রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি কি অযৌক্তিক?

আবুসালেহ সেকেন্দার

প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি কি অযৌক্তিক?

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচয় সেই শৈশবে। পিতার হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাওয়ার সেই স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। বহু শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছি।  কিন্তু এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাসরুম, খেলার মাঠ আর স্যার ম্যাডামদের পড়ানোর ঠং, আদর-স্বেহ আর ভালোবাসা মাখানো শাসনের দিনগুলো চোখ বুঝলেই যেন দেখতে পাই। আমার বিশ্বাস আমার মতোই এদেশের প্রতিটি শিক্ষিত মানুষই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা আজীবন মনে রাখেন। শিক্ষাসচিব এনআই খান তার বড় প্রমাণ।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, আমলা-কামলাসহ এদেশের প্রতিটি শিক্ষিত মানুষ মাধ্যমিক, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন কিনা তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য এদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। তাদের ছাত্রছাত্রীরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিব, বিচারকসহ বড় বড় পদে নিযুক্ত থাকলেও এখনো তাদের বেতনভাতা ও মর‌্যাদা নিশ্চিত করার জন্য রাজপথে আন্দোলন করতে হয়। সেই সুদূর টেকনাফ অথবা তেঁতুলিয়া থেকে খেয়ে না খেয়ে নির্ঘুম রাত পার করে কাকডাকা ভোরে শহীদ মিনার অথবা প্রেসক্লাবে প্রতীকী অনশন বা মানববন্ধনে অংশ নিতে হয়।

সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের শহীদ মিনারের এমন এক আন্দোলনে সংহতি জানাতে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি শামছুদ্দীনের অনুরোধে। শহীদ মিনারের ওই কর্মসূচিতে আসা বহু শিক্ষক যে মানবেতর জীবনযাপনের গল্প বলছিলেন তা শুনে চোখে পানি রাখা দায়!

সমাবেশের একজন সহকারী শিক্ষককে প্রশ্ন করেছিলাম ৮ম পে-স্কেলে সব সরকারি চাকরিজীবীর মতো আপনাদের বেতনও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তারপরও কেন আপনারা আন্দোলন করছেন? তিনি আমার এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া একটি স্মারকলিপির কপি ধরিয়ে দেন। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম তাদের প্রতিটি দাবি। আমার কাছে তাদের প্রায় প্রতিটি দাবিই যৌক্তিক মনে হয়েছে। অনেক দাবি সরকার চাইলে এখনই পূরণ করতে পারে। আর ওই দাবি পূরণের জন্য সরকারের বাড়তি কোনো অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন নেই। বরং এক্ষেত্রে দরকার মাত্র একটি সরকারি আদেশ। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক পদে সরাসরি নিয়োগ বন্ধ করে সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি পদ ধরে সব আর্থিক সুবিধাসহ শতভাগ পদোন্নতি প্রদান করার যে দাবি সহকারী শিক্ষকদের পক্ষ থেকে করা হয়েছে তা অচিরেই পূরণ করা যেতে পারে। সাধারণত অফিসের নিæ পদে নিয়োগপ্রাপ্তরাই প্রমোশনের মাধ্যমে উচ্চ পদে নিযুক্ত লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি প্রভাষক পদে নিয়োগ পান, তিনিই ধাপে ধাপে নানা শর্ত পূরণ সাপেক্ষে অধ্যাপক হন। বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ডিন, উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পদে তারাই পরবর্তীতে নিযুক্ত হন। সরকারি অফিসের ক্ষেত্রেও বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যেসব প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগ পান তারাই পরবর্তীতে প্রমোশনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ পদ সচিব বা সমমর‌্যাদার পদে যেতে পারেন। প্রায় প্রতিটি অফিসের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম প্রযোজ্য।

কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক যে পদে নিযুক্ত হন, বর্তমানে জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে সেই পদে থেকেই অবসরে যান, যা অমানবিক। সরকারের উচিত হবে দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনের শর্ত আরোপ করে পরীক্ষার মাধ্যমে যেসব সহকারী শিক্ষক যোগ্য তারা যেন সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পেতে পারেন তার ব্যবস্থা করা। আর এক্ষেত্রে ৮ম পে-কমিশনের সুপারিশ অনুসরণ করা যেতে পারে। পে-কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব পদে পদোন্নতির সুযোগ নেই সেখানে নতুন অর্গানোগ্রাম করে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা। আমাদের দাবি সরকার অচিরেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে পে-কমিশনের ওই সুপারিশ বাস্তবায়নের শুভ সূচনা করতে পারে।

অন্যদিকে সহকারী শিক্ষকদের পক্ষ থেকে প্রাথমিক ডিপার্টমেন্টকে নন-ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্ট হিসেবে ঘোষণা করার যে দাবি করা হয়েছে তা পূরণ করাও সরকারে পক্ষে খুব কঠিন এমনটি আমার কাছে মনে হয়নি। বরং বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ গড়তে প্রাথমিক ডিপার্টমেন্টকে নন-ভ্যাকেশনাল বিভাগ ঘোষণা সময়ের দাবি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের স্বার্থে নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজম্মের স্বার্থে সরকারের এ দাবি মেনে নেওয়া উচিত। প্রাথমিক শিক্ষাকে অবহেলা করে আর যাই হোক এদেশের শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নয়ন অসম্ভব। এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দুনিয়ার সব কাজ করেন। বিদ্যালয়ের ঘণ্টা বাজানো থেকে শুরু করে জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনের সময় পোলিং এজেন্ট হওয়া, ল্যাট্রিন গণনা, খানা জরিপ, আদমশুমারি পশুশুমারি, ভোটার লিস্ট করা, কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানো ও পোলিও টিকা দেওয়ার কাজ করেন। এতসব রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব মনে হয় না অন্য কোনো পেশার চাকরিজীবীকে পালন করতে হয়। তবে এত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা সত্তে¡ও রাষ্ট্রের কাছে তারা আজও একজন সরকারি অফিসের গাড়ির ড্রাইভারের সমান একই গ্রেডে বেতন পান। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও আমরা শিক্ষকদের মর‌্যাদাকে ড্রাইভারের ওপর স্থান দিতে পারিনিÑ জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এর চেয়ে লজ্জা আর অপমানের কী বিষয় থাকতে পারে?

শুধু সহকারী শিক্ষকদের নয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দাবিগুলোও আমলে নেওয়া উচিত। বর্তমানে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ১১তম গ্রেডে বেতন পান। তাদের বেতন স্কেল ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার জন্য তারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। এখন আমরা নিæমধ্যম আয়ের দেশ। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এদেশের অর্থনীতিতে পড়েনি। তাই সারা দেশের ৬৩ হাজার ১১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৪০ হাজার প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার এখনই উপযুক্ত সময়। আর এর জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তার সংস্থান করতে সরকারকে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের ১ শতাংশ আদায় করলেই হবে!

প্রধান শিক্ষকদের পাশাপাশি সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেলের গ্রেড উন্নীত করার বিষয়টি ভাবতে হবে। প্রধান শিক্ষকের পরের গ্রেডের বেতন স্কেলে সহকারী শিক্ষকরা বেতন পাবেন এমনটিই স্বাভাবিক। যদিও সহকারী শিক্ষকের সংখ্যা প্রধান শিক্ষকের কয়েকগুণ তথা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। তাই একসঙ্গে সব সহকারী শিক্ষকের বেতন স্কেল উন্নীত করলে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের জন্য সরকারের ওপর একটি বাড়তি চাপ পড়বে সরকারের এমন দাবি অসত্য নয়। কিন্তু সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীত করে প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপে উন্নীত করার দাবিটিও যৌক্তিক হওয়ায় কয়েক ধাপে হলেও ওই দাবি পূরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

নতুন কোনো ভবন করার সময়ে বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি মজবুত করার জন্য প্রকৌশলীরা পরামর্শ প্রদান করেন। প্রকৌশলীদের ওই পরামর্শ যে অমূলক নয়, রানা প্লাজার ট্র্যাডেজি তার বড় প্রমাণ। বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারকেও শিক্ষার ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন মজবুত করার কথা ভাবতে হবে। আর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন। তাই সরকারকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে। আর তখনই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শক্ত ভিত্তির উপরে দাঁড়াবে যখন মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। উপযুক্ত বেতন, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা ছাড়া দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আসবেন না।  তাই শিক্ষাক্ষেত্রে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই আমাদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে।  প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।  [email protected]

সর্বশেষ খবর