সোমবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নেপালে জনগণের জয় ও বিপর্যয়

হায়দার আকবর খান রনো

নেপালে জনগণের জয় ও বিপর্যয়

আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয় ভ‚মিকম্পের ধ্বংসস্ত‚পের ওপর দাঁড়িয়ে যখন দেশটি নতুন করে পুনর্গঠন ও গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছিল ঠিক তখনই মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয় দেশটিকে আরেকবার বড় রকমের ধাক্কা দিল। বহু বছর পর এবারই মাত্র কয়েক দিন আগে হিমালয়ের রাজ্য নেপাল নতুন করে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করেছিল। এটা ছিল সেই দেশের জনগণের বিরাট বিজয়। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক সংবিধানই কিছু কিছু গোষ্ঠীর, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একশ্রেণির কয়েমী স্বার্থের অনুকূলে যায়নি বলে তারা প্রতিশোধ নিতে এবং চাপ সৃষ্টি করতে উদ্যত হয়।  ভারত অঘোষিত অবরোধ সৃষ্টি করেছিল। আর সেটাও নেপালের জনগণের জন্য অবর্ণনীয় দুর্দশা নিয়ে এসেছিল। অবশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবরোধের কথা অস্বীকার করেছেন। গত ১৬ অক্টোবর থেকে অবরোধ উঠে গেছে। দেশটির ভৌগোলিক অবস্থানই তার দুর্ভোগের জন্য বহুলাংশে দায়ী। দেশটি হচ্ছে ইংরেজিতে যাকে বলে Land locked অর্থাৎ কোনো সমুদ্র উপকূল নেই। বিদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, এমনকি যাতায়াত করতে হলেও অপর এক দেশের মাটি ব্যবহার করতে হবে। নেপাল এই ক্ষেত্রে একমাত্র ভারতের ওপর নির্ভরশীল। উত্তরে চীন আছে, কিন্তু চীন ও নেপালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ হিমালয়। চীন অবশ্য নেপালের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তিব্বতের মধ্য দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা তৈরি করেছে। কিন্তু এই রাস্তা এতই দুর্গম যে, স্বাভাবিক চলাচল, বিশেষ করে নিয়মিত ব্যবসা-বাণিজ্য মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। তার ওপর শীতকালে প্রচণ্ড তুষারপাত এবং সমগ্র রাস্তা তুষারাচ্ছন্ন থাকার কারণে সেই সময় রাস্তাটি অচল হয়ে পড়ে।

পূর্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ হিমালয়ের এই দেশটিতে আছে অনেকগুলো স্থানীয় ভাষা ও জাতি। তিন কোটি মানুষের দেশ। ১৭৬৮ সালে গোর্খা রাজা পৃথ্বি নারায়ণ শাহ কাঠমান্ডু জয় করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে নেপালকে একটি রাজ্যে পরিণত করেন। ছোট ও বড় জাতি এবং ট্রাইবের অবস্থান যে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি করেছিল, সেটাই সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এত বিলম্বের কারণ ছিল। নেপালের ইতিহাসে কয়েকবার সংবিধান প্রণয়নের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। পঞ্চাশ ও নব্বই দশকে এক ধরনের সংবিধান তৈরি হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তৃতীয় দফায় সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে। যখন রাজতন্ত্রকে চিরতরে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধের কারণে এতগুলো বছর কেটে গেল। তারা সংবিধান প্রণয়ন করতে পারলেন না। ২০০৭ সালের পর দুবার সংবিধান সভার নির্বাচন হয়েছিল। প্রথমবারের সংবিধান সভা (২০০৮-২০১৩) ঐকমত্যের ভিত্তি বা এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সেবার সংবিধান সভায় সবচেয়ে বড় দল ছিল প্রচন্ডের নেতৃত্বাধীন মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। তবে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি কারোরই আসন ছিল না। নেপালের আরেকটি বড় কমিউনিস্ট পার্টি হচ্ছে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (সংযুক্ত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। সংক্ষেপে বলা হয় ‘এমালে’ অর্থাৎ unified markist-leninist । এ ছাড়া বুর্জোয়া পার্টিগুলোর মধ্যে বড় পার্টি হচ্ছে নেপালি কংগ্রেস। গত সংবিধান সভায় তিনটি বড় দলের মধ্যে সমঝোতা তৈরি হয়নি। এমনকি দুটি বড় কমিউনিস্ট দলের মধ্যেও সংবিধানের ব্যাপারে কোনো সমঝোতা ছিল না। তাই দীর্ঘ কয়েক বছর অপব্যয় করে তারা কোনো সংবিধান রচনা করতে পারেননি। তারপর পুরনো সংবিধান সভা ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন দেন। নতুন সংবিধান সভা ২০১৩ সালে গঠিত হয়েছে এবং এই সভা একটি সংবিধান প্রণয়ন ও পাস করতে পেরেছে মোটামুটি সব বড় দলের সমঝোতার ভিত্তিতে। আমরা এটাকে নেপালের গণতন্ত্রকামী জনগণের বিজয় বলে অভিনন্দন জানাই। নতুন সংবিধানের অধীনে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন CPN (U-ML) এর সভাপতি কমরেড পিকে শর্মা ওলি।

নতুন সংবিধানের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এখানে উলে­খ করা প্রয়োজন। প্রথমত, নেপালকে প্রজাতন্ত্রী বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। অবশ্য ২০০৭ সালে যে সংবিধান সভা গঠিত হয়েছিল, তা সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হলেও যে একটি বড় কাজ করেছিল তা হলো রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করা। পার্লামেন্ট বা সংবিধান সভার প্রথম অধিবেশনেই এটি পাস হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিল। তারা যখন আÍগোপনে থেকে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করছিলেন তখনো তাদের এক নম্বরের কর্মসূচি ছিল রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করতে হবে। ইতিপূর্বে পঞ্চাশ দশকের সংবিধান এবং পরবর্তী নব্বই দশকের সংবিধানে রাজার ক্ষমতা হ্রাস করা হলেও রাজাকে রেখে দেওয়া হয়েছিল, যাকে বলা হয় Constitutional Monercluy । কংগ্রেস এটা মেনে এসেছিল। এমনকি ১৯৯০ সালেও CPN (U-ML) খর্বিত ক্ষমতাসহ রাজাকে রাখার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। অবশ্য U-ML  কে রাজতন্ত্রের পক্ষে মনে করা সঠিক হবে  U-ML একদা চীনপন্থি পার্টি হিসেবেই পরিচিত ছিল এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম ছিল দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরের। একমাত্র মস্কোপন্থি বলে যে ছোট দলটি ছিল তারাই গত শতাব্দীর আশির দশকে রাজার সঙ্গে সহযোগিতা করে এসেছিল। ফলে পরবর্তীতে পার্টি হিসেবে প্রায় বিলীন হয়ে যায়। এদিকে নেপালের সেনাবাহিনী ঐতিহ্যগতভাবে রাজার প্রতি অনুগত। সেই সব কারণে রাজতন্ত্র উচ্ছেদের ব্যাপারটি খুব সহজ ছিল না। রাজতন্ত্র উচ্ছেদ ও প্রজাতন্ত্রের সংবিধান রচনা নেপালের জনগণের জন্য একটা বিরাট সাফল্য বৈকি।

নতুন সংবিধানের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। এর আগে এমনকি নব্বই দশকের সংবিধানেও নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। জনসংখ্যার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিন্দু হলেও সামান্য সংখ্যক বৌদ্ধ ও মুসলমান আছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত হওয়া এবং হিন্দু রাষ্ট্রের বিধান বাতিল করা নিঃসন্দেহে ছিল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ। নেপালের এখনকার সংবিধানে  উত্তরাধিকারের প্রশ্নে নারী-পুরুষের সমনাধিকার দেওয়া হয়েছে। যা আমাদের দেশের আইনে এখনো অনুপস্থিত। সেদিক থেকে তারা বাংলাদেশের চেয়ে অধিকতর প্রগতিশীল।

এবারের সংবিধানের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নেপালের সংবিধানে এবারই সর্বপ্রথম ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামো গ্রহণ করা হয়েছে। সেই দেশে অনেকগুলো জাতি ও ট্রাইব আছে। যারা আবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। একটি জাতি অধ্যুষিত একটি অঞ্চল চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। ফলে জাতি ও ভাষা ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। বস্তুত, এই প্রশ্নে মতপার্থক্য থাকার কারণে ২০০৮ সালে নির্বাচিত গণপরিষদ সংবিধান রচনা করতে পারেনি। বহু আলাপ-আলোচনার পর এবার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এ সমস্যার একটি সমাধান বের করেছে। কিন্তু তাতে বিক্ষুব্ধ হয়েছে দক্ষিণ অঞ্চল দিয়ে বসবাসকারী মাধেসি সম্প্রদায়ের লোকরা। তারা প্রধানত ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশের কিছু অংশের সীমান্ত রেখার পাশ দিয়ে নেপালের সমতল ভ‚মিতে বাস করে। এই একই সম্প্রদায় ভারতেও বাস করে। এই মাধেসি সম্প্রদায়ের লোকজন নেপালের অন্যান্য অঞ্চলেও বাস করে। ইউনাইটেড মাধেসি ফ্রন্ট দাবি করছে যে, যেসব অঞ্চলে মাধেসিরা বাস করেন, সেসব বিচ্ছিন্ন অঞ্চলও একটি প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তারা মনে করেন যে, যেভাবে প্রদেশের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে মাধেসিদের বিভক্ত করা হয়েছে। বস্তুত, তাদের দাবি খুবই অযৌক্তিক ও অবাস্তব। তবে নেপাল সংলগ্ন ভারতের অধিবাসীরাও মনে করে, এই সংবিধান দ্বারা ভারতের এতদিনকার আধিপত্য ক্ষুণ হয়েছে। তাই ভারতের ক্ষুব্ধ জনগণ নেপালের প্রবেশ পথে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এভাবে নেপালের সংবিধানকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে নেপালের একটা সংকট তৈরি হয়েছিল। নেপালকে বিভিন্ন পণ্যের জন্য বিশেষ করে জ্বালানি তেলের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। একদিকে মাধেসিদের বিরোধিতা অন্যদিকে ভারতের অঘোষিত অবরোধের কারণে নেপালের জনগণকে চরম দুর্দশার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। নেপালে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হলো রাস্তা। রাস্তায় চলে গাড়ি, বাস, ট্রাক। তেলের অভাবে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বস্তুত, ভারতের পছন্দ মতো সংবিধান প্রণীত হয়নি বলেই বোধহয় ভারত নেপালকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল। এতে নেপালের জনগণের মধ্যে তীব্র ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে সংকট মোকাবিলায় নেপালি জনগণের মধ্যে যে দৃঢ় ঐক্য (মাধেসি ও কিছু লোক বাদে) দেশপ্রেম দেখা দিয়েছে, তা প্রশংসনীয়।

দুই. নেপাল সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে একটু পেছন দিকে যেতে হয়। ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টপাত করতে হবে। নেপালের রাজতন্ত্র ছিল প্রায় আড়াইশ বছরের পুরনো। দেশটি বরাবরই স্বাধীন ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল ভারতের ব্রিটিশ রাজের ওপর নির্ভরশীল এবং ব্রিটিশ সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ব্রিটিশরা চলে গেলে দেশটি দিল্লির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

নেপালে চল্লিশ দশকে নেপালি কংগ্রেস গঠিত হয়েছিল, যার সঙ্গে ভারতের কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৯৪৯ সালে কমরেড পুষ্পথালের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি। নেপালে রাজতন্ত্র ছাড়াও বংশানুক্রমিক প্রধানমন্ত্রীর ব্যবস্থা চালু ছিল। যাকে বলা হয় রানাতন্ত্র। রানারা রাজার চেয়েও ক্ষমতাবান ছিল। পঞ্চাশের দশকে নেপালের জনগণ অত্যাচারী রানাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিল। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরুর হস্তক্ষেপের কারণে নেপালে রানাতন্ত্র উঠে যায় এবং গণতন্ত্রের শুরু হয়। রাজাকে রেখেই পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। কংগ্রেস নেতা মাতৃকা প্রসাদ প্রধানমন্ত্রী নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৯ সালে প্রথম নির্বাচন হয়। কংগ্রেস বিপুলভাবে বিজয়ী হয়। বিপি কৈরালা ছিলেন প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। সেই সময়ও কমিউনিস্ট পার্টি একটা শক্তিশালী দল হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছিল। নির্বাচিত পার্লামেন্ট সংবিধান রচনার কাজ সম্পন্ন করেছিল। রাজাকে রেখেই পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র ছিল সেই সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সেই সংবিধান কার্যকরী হয়নি। ১৯৬০ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাজা সংবিধান বাতিল করে। সব রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। এভাবে গণতন্ত্রহীন অবস্থায় চলল ৩০ বছর। এই রাজতন্ত্র অবশ্য ভারত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেই চলেছিল। নেপালে ভারতের মুদ্রা প্রকাশ্যে সর্বত্র চলে। নেপালের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয় বুর্জোয়ারা। সেই দেশের তরাই অঞ্চলের উকৃষ্ট কৃষি জমি এবং নেপালের অন্যান্য অঞ্চলের সম্পদের বড় অংশ ভারতীয়দের দখলে। ১৯৮৯ সালে নেপালের তৎকালীন রাজা চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক দৃঢ় করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এতে তৎকালীন ভারত সরকার রুষ্ট হয়ে এবারের মতোই অবরোধ সৃষ্টি করেছিল। তখনো জ্বালানি সংকটে নেপালিদের জীবনে দুর্বিষহ অবস্থা তৈরি হয়েছিল।

ব্রিটিশ আমল থেকে নেপাল ও ভারতের মধ্যে এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক চলে আসছে। দুই দেশের মধ্যে চলাচলে পাসপোর্ট-ভিসার দরকার হয় না। অবাধ ব্যবসা চলে। দুই দেশের নাগরিক দুই দেশে ব্যবসা ও চাকরি করতে পারে। এতে অবশ্য ভারতীয় বুর্জোয়ারাই লাভবান হয়। আর ঠিক এই কারণে নেপালের সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ভারতবিরোধী মনোভাব কাজ করে। যদিও নেপালের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

১৯৯০ সালে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন তৈরি হয়েছিল। রাজা কিছুটা পিছু হঠতে বাধ্য হন। তিন দশক পর প্রথম প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ এলো। পঞ্চাশ দশকের পর ১৯৯১ সালে প্রথম নির্বাচন হলো। রাজাকে রেখে কিন্তু ক্ষমতা খর্বিত করে সংবিধান রচিত হলো। তারপর এক দশকের বেশি সময় ধরে সংবিধান অনুযায়ী কয়েকবার নির্বাচন হয়। U-ML (কমিউনিস্ট পার্টি) এবং কংগ্রেস কয়েকবার সরকার গঠন করেছে। নানারকম সরকারের ওঠানামা হয়েছে। এর মধ্যে এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে নিহত হলেন রাজা বীরেন্দ্র বীরবিক্রম শাহ দেব। নতুন রাজা হলেন তার ভাই জ্ঞানেন্দ্র বীরবিক্রম শাহ দেব। ২০০২ সালে। তারপরই তিনি রাজনৈতিক দল কার্যত নিষিদ্ধ করে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হাতে নিলেন। ঠিক এরকম সময় আরেকটি সশস্ত্র কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যুদয় ঘটে। যারা মাওবাদী বলে পরিচিত। তারা নেপালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সশস্ত্র গেরিলা এলাকা গড়ে তুলেছিল। তবে সশস্ত্র বিপ্লব সম্পন্ন করতে হয়নি। তার আগেই এক নাগরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আবার রাজার পতন ঘটে। এই অভ্যুত্থানে সব কমিউনিস্ট পার্টি ও বুর্জোয়া দল কংগ্রেস অংশগ্রহণ করে। নেপালের জনগণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ছিনিয়ে নিয়ে আসে।  রাজা বাধ্য হয় নির্বাচন দিতে। ২০০৭ সালে নির্বাচন হয়। ২০০৮ সালের ২৮ মে নির্বাচিত পরিষদের প্রথম অধিবেশনে রাজতন্ত্রকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। ২৪০ বছরের পুরনো রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। তারপর এই বছর আবার নতুন সংবিধান রচিত হয়েছে।

নেপালের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কয়েকটি- ১. গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ঐতিহ্য ২. কমিউনিস্টদের ব্যাপক প্রভাব। বলা হয় সব কয়টি কমিউনিস্ট পার্টি মিলিয়ে তাদের ভোট সংখ্যা হচ্ছে মোট ভোটের ৬৫ শতাংশ ৩. নেপালের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও আধিপত্য ৪. ছোট-বড় বিভিন্ন জাতি, ট্রাইবের অস্তিত্ব, যে জন্য ফেডারেল পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা জরুরি হয়ে উঠেছে। তবে লক্ষণীয় জাতি, ভাষা, ট্রাইগত পার্থক্য সত্তে¡ও নেপালি জনগণের মধ্যে দারুণ ঐক্যবোধ ও দেশপ্রেমিক চেতনা আছে। অনেক ওঠানামার মধ্য দিয়ে আমাদের মতোই দরিদ্র দেশ গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে ভারতের অবরোধ হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও সেখানে তৎপর রয়েছে। ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা আছে।  তা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিশালী অবস্থান কিছুটা বিস্ময়কর মনে হয় বৈকি।  অনেক ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা, পশ্চাৎপদতা সত্ত্বেও নেপালের জনগণ যে অগ্রসর হচ্ছে গণতন্ত্র ও শোষণ মুক্তির পথে তা আমাদের উৎসাহিত করে, উজ্জীবিত করে, অনুপ্রাণিত করে।

 লেখক : রাজনীতিক।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর