রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গমের বস্তায় গণতন্ত্র বন্দী করার ফন্দি!

কাজী সিরাজ

গমের বস্তায় গণতন্ত্র বন্দী করার ফন্দি!

পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্রের আলোর রেখা দেখা গিয়েছিল চুয়ান্ন সালের সাধারণ নির্বাচন এবং তাতে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ের পর। কিন্তু সেই বিজয়, ছাপ্নান্ন সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন এবং গণতন্ত্রের পথে সেই নতুন রাষ্ট্রটির অভিযাত্রা থেমে যায় সামরিক একনায়ক জেনারেল আইউব খানের সামরিক আইন মার্শাল ল’ জারি এবং ক্ষমতা দখলের পর।  জনগণের চিরন্তন গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা চ‚র্ণ করতে সব গণতান্ত্রিক দল, গোষ্ঠী, শক্তি ও ব্যক্তির টুঁটি চেপে ধরেছিলেন জেনারেল আইউব। জেল-জুলুম, নির‌্যাতন-নিপীড়নকে নিত্যসঙ্গী করেই কখনো সরবে, কখনো নীরবে চালু ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংগ্রাম। দিনে দিনে সামরিক স্বৈরাচার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রশক্তি তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসও যখন তাদের ক্ষমতাকে নিরাপদ করতে পারছিল না, তখনই আইউব এবং তার সামরিক-বেসামরিক পরামর্শকদের মাথায় বাসা বাঁধে দুষ্টবুদ্ধি। পায়ের নিচে মাটির সন্ধানে তারা নজর দেয় তৃণমূলে। সেখানে তৈরি করতে চায় সহায়ক শক্তি। তত্ত¡ হাজির করে, পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা যে গণতন্ত্রের কথা বলছেন, তা প্রকৃত গণতন্ত্র নয়, এই গণতন্ত্র তাদের ভোগের গণতন্ত্র। এতে তাদের উন্নতি হবে, রাষ্ট্র ও জনগণের উন্নতি হবে না। রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে উন্নয়নের ভিন্ন রাজনীতি করতে হবে এবং গণতন্ত্রকে ছড়িয়ে দিতে হবে তৃণমূলে। রাষ্ট্রকর্মে সংযুক্ত করতে হবে তৃণমূল জনগণের প্রতিনিধিদের। জাতীয় পরিষদের ৩০০ এবং দুই প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০+৩০০ প্রতিনিধির শাসন জনগণের শাসন ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করে না। আইউব আবিষ্কার করলেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ (বেসিক ডেমোক্রেসি) বা বুনিয়াদী গণতন্ত্র’ তত্ত¡। দুই প্রদেশের ইউনিয়ন বোর্ড, পরে ইউনিয়ন পরিষদ ও শহরের মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান-মেম্বার যারা বিডি মেম্বার বলে পরিচিত ছিলেন সমন্বয়ে ৮০ হাজার স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধির ব্যবস্থা করলেন। এই ৮০ হাজার বিডি মেম্বার-চেয়ারম্যানকে তখন কৌতুক করে বলা হতো ‘আশি হাজার ফেরেশতা’। এদের হাতে উন্নয়নের নামে টাকা গেল, গম গেল, ঢেউটিন আর কম্বলও গেল। কিছু লোক খুঁজে পেলেন আইউব তার প্রশস্তি গাইবার জন্য। পালন করলেন উন্নয়ন দশক। গণবিচ্ছিন্ন স্বৈরশাসকরা চিরকাল এভাবেই তৃণমূলে শক্তি খোঁজে। কিন্তু ইতিহাস বলে, এই মেকি ও দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতার প্রাচীর খুবই দুর্বল হয়। যখন ‘ঝড়’ ওঠে, সব বালির বাঁধের মতো উড়ে যায়। প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমান ক্ষমতাসীনরাও কি সেই পথেই হাঁটছেন? বলে রাখা দরকার,  আশি হাজার ফেরেশতা’ কিন্তু আইউব খানকে রক্ষা করতে পারেনি।

দলীয় ভিত্তিতে এবং দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সরকার। মন্ত্রিসভা এ সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন করে দিয়েছে। এখন একদিকে চলছে দ্রুত আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া এবং সমানতালে নির্বাচন কমিশনে চলছে একই বিষয়ে বিধিমালা সংশোধনের তড়িঘড়ি। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, জাতীয় এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লীগ সরকার একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল দেশের অন্যান্য জনসমর্থিত ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল, দেশের সুশীল সমাজ এবং বিষয়Ñ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়াই। সরকারের ধামাধরা দুই মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনু ছাড়া ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলখ্যাত জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও এতে সন্তুষ্ট নন বলে তার আক্রমণাÍক কথাবার্তায় মনে হচ্ছে। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিধি সংশোধনের অতি জরুরি বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দল, পর্যবেক্ষক সংস্থা ও সুশীল সমাজের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনও কোনো ধরনের আলাপ-সংলাপের তাগিদ অনুভব করছে না। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করতে হলে যারা কোনো দল করেন না, পুরনো কোনো দলে যেতেও চান না, তাদের নতুন দলের নিবন্ধন দেওয়ার ব্যাপারেও নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে নির্বাচন কমিশন। তাহলে নির্দল এই লোকগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার যে খর্ব হচ্ছে, সে ব্যাপারেও নির্বাচন কমিশনের কোনো জবাব নেই। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিতে তারা যেন ‘মূক’ ও বধির। পৌর নির্বাচনের তারিখ অতি সন্নিকটে, এই অজুহাত দেখিয়ে ইসি সব বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ এর আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের ব্যাপারে এই নির্বাচন কমিশনই নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক এবং পর্যবেক্ষকদের নিয়ে সংলাপের আয়োজন করেছিল। স্থানীয় সরকার নির্বাচন পদ্ধতিতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কারও সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করার বিষয়টিকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না সরকার ও নির্বাচন কমিশন। এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, সরকার যে পথে হাঁটছে, নির্বাচন কমিশনও হাঁটছে একই পথে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন লীগ সরকারের অনুগত বলে সরকারবিরোধী পক্ষ (গৃহপালিত বিরোধী দলের কথা বলা হচ্ছে না) যে অভিযোগ করে, তা সত্য বলে আবারও প্রমাণ করছে তারা। নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। আইন পাস হয়ে যাচ্ছে, এটা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। আমরা সেই আইনের আলোকেই বিধিমালা সংশোধন করব। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধির আলোকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিধিমালা সংশোধনের চিন্তা করছি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয়ভাবে হয়, এখন থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয়ভাবে হবে।

তাড়াতাড়ি এ বিধিমালা সংশোধন করতে হবে। কারণ ডিসেম্বরে পৌরসভা নির্বাচন, নভেম্বরে তফসিল দিতে হবে। এর আগেই শেষ করতে হবে সংশোধনী সংক্রান্ত কাজ। (দৈনিক যুগান্তর, ২২ অক্টোবর ২০১৫)। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে, দলীয় প্রতীকে (নিবন্ধিত দল ছাড়া বাকিরা গোল্লায় যাক) নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রশ্নে দ্বিতীয় চিন্তার সব দুয়ারই বন্ধ। সুশীল সমাজ, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল লীগ সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রচণ্ড বিরোধিতা করছে। প্রতিদিনই সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হচ্ছে, সরকারি সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা তুলে ধরা হচ্ছে। গত ২৫ অক্টোবর সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ম্যাব) আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এ অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রাজনৈতিক-প্রশাসনিক যে প্রস্তুতি ও পরিবেশ দরকার, বর্তমানে দেশে তা নেই। তাই তড়িঘড়ি না করে জাতীয় পর‌্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এমনকি চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিষয়টি পরীক্ষামূলকভাবে অনুশীলন করা যেতে পারে।’ সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাখাওয়াত হোসেন আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন, নীতিগতভাবে তিনি দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধী নন। কিন্তু আগামী ডিসেম্বরে পৌরসভা নির্বাচন। মার্চ-এপ্রিলে ইউপি নির্বাচন, যা সবচেয়ে কঠিন। দলীয়ভাবে এসব নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনের যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, তা এই সময়ের মধ্যে নেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভাব্য প্রার্থী, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দলের তৃণমূল নেতৃত্ব, এমনকি ভোটারদেরও নতুন পদ্ধতির নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। তিনি আরও একটি সত্য কথা বলেছেন যে, ‘সাধারণভাবে জনগণ নির্বাচনের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এর মধ্যেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ অনেক স্বতঃস্ফ‚র্ত হয়। কারণ এ নির্বাচনে একই বাড়িতে একাধিক প্রার্থীও থাকেন। পাড়া-প্রতিবেশী, আÍত্নীয়স্বজন, পছন্দের লোক তো থাকেনই। তাই এ নির্বাচন দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে অনুষ্ঠিত হলে মানুষের ঘরে ঘরে সংঘাত ছড়িয়ে যেতে পারে।’ সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন,দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো যুক্তি নেই। এটা করা হলে যেটুকু গণতন্ত্র টিকে আছে তারও কবর রচিত হবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকারে দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। নারীর ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত হবে। সরকারি দলের বাইরে খুব কম প্রার্থী পাওয়া যাবে, প্রার্থীদের মানও কমবে।’ বাংলাদেশে নির্দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। ইউনিয়ন বোর্ড/ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের সব পর‌্যায়ের নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হতো। স্থানীয় সরকার কাঠামোগুলো ছিল স্থানীয় উন্নয়নের মাধ্যম। কোথাও কোনো প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সবার ন্যায়সঙ্গত সেবা নিশ্চিত করতেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে, বিশেষ করে তৃণমূলের ইউনিয়ন বোর্ড বা বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদে নির্দলীয় প্রকৃত জনসেবকরা প্রতিদ্বদ্ন্বিতা করতেন, ভালো মানুষরা জনগণকে সেবা দিতে আগ্রহী হতেন এবং বহু ক্ষেত্রে স্থানীয় জনসাধারণ নির্দল ভালো মানুষটিকেই বেছে নেওয়ার সুযোগ পেতেন তাদের প্রতিনিধিরূপে। আগে এসব নির্বাচন ছিল জনগণের উৎসব। সংঘর্ষ-হানাহানির খবর আসত খুবই কম। কিন্তু রাজনৈতিক দল ব্যবস্থায় অন্তর্দলীয় ও আন্তঃদলীয় বহু সমীকরণ ও সম্পর্ক এসব নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে বাধ্য। যখন শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা জাতীয় স্তরের মতো তৃণমূল স্তরেও আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মূল নিয়ামক হয়ে ওঠে, তখন এ ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি করায়ত্ত করার প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বদ্ন্বিতা হিংসাÍক এবং ক্ষেত্রবিশেষে  সাংঘর্ষিক ও প্রাণঘাতীও হয়ে যেতে পারে। সরকার কি তা জানে না? আলবৎ জানে। তবু কেন তারা কারও সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনার তোয়াক্কা না করে দলীয় ভিত্তিতে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের এ ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে সে আলোচনায় যাওয়ার আগে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের একটি রায়ের অংশবিশেষের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ১৯৯২ সালে উপজেলা সংক্রান্ত এক মামলার রায়ে তিনি বলেছিলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দলীয় (পার্টিয়ার্কি অর্থে) রাজনীতি বা স্বৈরশাসকদের অশুভ রূপকল্পের (ইভিল ডিজাইন) শিকার হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে সরকারি কর্মকর্তা কিংবা ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত চাকর-বাকর (হেনশম্যান) দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এটাই যদি করা হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান থাকা বা না থাকার কোনো মানে থাকে না। এতে তারা যে সময়ে সময়ে পরিবর্তন আনে, তা জনগণ ও আন্তর্জাতিক নেতাদের ধাপ্পা দেওয়ার জন্য। সভ্যতার এ পর‌্যায়ে স্বৈরশাসক তা তিনি হোন রাজনৈতিক নেতা বা সামরিক ব্যক্তি, তারা বিশ্বময় নিন্দা ও হাসিঠাট্টার পাত্র। একটি স্বৈরশাসন দেখতে যতই শক্তিশালী মনে হোক, তারা চেতনাগতভাবে অত্যন্ত দুর্বল এবং জনবিচ্ছিন্ন থাকে। এ বিচ্ছিন্নতার মধ্যে তাদেরও ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ার ঝুঁকি থাকে। সুতরাং স্বৈরশাসকরা এক ধরনের রাজনৈতিক ভিতের প্রত্যাশী হয়। আর সেই উদ্দেশ্যে প্রকৃত গণতন্ত্র (!) প্রতিষ্ঠার জন্য তারা গ্রাম, ইউনিয়ন ও থানায় ছুটে যায়। তৃণমূল পর‌্যায়ে, অর্থাৎ ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড লেভেল তথা গ্রাম পর‌্যায়ে নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে ও দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রকে রাষ্ট্র কাঠামোর একেবারে সর্বনিæ স্তরে বিস্তৃত করার একটি প্রগতিশীল ধারণা বলে ধরে নিতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্র কাঠামোর উপরে-নিচে, প্রশাসনে এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের অর্থবহ চর্চা ও অনুশীলন নেই, জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে (সরকার গঠন করতে প্রয়োজন ১৫১ জনের সমর্থন) সরকার সমর্থকরা সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যক্ষ নির্বাচনের শর্ত লঙ্ঘন করে কথিত  সমঝোতার জাদুমন্ত্র বলে বিনাভোটে এমপি হয়ে যান, বাকি ১৪৭ আসনেও আদর্শ নির্বাচন হয় না, সেই সংসদ সদস্যদের সমর্থিত সরকার গণতন্ত্রকে তৃণমূলে ছড়িয়ে দেওয়ার ‘শুভ কামনায়’ দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন দিচ্ছেনÑ এ বিষয়ে জনমনে সন্দেহ-সংশয় জাগতেই পারে। এখানেই আসে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের উপরোল্লিখিত রায়ের অংশবিশেষের প্রাসঙ্গিকতা। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচিত দলীয় প্রতিনিধি থাকলে রাজনৈতিক সংকট কিংবা জাতীয় নির্বাচনে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা যাবে, তৃণমূলে একটা ভিত্তি নির্মিত হবেÑ দলীয় ভিত্তিতে ও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার পেছনে সরকারের মধ্যে এ বিবেচনা কাজ করতে পারে। এটা সরকারের জনবিচ্ছিন্নতার দৌর্বল্যেরই প্রকাশ। প্রকৃত বিরোধী দলের বিপন্ন দশা এবং প্রশাসনের প্রায় সর্বত্র শক্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকার সুবাদে নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান সময়টাকে সুচতুরভাবে সরকার বেছে নিয়েছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন। এই সিদ্ধান্তে উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সরকার এবং সরকারি দলের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার একদিকে বলছে তারা গণতন্ত্রের এতটাই পুজারি যে, তা তারা তৃণমূল পর্যন্ত নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর; অন্যদিকে তারস্বরে বলা হচ্ছে, আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র। কোনটা ঠিক? দুটো তো একসঙ্গে ঠিক হতে পারে না। একেই তো বলা হয় ‘ডবল স্ট্যান্ডার্ড। কৃতকর্মের জন্য বা কর্মদোষে কোনো সরকার সমর্থন হারিয়ে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে সরকারটি যদি প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের ব্যবস্থা করে মেয়াদ ফুরানোর আগেই নির্বাচন দিয়ে। তাতে হয় পুনরায় ক্ষমতায় আসে, নতুবা নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ পন্থায় সম্মানজনকভাবে একটা নিরাপদ ‘বহির্গমন পথ’ পায়। কিন্তু সরকারটি যদি অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বা সামরিক সরকার হয়, তারা ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা ভিত খোঁজে তৃণমূলে। যে ইউনিয়ন পরিষদ পল­ত্নী উন্নয়নের রাষ্ট্রীয় প্রান্তিক স্তর, সেখানে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। তাদের ‘গমের বস্তায়’ দলবন্দী করার ফন্দি খোঁজে সরকার। তাদের মাধ্যমে পায়ের নিচে মাটি কিনতে চায়। মনে হচ্ছে লীগ সরকার এ ব্যবস্থাটাকে খুব জরুরি মনে করছে। আইয়ুব খানও পাকিস্তান আমলে ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্রের’ নামে ৮০ হাজার ‘ফেরেশতাখ্যাত’ বিডি সদস্যের ওপর ভর করেছিলেন একথা শুরুতেই উল্লেখ করেছি। এই শক্তিবলে তৎকালীন পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এবং সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহকে ছলে-বলে-কৌশলে হারিয়েও দিতে পেরেছিলেন; কিন্তু ‘গদি’ দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেননি। কাজেই সরকার যদি ক্ষমতা চিরস্থায়ী না হোক, অন্তত দীর্ঘস্থায়ী করার মতলবেও ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, আখেরে তা ভালো ফল নাও দিতে পারে। দলীয় ভিত্তিতে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ মুহূর্তে নানাবিধ বিপদ দেখা দেওয়ারও সম্ভাবনা আছে। জনপ্রিয়তার দিকে বিবেচনা করলে গত প্রায় সাত বছরে লীগ সরকার খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই বলেই ধারণা করা হয়। সেক্ষেত্রে দলীয়ভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত তাদের জন্য বুমেরাং হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সেই পরিস্থিতিতে জোরজবরদস্তি করে ফল পক্ষে আনার প্রবণতা দেখা যেতে পারে। সংঘাত-সংঘর্ষেরও সম্ভাবনা থাকবে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং সবার অংশগ্রহণমূলক হবে, তেমন আশা করা যায় না। এ পদ্ধতিতে নির্বাচনে সরকারি যে উদ্দেশ্যের কথাÑ তৃণমূলে পায়ের নিচে মাটি খোঁজা। উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিশ্চিত করার জন্য সরকার চাইবে না প্রকৃত বিরোধী দল ভালোভাবে পূর্ণ শক্তিতে নির্বাচনে আসুক। হঠাৎ করে সারা দেশে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি অভিযান এই সন্দেহকে জোরদার করে। বিএনপি-জামায়াতের লোকরা আবার ঘরবাড়ি ছাড়তে শুরু করেছে। মাস ছয়েক এভাবে দৌড়ের ওপর রাখতে পারলেই তো সরকারের ‘কেল্লাফতে’। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে ভোটকেন্দ্র দখলের পুরনো খেলা আবার দেখা যেতে পারে। জনগণ চাইলেও নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে না শান্তিপূর্ণ পরিবেশের অভাবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়করণের ফলে দলগত রেষারেষিই শুধু বাড়বে না, দলের অভ্যন্তরেও মারাÍক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। দলীয় মনোনয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ কোন্দল ওয়ার্ড ও গ্রাম পর‌্যায়েও ছড়িয়ে পড়বে। শাসক দলের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথার্থ ভ‚মিকা পালন করতে পারবে না। ফলে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির আশঙ্কা আছে।  সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা চলে, দলীয়ভাবে দলীয় প্রতীকে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের ‘৮০ হাজার ফেরেশতার’ মতো প্রায় ৫০ হাজার ‘ফেরেশতা’ (৪,৪৫০ ইউনিয়ন পরিষদে ৯টি করে ওয়ার্ডে চেয়ারম্যান কমিশনার মিলে ৪৫.৫০০ এবং ৪৮৮ উপজেলা চেয়ারম্যান, পুরুষ-মহিলা দুজন ভাইস চেয়ারম্যান পৌরসভার মেয়র-কমিশনার সব মিলে) হয়তো বানিয়ে আনতে পারবে; কিন্তু তৃণমূলে ক্ষমতার এই মেকি দেউল শেষ  পর্যন্ত সরকারের খুব একটা কাজে কি লাগবে?

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল :   [email protected]

সর্বশেষ খবর