সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এত হত্যাকাণ্ডের বিচার কবে হবে?

হায়দার আকবর খান রনো

এত হত্যাকাণ্ডের বিচার কবে হবে?

একই বছরে একই ধরনের পাঁচটি খুন। অভিজিৎ রায় খুন হলেন প্রকাশ্যে ভিড়ের মধ্যে বইমেলা প্রাঙ্গণে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। কাছেই পুলিশের গাড়ি ছিল। অভিজিতের স্ত্রী বন্যা আহমেদও আহত হয়েছিলেন। তার আর্তনাদেও সাড়া দেয়নি পুলিশ। ৩০ মার্চ একইভাবে প্রকাশ্যে চাপাতির আঘাতে নিহত হন আশিকুর রহমান বাবু। ঘাতকরা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়ে। তাদের হাতেনাতে ধরেছিলেন দুই সাহসী ব্যক্তি, যাদের আমরা তৃতীয় লিঙ্গের বলে তুচ্ছজ্ঞান করি।  খুনি ধরা পড়ার পরও আজ পর্যন্ত বিচার শুরু হয়নি। সিলেটে নিহত হলেন অনন্ত বিজয় দাস ১২ মে। নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় তার নিজের ঘরে চাপাতির ঘায়ে নিহত হলেন ৭ আগস্ট। সর্বশেষ ঢাকার ব্যস্ত এলাকা আজিজ মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে খুন হলেন ফয়সাল আরেফিন দীপন ৩১ অক্টোবর। একই দিন একই সময় লালমাটিয়ায় নিজ কার্যালয়ে শুদ্ধস্বর প্রকাশনার মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল ও আরও দুজন মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। ঘাতকরা একই কায়দায় চাপাতি দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল।

যারা নিহত হয়েছেন বা আহত হয়েছেন তারা সবাই মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন, লেখক, ব্লগার বা প্রকাশক। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে কোনো একটি উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী চক্র ধারাবাহিকভাবে এ কাজ করে চলেছে। নীলাদ্রি হত্যার পর গত আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ইসলাম পবিত্র ধর্ম। যারা ধর্মকে কলুষিত করছে, তারা ধর্মে বিশ্বাস করতে পারে না। তারা নিজেদের মুসলমান হিসেবে কীভাবে ঘোষণা দেবে? ধর্মের নামে কোনো ধরনের সন্ত্রাস চলতে দেওয়া হবে না।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে এবং আশ্বাসে আমরা একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত আশ্বাস মতো কাজ হয়নি। বরং হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনীতি করার প্রবণতা আমাদের হতাশ করে। দীপন হত্যার কয়েক দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘খালেদা বিদেশে বসে গুপ্তহত্যা চালাচ্ছেন।’ এর আগেও তিনি এবং তার দলের মন্ত্রী ও বড় নেতারা প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন। কোনো তদন্ত ছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কোনো অবস্থান থেকে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আগেই কোনো মন্তব্য করা হলে তা তদন্তকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ প্রসঙ্গে সাবেক পুলিশ প্রধান (আইজিপি) মহম্মদ হাদিস উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার বলেছেন, (বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর ২৯ অক্টোবর সংখ্যা) ‘কোনো ঘটনার তদন্তের আগেই কারও কোনো বক্তব্য দেওয়াটা ঠিক নয়।... কিন্তু দেখা যাচ্ছে কোনো ঘটনা ঘটার পর এমন কোনো স্থান থেকে ঘটনার বিষয়ে বক্তব্য আসে, তখনই তদন্তটা আর সঠিকভাবে এগোয় না।... সঠিকভাবে তদন্ত চললেও মোড় ঘুরে যায়।’

কিছু দিন আগের একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ইতালির নাগরিক তাভেলার হত্যার ব্যাপারে পুলিশ প্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অগ্রিম বক্তব্য দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঢাকার বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুমকে হুকুমের আসামি বলে ঘোষণা করলেন। তার দুই দিন পর একই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুর পাল্টে বললেন, কাইয়ুমকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। সন্দেহের তালিকা এক জিনিস আর সুনির্দিষ্টভাবে হুকুমের আসামি আরেক জিনিস। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তো ভেবেচিন্তে কথা বলা উচিত।

ধারাবাহিকভাবে লেখক প্রকাশক হত্যার ব্যাপার নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা না করাই উচিত। বরং হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান যথার্থই বলেছেন, ‘যদি আগের ব্লগার হত্যাকাণ্ডগুলোর বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত, দোষীদের শাস্তি দেওয়া যেত তাহলে গত শনিবারের ঘটনা (অর্থাৎ দীপন হত্যা) ঘটত না।’ তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন ‘বিচারে শৈথিল্য কেন?’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২ নভেম্বর সংখ্যা)। তিনি আরও ইঙ্গিত দিয়েছেন, তদন্তের নামে রাজনৈতিক খেলা বা প্রহসন যেন না হয়। তিনি বলেছেন, ‘জজমিয়া নাটক আর দেখতে চাই না।’ উল্লেখ্য, বিগত বিএনপি আমলে ২১ আগস্টের  ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার ব্যাপার প্রহসনমূলক তদন্ত করা হয়েছিল। জজমিয়া নামে এক নির্দোষ ব্যক্তিকে আসামি সাজানো হয়েছিল। নিজেদের দুর্বলতা আড়াল করার জন্য অথবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্য নিয়ে যেন ভুয়া তদন্ত আর না করা হয়।

দীপন হত্যার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদকীয়তে (২ নভেম্বর ২০১৫) বলা হয়েছে, ‘একের পর এক লেখক-ব্লগার খুন হওয়ার পরও ঘাতকদের চিহ্নিত এবং গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা দুর্ভাগ্যজনক।’ কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তা মনে করেন না। দীপন হত্যার পরপরই তিনি বললেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো, অবশ্যই ভালো।’ কিন্তু একই মন্ত্রিসভার আরেক সদস্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আশঙ্কা প্রকাশ করে বললেন, ‘আমি বিপদমুক্ত নই।’

একেক মন্ত্রী একেক কথা বলেন। প্রায়শ অবান্তর কথা বলেন। কখনো কখনো উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতার মুখ দিয়ে এমন সব রুচিহীন ও কদর্য কথা বের হয় যে, আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠি, কারা চালাচ্ছেন এই দেশ! দীপনের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক শোকে কাতর অবস্থার মধ্যে বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না, সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এটাই কামনা করি।’ আমরা জানি যে পিতার স্কন্ধে পুত্রের লাশের চেয়ে ভারী আর কিছুই নেই পৃথিবীতে। আর সেই লাশ যদি হয় রক্তাক্ত, চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, তাহলে সেই ভার যে কতটা হতে পারে, তা বোধহয় ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ অনুমান করতে পারবেন না। অধ্যাপক ফজলুল হকের এ বক্তব্য শুনে আমরা তার মধ্যে এক মহান মানুষের সন্ধান পেলাম। প্রতিহিংসা নয়, প্রতিশোধ নয়, তিনি সবার শুভবুদ্ধির কামনা করছেন। কিন্তু সরকারি দলের বড় নেতা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ কী বললেন? তিনি বললেন, ‘দীপনের পিতা পুত্রের হত্যাকারীদের মতাদর্শের অনুসারী।’ আমি ভেবে পাই না, এমন কথা বলেন কী করে সরকারি দলের একজন বড় নেতা। হায়! তারাই আমাদের দেশ চালাচ্ছেন। আশঙ্কা হয়, তাহলে দেশের সর্বনাশ হতে বোধহয় বেশি বাকি নেই। সম্ভবত জনাব হানিফ ভেবেছেন, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বিচার ব্যবস্থাকে কটাক্ষ করেছেন। তাই একটা উপযুক্ত জবাব দেওয়া দরকার। ক্ষমতাসীনদের তো লাগামহীন কথা বলার পূর্ণ অধিকার আছে। তাই তিনি চট করে এত সহজে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতে পারলেন। এ প্রসঙ্গে মুক্তবুদ্ধির কবি ও সাহিত্যিক আবুল মোমেন বলেছেন, ‘একজন শোকার্ত বাবার ব্যক্তিগত শোকের মুহূর্তে উচ্চারিত বক্তব্যের গভীরতা বোঝার ক্ষমতা ক্ষমতায় থাকা মানুষের নাও থাকতে পারে। কেননা, এই অবস্থায় অনেকেই কেবল ক্ষমতার বিচারেই পক্ষ-প্রতিপক্ষ হিসেবে পৃথিবীকে দেখতে জানেন।’

এসব দেখেশুনে আরেকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন দুঃখে ক্ষোভে বলেছেন, ‘...নিশ্চিতভাবে জেনে গেছি, চাপাতির আক্রমণের শিকার আমার প্রজন্ম নিয়ে বলার খুব বেশি কেউ নেই। সুখে থাকুন রাজনীতিবিদরা। সুখে থাকুন ক্ষমতার মানুষরা। সুখে থাকুন আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা- তারাও আসলে ক্ষমতারই মানুষ।’

ক্ষমতায় থাকলে স্বচ্ছন্দে বলা যায়, ‘পরিস্থিতি খুব ভালো’। এমনকি চাপাতির ঘায়ে নিহত পিতাকে নিয়েও তামাশা করা যায়। কিন্তু তাতে সরকারের প্রতি জনগণের যেমন আস্থা বাড়ে না বরং কমে, তেমনি বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিও বিনষ্ট হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা আমরা সাধারণ মানুষ বড় অসহায় বোধ করি। দেশে কি বিচার বলে কিছু থাকবে না। মুক্তবুদ্ধির চর্চা কি কিছু বিকৃত মস্তিষ্ক ঘাতকের চাপাতির আঘাতে স্তব্ধ হয়ে যাবে? সরকারের কি কিছুই করার নেই? কখনো কখনো মনে হয়, সরকার কিসের তদন্ত করবে? কিসেরই বা বিচার করবে? মনে হয় শর্ষের মধ্যেই বোধহয় ভূত আছে। একই সন্দেহের কথা বলেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেছেন, (দেখুন বাংলাদেশ প্রতিদিন ৩ নভেম্বর), ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের ধরতে পারছে না বা ধরছে না, যেটাই হোক না কেন, এ কারণেই একটির পর একটি অঘটন ঘটে যাচ্ছে।... জনগণের মনে এ সন্দেহটি জাগা অস্বাভাবিক নয় যে, প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেও এমন কোনো দুষ্টচক্র লুকিয়ে আছে কিনা, যারা এই অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে।’

প্রসঙ্গক্রমে বর্তমানের পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক। যিনি প্রায়শ রাজনীতিবিদদের মতো ভাষায় কথা বলেন। তিনি আগস্ট মাসে নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের নিহত হওয়ার পর নিজ দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করার চেয়ে রাজনৈতিক ‘নসিহত’ দিতেই ‘উৎসাহ বোধ’ করলেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, এমন লেখা লিখতে নিষেধ করলেন। তার মানে হলো এই যে, নিহত ব্লগাররা নিশ্চয়ই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন। কিন্তু এমন অভিযোগ সত্য নয়। বরং পুলিশ প্রধানের এমন অযাচিত উপদেশ ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট খুনিদের উৎসাহিত করবে। ড. মিজানুর রহমানও পুলিশের এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যথার্থই বলেছেন, (১৩ আগস্ট) ‘পুলিশ সঠিক সময়ে সঠিক বার্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন সময় ব্লগার হত্যার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।’ আর এই আসল কাজটিই করতে পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে। আর ক্ষমতাসীনরা কোনো তদন্ত ছাড়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপিয়ে খুশিতে আছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ‘পরিস্থিতি খুব ভালো।’

অন্যদিকে অধ্যাপক ফজলুল হকের মতোই নিহত অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদও বলছেন, ‘আমিও আর বিচার চাই না।’ তার কারণটি খুবই স্পষ্ট। পাই না বলেই চাই না। বুঝে গেছি, এই দেশে আর বিচার পাওয়া যাবে না। এটি হতাশার সুর। কিন্তু আমরা এখনো অতটা হতাশ হতে চাই না।  আমরা জনগণকে আরও সোচ্চার হতে বলব বিচারের দাবিতে। ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করার দাবিতে।

সবশেষে আমি পুনরায় সরকারের প্রতি আবেদন রাখব, দয়া করে সব ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করার কালচার পরিত্যাগ করে পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীকে সক্রিয় করুন। খুনিদের শাস্তির আওতায় আনুন। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ হয়ে উঠুক মুক্তবুদ্ধি চর্চার জন্য উত্তম স্থান। পরাজিত হোক স্বাধীনতার চেতনার শত্রু পক্ষ।

- লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর