শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

যুবকদের আশাবাদী হতে হবে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

যুবকদের আশাবাদী হতে হবে

ইসলামী জীবন ব্যবস্থা একটি সাময়িক ব্যবস্থা নয় বা কোনো পরিবেশ ও কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য আসেনি, এসেছে বিশ্বমানবতার জন্য আর ইসলাম সর্বক্ষণই এই মানব গোষ্ঠীকে হতাশামুক্ত রাখতে চেয়েছে। কোরআন বলছে, নামাজ সমাপ্ত হলেই জীবিকা অন্বেষণের জন্য ছড়িয়ে পড়। আর মানুষ সর্বক্ষণ কর্মব্যস্ত থাকলে হতাশাগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না। বিশেষ করে আমাদের দেশের যুবক ও তরুণ সমাজকে বলব যে, আমাদের আজ হতাশাগ্রস্ত হলে চলবে না। প্রকৃতপক্ষে যিনি আল্লাহকে প্রভু, রসুল (সা.)-কে নবী, ইসলামকে দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছে তার কি কোনো হতাশা থাকতে পারে? না আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না। অবশ্যই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। মূলত হতাশা ও নিরাশা হলো শয়তানের বৈশিষ্ট্য। শয়তানের এক নাম ইবলিস, যার অর্থ হলো ‘নিরাশ’ বা ‘হতাশ’। সুতরাং ‘হতাশা বা নিরাশা’ শয়তানের বৈশিষ্ট্য। আর ‘আশা’ হলো নবী রসুল ও আল্লাহর নিয়ামতপ্রাপ্তদের বৈশিষ্ট্য। দুনিয়ায় যত আম্বিয়ায়ে-কেরামগণ এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই দৃষ্টি জোড়া বিপদকে মাথায় নিয়েও তাঁর পথে অটল রয়েছেন। হতাশা কখনো তাঁদের পথরোধ করে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ তাঁরা জানতেন যে, আল্লাহর মহানত্বের সামনে এ ধরনের আপদ-মুসিবত একেবারেই তুচ্ছ। আশার মধ্যেই মানুষ বেঁচে থাকে। আশার কারণে মানুষ কাজ করে, কথা বলে, পথ চলে। আশা মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তির চাকাকে সচল রাখে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক পেশাগত জীবনে আশা না থাকলে মানুষ অসামাজিক এক আজব জীবে পরিণত হয়। আশা সফলতার মূল চাবিকাঠি। মনে রাখা প্রয়োজন, আশা ঈমানের সঙ্গেও  সংশ্লিষ্ট। তাওয়াক্কুলের প্রবল বিশ্বাস ছাড়া মানুষ আশা করতে পারে না। অর্থাৎ আশা তাওয়াক্কুল থেকে আর তাওয়াক্কুল মজবুত ঈমান থেকে জাগে। হতাশা বা নিরাশা এমন এক ক্ষতিকর বদগুণ যা মানুষের সব যোগ্যতাকে সমূলে ধ্বংস করতে চায়। হতাশাগ্রস্ত এই ব্যক্তিটি পরিবারের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে যেমনভাবে বিনষ্ট করে, তেমনি সমাজ ও পেশাগত জীবনে একজন অযোগ্য, অকর্মণ্য দায় হিসেবে চিহ্নিত হয়। হতাশা এমনভাবে ঘিরে ধরে যে ঢিলেমি তাকে সামনে চলার সব পথকে রুদ্ধ করে দেয়। হতাশার আর একটি বড় প্রভাব হলো, হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি সব কাজে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। নেতিবাচক অভিব্যক্তি তার অভ্যাসে পরিণত হয়। এ ধরনের ব্যক্তিরা নেতিবাচক মনোভাব প্রচ্ছন্ন ও অপ্রচ্ছন্ন দুভাবে প্রকাশ করে। একটি ভালো কাজের প্রতি সবাই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে, কিন্তু ওই ব্যক্তি যে হতাশা রোগে আক্রান্ত, সে তার মনোভাব এমনভাবে প্রকাশ করবে, প্রাথমিকভাবে বোঝা যাবে না সে নেতিবাচক নাকি ইতিবাচক। কিন্তু একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, প্রচ্ছন্নভাবে সে নেতিবাচক মনোভাবই প্রকাশ করেছে। এ ধরনের ব্যক্তিরা নিজেরা তো সফলতার মুখ দেখতে পায়ই না, অধিকন্তু তারা অন্যেরও সফলতাকে সহ্য করতে পারে না। হতাশা আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের বেলায়ও অবহেলা প্রকাশ করতে বাধ্য করে। এমনকি একপর্যায়ে নিজের বিফলতা বা ব্যর্থতার জন্য আল্লাহকে দোষারূপ করতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না। সে মনে করে ওই সফলতার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চেয়ে সে-ই যথোপযুক্ত ছিল। তাকে না দিয়ে অন্যায় করা হয়েছে। ফলে সে তার পারিপার্শ্বিক সব কিছুকেই দোষারূপ করতে থাকে। এই মনোভাবের কারণে সবার সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সামাজিকভাবে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে তার মধ্যে সংশয় দানা বেঁধে উঠে। হতাশা নামক এই ঘাতককে দূর করার জন্য প্রথমত আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বেশি বেশি করে কোরআন, হাদিস অধ্যয়ন করতে হবে। কারণ আল-কোরআনে আশার কথাই বেশি বেশি বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। আজ থেকে আমাদের মনে করতে হবে যে, আমরা হব জ্ঞানের সেবক; মহা মানুষকে অনুসরণ করাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য- মিথ্যা ও পাপের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই ধর্ম। আমাদের হাতে ঘড়ি নেই, গায়ে দামি জামা নেই, পায়ে বিলেতি জুতা নেই তাতে কি আমাদের ভিতরে মহত্ত্ব আছে, আছে মমত্ববোধ যার দ্বারা আমরা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিব।

 

 

 যুবকগণই হবে আগামীদিনের রাহবার। তাই জীবনের প্রথম থেকে ঠিক করে নিতে হবে যে সে কোন কাজের জন্য উপযুক্ত, এরপর কর্মে মন ঢেলে দিতে হবে, প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে হবে যে, আমি কৃতকার্য হবই। সংশয় ও অবিশ্বাস মন থেকে মুছে ফেলতে  হবে। আমরা জানি ২০ বছর পরিশ্রম করে নিউটন একটি বই লিখেছিলেন, তার প্রিয় কুকুর একটি জ্বলন্ত বাতি ফেলে বইটি মুহূর্তের মধ্যে ছাই করে দিয়েছিল। ২০ বছরের পরিশ্রম-চিন্তা হঠাৎ সর্বনাশ হয়ে গেল। নিউটনের খুব দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য কী ধৈর্য। তিনি দমলেন না, আবার সেই লেখা আরম্ভ করলেন এবং শেষ করলেন।

কারলাইন ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস লিখে এক প্রতিবেশী সাহিত্যিককে পড়তে দেন। বন্ধু মহোদয় বইটি ভুলবশত বাইরে ফেলে রাখেন। ফলে বইটি হারিয়ে গেল। জানা গেল বাড়ির চাকরানী বাজে কাগজ মনে করে মূল্যবান গ্রন্থটি পুড়ে ফেলেছে। কারলাইন যখন এই ভয়ানক সংবাদ শুনলেন, তখন তার মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ হলো, কঠিন অধ্যবসায় এবং মনের বলে তিনি আবার সেই বই লিখলেন। সুধী পাঠকদের বলব, আসুন আমরা মহামানুষের জীবনী পড়ি। তাহলে মহামানুষ হতে ইচ্ছা হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গাড়ি ঘোড়ায় যে চড়ে, প্রাসাদে যে বাস করে, যার মাথা দিয়ে কুসুমের গন্ধ বেরুতে থাকে, ইঙ্গিতে যার ১০ জন দাস-দাসী  চলে আসে, মানুষের ঘাড়ে চড়ে যে মানুষকে দিয়ে জুতা খোলায়, মানুষের ঘাড়ে চড়ে যে হাওয়া খায় তাকে দেখে তুমি দমে যেও না। এই সামান্য খ্যাতি বা অর্থসম্পদ জীবনের উদ্দেশ্যে নয়। অন্যায় ও মিথ্যার ওপর যে সম্পদের ভিত্তি সে অর্থ আমাদের ঘৃণায় বনজঙ্গলে ফেলে দিতে হবে। ধোঁকা দিয়ে অর্জিত রুটি প্রথমে মিষ্টি মনে হয়ে থাকলেও পরিশেষে সে রুটি পাথরে পরিণত হয়।  অসৎ আনন্দের চেয়ে সৎ বেদনাকে বেছে নিলে আমরা সফলতার শীর্ষে পৌঁছতে পারব। 

লেখক : বিশিষ্ট মোফাচ্ছেরে কোরআন ও খতিব : হাতিরপুল বায়তুল মোমিন জামে মসজিদ, ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৫। 

E-mail: [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর