বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গর্দানে ঘি লাগিয়ে অপেক্ষা...

সৈয়দ বোরহান কবীর

গর্দানে ঘি লাগিয়ে অপেক্ষা...

বাংলাদেশ এখন আতঙ্কের দেশ। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে রাতে বাড়ি ফেরা হলো এখন এদেশে সব থেকে আরাধ্য। যে পুলিশকে দেখলে অপরাধীরা ভয় পেত, এখন তারাই যেন আকর্ষণীয় লক্ষ্যবস্তু। পুলিশের বড় কর্তারা এবং রাজনৈতিক নেতারা অবশ্য বাহাস করে কথা বলছেন। কিছু একটা করে ফেলবেন, এখনই ধরে ফেলবেন, সবকিছু জেনে ফেলেছেন, অপরাধীকে ঘিরে ধরেছেন ইত্যাদি কথা এখন শিশুদের জন্যও কৌতুক। আর অপরাধীরা দেখেশুনে মুখ টিপে হাসে। অপেক্ষা করে আরেকটা ঘাড় কুপিয়ে আলাদা করার। অপরাধীরা যেন সেই আশির দশকে জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ‘দ্য ইনভিজিবেল ম্যান’-এর মতোই। অদৃশ্য মানব তো বটেই, না হলে তাদের দেখা যাবে না, সিসি টিভিতেও তাদের চেহারা ধরা পড়বে না, এ কেমন কথা। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ ঘটনাগুলোকে রহস্য উপন্যাসের সঙ্গে তুলনা করেছে। ছোটদের জন্য ঘটনাগুলো ভ‚তের গল্পের মতোই মনে হতে পারে। বিচার তো দূরের কথা ঘটনার মূল সূত্রও উদ্ধার হচ্ছে না। এ নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, নাগরিক জীবনে অস্বস্তি আর সমালোচনার তীর সরকারের দিকে।

পুরো ঘটনায় সরকারের ব্যর্থতা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্যত্র। আমরা কী করছি? আমরা কি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি? আমরা কি সবকিছু করার দায়ভার সরকারের ওপর চাপিয়ে নিজেদের দায় এড়াতে চাইছি?

শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলকে অনেক দিন থেকেই হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। আনসারুল্লাহ বাংলাটিম মাসে একজন করে হত্যা করার ঘোষণা দেওয়ার পর টুটুল ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন... ‘কি আর করা গর্দানে ঘি লাগিয়ে অপেক্ষায় থাকি...।’ আমরা কি গর্দানে ঘি লাগিয়ে শুধু মৃত্যুর প্রহর গুনছি? টুটুলদের শুদ্ধস্বরের অফিস লালমাটিয়ায়। যেখানে কোচিং সেন্টার আছে। অন্যান্য অফিসও আছে। তিনজন দুর্বৃত্ত ঢুকল। চিৎকার-চেঁচামেচি হলো, ধস্তাধস্তি হলো, কেউ এগিয়ে এলো না। টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে একজন বললেন, ‘চিৎকার শুনেছি কিন্তু আমরা ব্যস্ত ছিলাম’। কী ভয়াবহ নিষ্পৃহতা! এরপর আক্রান্ত হলেন দীপন, আরও ঘিঞ্চি এলাকায়, আজিজ সুপার মার্কেটে। যেখানে হাঁটলেই অন্যের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। সেখানে তিনজন ঢুকল, বীরদর্পে শাটার লাগিয়ে দিল। চিৎকার-চেঁচামেচিও অনুমান করি হয়েছিল। কারণ জীবন মানুষের কাছে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত। বাঁচার জন্য দীপন একটুও চিৎকার করেনি? আর্তনাদ করেনি? পাশের দোকান, আশপাশের লোকজন কেউ এগিয়ে এলো না? জাতি হিসেবে এরকম আত্বকেন্দ্রিক, গুটিয়ে থাকা, আত্বচিন্তায় মগ্ন আমরা কবে ছিলাম? সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সিলেটে রাজনকে নির্মম কায়দায় পিটিয়ে হত্যা করা হলো। লোকজন চারপাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখল, মোবাইলে সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতা ভিডিও করল, ইউটিউবে ছড়াল কিন্তু শিশু রাজনকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে এলো না। এত নিরাসক্ত, অনুভ‚তিহীন, নির্বিকার জাতি আমরা কবে ছিলাম? জগ্লুল ভাই যখন চলন্ত বাস থেকে পড়ে আর্তনাদ করছিলেন। তখন চারপাশে অনেক গাড়ি চলছিল, মানুষ নিজের জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। কেউ একজন প্রবীণ এই নাগরিকের জন্য একটুও এগিয়ে আসেনি। রক্তাক্ত জগ্লুল ভাইকে সাহায্য করে ঢাকা নতুন আসা এক তরুণ। ঢাকার বিষাক্ত বাতাসে যে তখনো পচে যায়নি। বইমেলায় আক্রান্ত হন অভিজিৎ রায়। হুলস্থূল ভিড়, উৎসব, নিয়নের আলোর লুটোপুটির মধ্যে কিছু পশু পাশবিকতার উৎসব করল। চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলো বন্যা-অভিজিৎ। একটি মানুষ এগিয়ে আসেনি ঘাতকদের প্রতিহত করতে। যে যার মতো দূরে থেকেছে। কেবল অভিজিতের ব্যাপারে নয়। রাস্তায় সামান্য একটা দুর্ঘটনা হলে দেখা যায় আহত ব্যক্তিটি পড়ে আছে, তাকে উদ্ধারের জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। এগিয়ে আসে দূর্বৃত্তরা, তারা আহত মানুষটির ঘড়ি খুলে নেয়, মানিব্যাগ হাতিয়ে নেয়। অভিজিৎ হত্যার পর আমরা গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ করলাম অথচ ঘটনার সময় একজনও এগিয়ে এলাম না কেন? আমরা যেন কেবল আত্বকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। আমরা ঝামেলামুক্ত, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন চাই। অভিজিৎকে বাঁচাতে গিয়ে পাছে নিজে কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি এই আশঙ্কা থেকে আমরা দূরে থাকি। দুর্ঘটনা ঘটল, সাহায্য করলাম, পরে এ নিয়ে থাকা পুলিশ-ঝামেলা। এসব করার সময় কই আমাদের। সবকিছুতেই এখন লাভ-ক্ষতির হিসাব। টেলিভিশনে খুনের দৃশ্য দেখে মেকি আর্তনাদ করতে চাই। রাতে টকশোতে সরকারকে টনে টনে গালি দিতে চাই। চারপাশের সবকিছুর সমালোচনা করে আত্বতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে চাই। এ যেন হুবহু কবি শামসুর রাহমানের ‘দুঃস্বপ্নে একদিন’ কবিতার মতো

কাজ করছি, খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, কাজ করছি

খাচ্ছি দাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি, দুবেলা

পার্কে যাচ্ছি, মাইক্রোফোনী কথা শুনছি

ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি।

পাল্লা দিয়ে আমরা সবাই ‘কেরানী জীবন’কে বেছে নিতে চাইছি। সকাল-বিকাল অহর্নিশ আমাদের কানের কাছে বাজানো হচ্ছে কোনো ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নেই।’ ‘কি দরকার এসব প্রতিবাদ করার’। ‘তোমার কিছু হলে আমাদের কি হবে’। এসব করার জন্য বহু লোক আছে। নানা কথা। আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করে ‘নন্দলাল’ হয়ে পড়ছি। চারপাশে যাই হোক না কেন আমাদের ভালো থাকা চাই। কিন্তু সত্যিই কি আমরা ভালো আছি?

আমাদের সমাজে যারা পণ্ডিত, জ্ঞানী, সব বিষয়ে চাহিবামাত্র জ্ঞান বিতরণ করেন। টকশোতে সরকারের কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়Ñ বিষয়ে নসিহত করেন, তাদের ভ‚মিকা কী? তারা কী করছেন? এক্ষেত্রে ভারতের উদাহরণ প্রাসঙ্গিক বলে উপস্থাপন করছি। সেখানেও মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, উগ্র মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এর প্রতিবাদে ২৪ জন চলচ্চিত্রনির্মাতাসহ ৭৫ জন প্রাপ্ত জাতীয় পুরস্কার ফেরত দিয়েছেন। এদের মধ্যে সর্বশেষ পুরস্কার ফেরত দিলেন অরুন্ধতী রায়। পুরস্কার ফেরত দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় ‘কেন আমি পুরস্কার ফেরত দিচ্ছি’ শিরোনামে একটি লেখা ৫ নভেম্বর প্রকাশিত হয়েছে। এতে তিনি লিখেছেন, সাম্প্রতিক ভয়াবহ ঘটনাগুলো ‘গভীরতর অসুস্থতার লক্ষণ’। বাংলাদেশে কি একজন এরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মতো ‘নাগরিক’ নেই? অবশ্য থাকবে কেমন করে। বাংলাদেশে পুরস্কার পেতে নাকি বেশ দৌড়ঝাঁপ, তদবির করতে হয়। ক’দিন আগে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের কাছে অনুযোগ করলাম, একজন ব্যক্তির একুশে পদকপ্রাপ্তি নিয়ে। জিজ্ঞাসা করলাম কোন যোগ্যতায় তিনি এত বড় রাষ্ট্রীয় সম্মান পেলেন। উত্তরে মন্ত্রী যা বললেন, তাতে আমার আক্কেল গুড়–ম। ওই ব্যক্তি যেন পুরস্কার পান, সে জন্য নাকি ডজনখানেক মন্ত্রী তদবির করেছেন। মানে যোগ্যতায় নয়, তদবিরে পুরস্কার পাওয়া যায়। এত চেষ্টা করে যে অর্জন, তা তারা খোয়াবেন কী করে? যক্ষের ধনের মতো আঁকড়ে রাখবেন এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের তথাকথিত সুশীলরা হলো সমাজের সবচেয়ে নষ্ট অংশ। মাছের যেমন পচন ধরে প্রথমে মাথায়, তেমনি আমাদের সুশীলরাও পচে গেছেন। যারা সরকারের পক্ষে কথা বলেন, নিশ্চিত জানবেন সরকারের সঙ্গে তার বৈষয়িক কোনো লেনদেন আছে। আর যারা সরকারের বিরুদ্ধে বলেন, তারা ভবিষ্যতে প্রাপ্তির প্রত্যাশা থেকে বলেন। আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ফজলুল হালিম চৌধুরী, আহমেদ শরীফের মতো অভিভাবকের সংখ্যা ক্রমশ সমাজে কমে আসছে। এ জন্যই আমরা আদর্শহীন, স্বার্থপর, লোভী, দায়িত্বহীন এক হিংস্র প্রজাতিতে রূপান্তরিত হচ্ছি। মানুষের কান্না আমাদের কানে পৌঁছে না, মানুষের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত চেহারা আমরা চোখে দেখি না। মানুষের হারানোর বেদনা আমাদের হƒদয়কে আপ্লুত করে না। আমরা শুধু আমাকেই বুঝি, নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারি না। কিন্তু আমরা কি সেই বিখ্যাত জার্মান উপকথাটা একবার মনে করি না

‘ওরা আমাদের চারজনকে নিয়ে এলো। আমরা বসলাম এক ঠাণ্ডা ঘরে। তারা প্রথমে একজনকে নিয়ে গেল। আমি তার প্রতিবাদ করলাম না। কারণ সে ইহুদি ছিল। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম। কিন্তু সে আর ফিরে এলো না। এরপর ওরা আরেকজনকে নিয়ে গেল। সে অবিশ্বাসী ছিল। আমরা এবারও বাধা দিলাম না, কারণ সে অবিশ্বাসী। সেও আর ফিরল না। এরপর তারা আমার পাশের জনকে নিয়ে গেল। এবারও আমি প্রতিবাদ করলাম না, কারণ সে খ্রিস্টান ছিল। তারপর তারা যখন আমাকে নেওয়ার জন্য এলো তখন তারা বাধাহীন। কারণ প্রতিবাদ করার মতো একজনও তখন জীবিত ছিল না।’ আমরা সব কিছু থেকে গা বাঁচিয়ে চলার যে অভ্যাস রপ্ত করছি, তাতে এ গল্পের মতোই যদি আমাদের অবস্থা হয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যখন পুলিশ মারা যাচ্ছে তখন আমরা বলছি, ও তো পুলিশ, ওর মৃত্যুতে আমরা কী করব? যখন বিদেশি মারা যাচ্ছে, তখন আমরা বলছি ও তো বিদেশি, এসব তো সরকার দেখবে। যখন মুক্তমনাকে হত্যা করা হচ্ছে তখন আমরা বলছি ওরা খামোখা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। এরপর তো আপনি আক্রান্ত হবেন, তখন কী বলবেন?

কাল মার্কস বলেছেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজের মানবিক মূল্যবোধ নিঃশেষ হয়ে যায়, শিল্প সৌন্দর্য রসবোধ লুপ্ত হয়। সমাজ হয় নষ্ট। নষ্ট সমাজে কাজ করে শুধু স্বার্থপরতা।

আজ ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ বাংলাদেশ যেন সেরকম একটি মানবিক বোধশূন্য, স্বার্থপর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো কেবল স্বার্থের ওপর দাঁড়িয়ে। শহরে গ্রামে ক্রমশ আমরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে পড়ছি। একাকিত্বকে বরণ করছি। কেউ কারও খবর রাখি না, কারও জন্য দরদ অনুভব করি না।

অথচ আমাদের জাতিগত ইতিহাস তা বলে না। বাঙালি জাতি হলো মমতাময়, সহমর্মিতা পূর্ণ একটি জাতি। সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এটা ছিল আমাদের অহংকারের বস্তু। ’৫২-র ২১ ফেব্র“য়ারি যেদিন ভাষার দাবিতে বাঙালির ওপর গুলি ছোড়া হলো। মুহূর্তে সারা দেশ যেন বারুদের স্ফুলিঙ্গে পরিণত হলো। তাজউদ্দীন আহমদ তার ডায়েরিতে লিখেছেন ‘দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল, মানুষ একাত্ব হলো আন্দোলনের সঙ্গে’। ’৬৯-এ আসাদ গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পরিণত হলো এক উত্তাল জনপদে। তোফায়েল আহমেদ তার স্মৃতিচারণমূলক এক লেখায় লিখেছেনÑ ‘মুহূর্তে সারা শহরে এ খবর ছড়িয়ে পড়ল। অফিস-আদালত, দোকানপাট বন্ধ করে লোকজন রাস্তায় বেরিয়ে এলো।’ এই যে উত্তাল আবেগ, সংবেদনশীল হƒদয় এটাই হলো বাঙালির প্রাণ। স্বাধীনতার পরও এ আবেগ ছিল। শুধু আবেগ দিয়েই জাসদ তারুণ্যকে হঠকারিতার পথে নিয়ে গিয়েছিল। ’৮৪ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন। উপজেলা নির্বাচনের তফসিলের বিরুদ্ধে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের মিছিল। মিছিলে পুলিশ ট্রাক উঠিয়ে দিল। মারা গেলেন সেলিম, দেলোয়ার। তখন আমি ঢাকায়, কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। সন্ধ্যায় বেরুলাম, মনে হলো শোকে স্তব্ধ ঢাকা। নিউমার্কেট, নীলক্ষেত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বলাকা হলে নিয়মিত শো বাতিল করা হয়েছিল। আর দীপন যেদিন মারা গেল সেদিন রাস্তায় ভিড়, পাঁচ তারকা হোটেলে উৎসবের ফোয়ারা। রাস্তাঘাটে মানুষের নির্লিপ্ত ঘরেফেরা। শহরে কোথাও বিষণ্নতা নেই। কোথাও কান্না নেই। কান্না শুধু দীপনের পরিবারে। দীপনের স্ত্রীর চেহারাটা ভেসে উঠল। পরদিন দীপনের ছেলেটার পরীক্ষা ছিল, এ নিয়ে এ রাষ্ট্রের কোনো ভাবনা নেই, নেই কোনো সুশীলের ভাবনা, নেই কোনো নেতার ভাবনা। বরং মানুষরূপী কিছু বানর দাঁত খিঁচিয়ে দীপনের বাবার দীর্ঘশ্বাসকে ভেংচি কাটল। এসব বানরই এখন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, ভালো রান্না হলে পাশের বাসায় পাঠানো হতো। আমাদের পুরনো কাপড় তুলে রাখা হতো গরিব মানুষকে দেওয়ার জন্য। পাশের বাসার রান্নাঘরও আমাদের দখলে ছিল। এখন এসব কোথায়? ঢাকা শহরে যে কোনো বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেবেন পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে জানে না। আমরা যেন নিজেরাই বিচ্ছিন্নতাকে বরণ করে নিয়েছি। এটা কি সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে এ জন্য, নাকি মানুষ এখন ক্রমশ প্রতিযোগিতার দৌড়ে হাঁসফাঁস করছে। কেউ কেউ বলবেন, টিকে থাকার সংগ্রাম এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মানুষ আর কোনো কিছুরই খোঁজ দিতে চায় না। কিন্তু আমার তা মনে হয় না, টিকে থাকার সংগ্রাম আগেও ছিল। সমাজ এবং সভ্যতা যতদিন ততদিনই টিকে থাকার সংগ্রাম থাকবে। কিন্তু এখন শুরু হয়েছে ধনী হওয়ার উগ্র আকাক্সক্ষা। মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক চাহিদা হু হু করে বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে মানুষ তার মূল্যবোধ, নীতি ও নৈতিকতা বিসর্জন দিচ্ছে। ফ্রিজ টিভি তো এখন ডালভাত। গাড়ি লাগবে, বাড়ি লাগবে, না হলে আর বেঁচে থাকার অর্থ কি, এটাই যেন সমাজের মূলমন্ত্র। আগে কেউ অবৈধ টাকায় কিছু কিনলে লুকিয়ে রাখত। এখন উৎসব করে দেখায়। কদিন আগে শুনছিলাম, স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক ক্লার্ক নাকি প্রাডো গাড়িতে অফিসে আসেন। এখন সমাজে বৈধ অর্থ এবং অবৈধ অর্থ একাকার হয়ে গেছে। টাকা যার সমাজ তার। কেউ জিজ্ঞাসা করে না, কীভাবে টাকা উপার্জন করছেন। টাকা যেন এক দাঁতাল রাক্ষস। টাকা এখন সামাজিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, মানবিকতা, আবেগ সব কিছু চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। এ জন্য কারও মৃত্যুতে আমরা প্রতিবাদ করি না, অন্যায়কে লাথি মারি না, দুর্বৃত্তকে প্রতিহত করি না। আমরা সবাই এখন ব্যস্ত নিজের আখের গোছাতে। প্রতিবাদহীন এ সমাজে আমরাও কি জীবিত? নাকি আমরাও লাশ? নীলাদ্রি, অনন্ত, ওয়াসিম, অভিজিৎ, রাজীব অথবা দীপনরা মারা গেছে।  কিন্তু আমরা কি বেঁচে আছি? নাকি নষ্ট আত্বাটা নিয়ে পচা গলিত লাশের মতো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত?  আর মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন কিছু মানুষ গর্দানে ঘি লাগিয়ে অপেক্ষা করছি একটি চাপাতির কোপের।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ইমেইল:  [email protected]

সর্বশেষ খবর