শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শহীদ জিয়ার আদর্শে গড়া বিএনপি কোথায়

আবু হেনা

শহীদ জিয়ার আদর্শে গড়া বিএনপি কোথায়

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এনার্জি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন সুনীল গুপ্ত, একদিন অফিসে বসে কাজ করছিলেন তিনি। হঠাৎ লাল ফোনে প্রেসিডেন্টের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘কি মন্ত্রিত্ব করছেন? পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের একজন পরিচালক নতুন মাইক্রো কিনে তাতে বাড়ি বানানোর জন্য সিমেন্ট বহন করছেন, এ খবর রাখেন? হতভম্ব মন্ত্রী কী করবেন ভেবে না পেয়ে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ হাসান আহমদকে ফোন করলেন।  বিষয়টি শুনেই উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন তিনি, বললেন, কী বলেন স্যার, উনি তো প্রেসিডেন্টের ভায়রা ভাই? পরে তাদের এ নিয়ে ভাবতে হয়নি। কিছু দিনের মধ্যেই সেই পরিচালক বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে একটি চাকরিতে যোগদান করেছিলেন।

আর একটি ঘটনা। প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশের সাবেক আর্মি চিফ, বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানকে চীনে মিলিটারি অ্যাটাসি নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি যখন বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাকে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাড়ি দিনাজপুর, মজুমদার পরিবারের কাউকে চেন? জেনারেল মাহবুব, তখন হয়তো কর্নেল অথবা ব্রিগেডিয়ার ছিলেন, বললেন, নো স্যার, কাউকে চিনি না।’ প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি যেতে পার।’

প্রেসিডেন্টের পুত্র তারেক রহমানের শাহীন স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ার বিষয়টি সে সময় অনেকটা আরব্য উপন্যাসের গল্পের মতোই জনগণের মুখে মুখে শোনা যেত। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তিনি স্কুলের নিয়ম ভঙ্গ করে তার পুত্রকে কোনো বাড়তি সুবিধা দিতে দেননি। সেই কারণেই হয়তো তারেক রহমান ‘তারেক জিয়া’ নামটি পছন্দ করতেন না, যদিও তিনি আবার আচরণে এবং বাচনভঙ্গিতে প্রেসিডেন্ট জিয়াকেই অনুকরণ করেন। শোনা যায় একবার বিদেশ ভ্রমণে যাওয়ার প্রাক্কালে তার দুই শিশুপুত্র বায়না ধরেছিল, তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেছিলেন রাষ্ট্রের বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব নয়। তারা বলেছিল, ‘কেন, অনেক রাজপরিবারের সদস্যরাই তো রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদেশ সফরে যায়।’ তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে রাজতন্ত্র নেই। আমরা কেউ রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিনি।’ মধ্যবিত্ত এক সাধারণ পরিবারে জিয়ার জন্ম। শুধু নিজ মেধার ওপর নির্ভর করে তিনি পাকিস্তানি আর্মিতে অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তারপর অত্যন্ত স্বল্প সময়েই তিনি নিজেকে একজন চৌকস কমান্ডো-প্যারাট্র–পার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ পাকিস্তান আর্মি তাকে মিলিটারি একাডেমি, কাকুলে প্রশিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি সে সময় বাঙালি অফিসারদের সবরকম সহায়তা প্রদান করেছেন। তার দৈনন্দিন জীবন ছিল সাদামাটা। তার পরিবারের সবাইকেই তিনি একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ সাধারণ জীবনের আবর্তে আবদ্ধ করেছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত তার এক ভাইকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে জানতে পেরে তিনি সেই ফাইলটি এনে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখেছিলেন। তার আরেক ভাই সে সময় সম্ভবত পর্যটন করপোরেশনে ম্যানেজার ছিলেন। তার বাবা-মার বিষয়ে একটি কথাও কেউ কোনো দিন শোনেনি। সিদ্ধেশ্বরীতে তার নানা থাকতেন। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘কমল প্রেসিডেন্ট হয়ে একদিনও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসল না।’

১৯৭১ সালে জিয়া চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অষ্টম বেঙ্গলের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঢাকায় বীভৎস হত্যাযজ্ঞ চালালে তার নেতৃত্বে অষ্টম বেঙ্গল বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তিনি নিজ হাতে পাকিস্তানি সিওকে হত্যা করে বন্দরনগরীর নিয়ন্ত্রণ নেন এবং বঙ্গবন্ধুকে ‘সুপ্রিম লিডার’ অভিহিত করে তার নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স’ গঠন করে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে তিনটি সেক্টরে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তিনি গৃহবন্দী হন এবং ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন।

১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দেশে গণমুখী গণতান্ত্রিক শাসনের প্রত্যয় নিয়ে তিনি ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮-এ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। এর লক্ষ্য ছিল ‘জনগণের গণতন্ত্র’ দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রে তা স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল : “উৎপাদনমুখী এবং জীবননির্ভর রাজনীতির বাহক ও অবশ্যম্ভাবী সুফল হচ্ছে জনগণের গণতন্ত্র। যে তথাকথিত গণতান্ত্রিক কাঠামো ও বিধিব্যবস্থা ধনী, অভিজাত ও নগরবাসী উচ্চবিত্তকে ক্ষমতার আসনে বসিয়ে রাখে মাত্র, অথচ জীবনের আশা, সুখ ও সমৃদ্ধি আনতে ব্যর্থ হয়, সে ধরনের ব্যবস্থা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতা ও সমঅধিকারের পরিহাস বৈ কিছু নয়। আমাদের দলের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে এমন এক বাস্তবনির্ভর ও গণমুখী কাঠামো ব্যবস্থা গড়ে তোলা যার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ নিজ নিজ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে এবং সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে জাতীয়, সামাজিক-ব্যক্তিগত উন্নতি ও সমৃদ্ধি আনতে পারবে। পার্টি বিশ্বাস করে, জাতীয় জীবনে যেমন, তেমনি গোষ্ঠী ও ব্যক্তিগত জীবনে এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনৈতিক জীবনে আত্মনির্ভরশীলতা অপরিহার্য। এই আত্মনির্ভরশীলতার জন্য প্রয়োজন সচেতন সংগঠন ও মৌলিক পর্যায়ে গণইচ্ছানুযায়ী এবং জনগণ কর্তৃক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। জনগণ নিজেরাই চিন্তা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান করবে। জনগণই নেতৃত্ব সৃষ্টি করবে এবং গণমুখী নেতৃত্ব প্রতি এলাকায়, প্রতি অঞ্চলে তাৎপর্যময় প্রকৃত গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলবে যার উচ্চতর প্রকাশ ঘটবে জাতীয় জীবনে। পার্টি মনে করে যে, সচেতন এবং সংগঠিত জনগণই সব রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস এবং অটল রক্ষাকবচ। জাতীয়তাবাদী ঐক্যের ভিত্তিতে গ্রামের জনপদে জনগোষ্ঠীকে সচেতন ও সুসংগঠিত করা এবং উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা ও প্রকল্প রচনা এবং বাস্তবায়নের ক্ষমতা দেওয়া- এসব কিছুকেই পার্টি জনগণের গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান বলে মনে করে এবং এর লক্ষ্যগুলোকে অর্জন করার জন্য পার্টি তার সার্বিক সাংগঠনিক কাঠামো এবং আন্তরিক প্রচেষ্টাকে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত রাখবে। পার্টির উদ্দেশ্য হবে এমন এক কাম্য পরিস্থিতির সৃষ্টি করা যেখানে গণতন্ত্রের শিকড় মৌলিক স্তরে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হবে। এর ফলে জনগণ ব্যাপকভাবে জাগ্রত হয়ে উঠে জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ রক্ষকের ভূমিকা পালন করবেন।” জিয়া তার জীবদ্দশায়ই বিএনপিকে একটি গণমুখী, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। দলের মধ্যে সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় দেশ গড়ার কাজে দলকে নিয়োজিত করাই ছিল লক্ষ্য।

 

 

চট্টগ্রামের দলীয় কোন্দলটি তিনি ঢাকায় বসে ব্যক্তিগত নির্দেশ দিয়ে সমাধান করতে পারতেন যেমন এখন লন্ডনে বসে অথবা ঢাকার গুলশান অফিসে বসে দলের সব নীতিনির্ধারণী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু তা না করে তিনি এর জন্য স্থায়ী কমিটির সদস্যদের চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং দফায় দফায় স্থায়ী কমিটির সভা করে এর সমাধান খুঁজে বের করেছিলেন। তিনি পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল, গ্রামের পর গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। তিনি যেখানেই গেছেন সেখানেই জনসভার পর দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য কর্মিসভা করেছেন, সব স্থানীয় সমস্যা সমাধান করেছেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজের জীবন উৎসর্গ করেই দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। তাই ১৯৮১’র ৩০ মের ভয়াবহ ঘটনার পরও দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়নি। শান্তিপূর্ণভাবে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিচারপতি এম এ সাত্তারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে এবং পরে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল ভোটে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. কামাল হোসেনকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপিরও তিনি প্রধান নির্বাহী ছিলেন। দেশে জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন না এলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকত এবং দিনে দিনে উৎকর্ষ সাধন করে আজ তা মহীরুহে পরিণত হতো।

জিয়া পরিবারের কোনো সদস্য বিএনপি দলীয় কার্যক্রম কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে অংশগ্রহণ করুক এরূপ চিন্তা কোনো দিনই প্রেসিডেন্ট জিয়ার মনে স্থান পায়নি। বরং কেউ তাকে খুশি করার জন্য তার কোনো আত্মীয়-পরিজনের প্রসঙ্গ তুললে তিনি তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলতেন, আর কোনো দিন যেন সে তা না করে।

আজ ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস জিয়ার রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত বিএনপি নিয়ে সবাই পরিহাস করছে। আজ অনেক কারণেই বিএনপির হেড অফিস বাংলাদেশের ঢাকায় নয়, যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সম্মেলন বাংলাদেশে হয় না, হয় লন্ডনের হোটেলে ব্রিটিশ নাগরিকদের নিয়ে। দুই বছর দলের কাউন্সিল নেই। মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনের মতো বিএনপির পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলছে শীর্ষ থেকে- তৃণমূল পর্যায় থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে- কাউন্সিলের মাধ্যমে নয়। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জনগণই তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতৃত্ব গড়ে তুলবে এবং তারই প্রতিফলন হবে জাতীয় নেতৃত্বে। কিন্তু শোনা যাচ্ছে ওপর থেকেই সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি হবে এবং নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তা শীর্ষ থেকে বাস্তবায়িত হবে। আজ আমেরিকা এবং ইউরোপে বিএনপির যত শাখা অফিস আছে ততগুলো শাখা অফিস বাংলাদেশে নেই। আজ বিশেষ কারণে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক আশ্রয়ে লন্ডনে একটি ফ্ল্যাটে দীর্ঘ আট বছর ধরে বসবাস করছেন। তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। তার দেশে ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম। অথচ এদেশে প্রায় ২০ হাজার নেতা-কর্মী জেলে। লাখ লাখ আত্মগোপনে। নিতান্তই হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে ঘোষিত শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ অবরোধ, হরতাল কর্মসূচির শিকার হয়েছে লাখ লাখ নেতা-কর্মী যারা পাঁচ লাখ মামলা মাথায় নিয়ে নিঃস্ব হয়ে মাঠে বসেছে। আজ ৯ বছর দেশে কোটি কোটি বিএনপি নেতা-কর্মী এবং সমর্থক দলের কারও কাছ থেকে কোনো সাহায্য-সহায়তা পায়নি। জীবন সংশয়কারী দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আবারও কারাগারে। তার মুক্তির দাবিতে ১০টা লোকও মাঠে নামেনি। তিন স্থায়ী কমিটির সদস্য কারাবন্দী। একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। এদের মুক্তির ব্যাপারে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাক। বাংলাদেশ প্রতিদিনে হেডলাইন হয়েছে- ‘নেতৃত্বশূন্য বিএনপি’। বিএনপির ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়েছে। নেতা-কর্মীরা হতাশ। অনেকে মনে করছে খালেদা জিয়া আপাতত দেশে ফিরছেন না। স্থায়ী কমিটির তিন সদস্য ড. আর এ গনি, শামসুল ইসলাম, সারওয়ারী রহমান অসুস্থতার কারণে বাসা-হাসপাতালেই দিন কাটাচ্ছেন। লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্রি. জে. হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার এবং নজরুল ইসলাম খান গা-বাঁচিয়ে চলছেন। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের যখন এ অবস্থা তখন বিএনপির মাঠ ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাল অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আজ দলের নীতিনির্ধারণী কিংবা দলীয় দায়িত্ব কার হাতে তা কেউ জানে না। কেউ জানে না, তাদের কী করা উচিত অথবা তারা কী করতে পারেন। দলের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই প্রবাদটিই মনে পড়ে যায়- হারাধনের তিনটি ছেলে ধরতে গেল রুই, একটি গেল বুকের ব্যামোয়, বাকি রইল দুই।’ আজ বিএনপিতে নেই সাইফুর রহমান, মান্নান ভূঁইয়া, আবদুস সালাম তালুকদার, মতিন চৌধুরী, বি. চৌধুরী, কর্নেল অলি। যারা আছেন তারা থেকেও নেই। তারা নিমিত্ত মাত্র। এ অবস্থায় কে দাঁড়াবে দেশের লক্ষ কোটি নেতা-কর্মী আর সমর্থকদের পাশে, কে শোনাবে আশার বাণী? এমনও দিন যাচ্ছে যেদিন ৫০০ বিএনপি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। অথচ এদের মুক্তির জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করার কেউ নেই। এক কথায় বলা যায়, এই বিশাল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিতে শীর্ষ স্থানীয়রা পদাধিকারীরা ব্যর্থ হয়েছেন। একে একে সবকটি সিটি করপোরেশন থেকে নির্বাচিত মেয়রদের হারাচ্ছে বিএনপি। বাকি আছে কুমিল্লার মনিরুল হক আর বরিশালের আহসান হাবিব কামাল। এদের  আয়ু কতদিন, কে জানে? আগামীতে পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে কে নির্বাহী ভূমিকা নেবে, কে জানে?

বিএনপির ঘোষণাপত্র এবং গঠনতন্ত্রে চেয়ারপারসনসহ অন্য কর্মকর্তাদের যেমন নির্বাচিত করার বিধান আছে তেমনি অপসারণ করারও ব্যবস্থা আছে। এ কথা ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। এর অর্থ দলের কোনো কর্মকর্তাই জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। গত কয়েক বছর ধরে এককভাবে যেসব অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তার জন্য অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। দীর্ঘদিন পরে হলেও জিয়ার আদর্শের জাতীয়তাবাদী দলকে আবার মৌলিক স্তরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সব মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে গ্রোথিত করার জন্য আজকের দিনের বিএনপির সব সদস্যের প্রত্যয় ঘোষণা করার সময় এসেছে। তাদের পাশে আছি আমরা যারা বারবার ধানের শীষ নিয়ে জনগণের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। আছেন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা আর সিটি করপোরেশন এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। আছেন সংগঠনের তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। বিএনপি নেতা-কর্মী আর সমর্থকরা দুর্বল নয়, অসহায় নয়। এদেশের জনগণই বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারাই বিএনপিকে বাঁচিয়ে রাখবে। ভোটের মাধ্যমেই বিএনপিকে ক্ষমতায় যেতে হবে। বিদেশে অফিস খুলে সেখান থেকে আমরা এই নির্বাচনে জয়ী হতে পারব না। এদেশে রাজনীতি করতে হলে এদেশে থেকেই রাজনীতি করতে হবে, সংগ্রাম-আন্দোলন করতে হবে, জেল-জুলুম প্রকাশ্যে প্রতিরোধ করতে হবে। বিএনপি কোনো নিষিদ্ধ আন্ডারগ্রাউন্ড দল নয়।  বিএনপি ১৭ বছর রাষ্ট্রপ্রশাসন পরিচালনা করেছে। আগামীতেও এ দল ক্ষমতায় আসবে, জনগণের প্রয়োজনেই, তাদেরই সমর্থনে আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নেবে।  আর তা সেদিনই সম্ভব হবে যেদিন প্রেসিডেন্ট জিয়ার হাতে তৈরি দলের ঘোষণাপত্র এবং গঠনতন্ত্র পুরোপুরি ও সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে।

-লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর