতের ঐক্যের খাতিরে হজরত আলী (রা.) উমাইয়াদের সঙ্গে সমঝোতায় উপনীত হন। দুই পক্ষের ঐকমত্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় হজরত আলী (রা.)-এর পর খেলাফতের অধিকারী হবেন মুয়াবিয়া (রা.)। তারপর আবার খেলাফত ফিরে যাবে হজরত আলী (রা.)-এর সন্তানদের হাতে। এই সমঝোতার কোনো মূল্য দেয়নি উমাইয়ারা। সমঝোতা অনুযায়ী আওলাদে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে খেলাফত ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে মুয়াবিয়ার ছেলে ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। খেলাফতের নামে চালু হয় রাজতন্ত্র। মদ্যপ ও চরিত্রহীন ইয়াজিদ ক্ষমতায় এসে ইসলামী ঐতিহ্যের মূলে কুঠারাঘাত হানাকে তার কর্তব্য বলে ভেবে বসেন। দামেস্কের রাজদরবারে তিনি যে সিংহাসনে বসতেন, তার পাশে বসানো হয় আরেকটি সিংহাসন। যেখানে বসত তার পোষা প্রিয় বানর। খলিফার সঙ্গে কেউ মোলাকাত করতে এলে ইয়াজিদকে যেমন কুর্নিশ করতে হতো তেমনি সম্মান দেখাতে হতো তার পোষা বানরকে। চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) ও রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.)-এর পুত্র হজরত হোসাইন (আ.) পাপিষ্ট ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তার ৭২ জন অনুসারী ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ইরাকের কুফা যান। সেখানে অবরুদ্ধ হন ইয়াজিদের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনীর হাতে। হজরত হোসাইন (রা.)-কে প্রস্তাব দেওয়া হয় ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলে তাদের সসম্মানে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে দেওয়া হবে। কিন্তু রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় দৌহিত্র সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। মদ্যপ, চরিত্রহীন ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নেওয়াকে তিনি ইসলামের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করেন। কারবালার প্রান্তরে দীর্ঘ এক মাস অবরুদ্ধ রাখা হয় হজরত হোসাইন (রা.) ও তার পরিবারের সদস্যদের। তাদের পানি ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে হজরত হোসাইন (রা.) ইয়াজিদ বাহিনীর প্রতিরোধ ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। তার সহচররাও এতে সমর্থন জানান। ইয়াজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে একে একে শাহাদতবরণ করেন ৭২ জন সহযোদ্ধা। শেষ পর্যন্ত একা অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করেন রসুল দৌহিত্র। একপর্যায়ে তিনি শহীদ হন তাদের হাতে।

কারবালার প্রান্তরে অসত্যের বিরুদ্ধে সত্য সুন্দর ও কল্যাণের লড়াইয়ে হজরত হোসাইন (রা.) প্রাণ হারান। তিনি ইসলামী মূল্যবোধকে জীবনের চেয়েও মূল্যবান ভাবার যে আদর্শ রেখে গেছেন তা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থাকবে। কারবালায় জয়ী হলেও ইতিহাসে ইয়াজিদ ধিকৃত একজন অন্যায়কারী শাসক হিসেবে।  আর হজরত হোসাইন (রা.) যুগ যুগ ধরে নন্দিত হবেন আদর্শবাদিতার প্রতীক হিসেবে।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাচ্ছিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর