মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

হুজুরকে একটু মর্যাদা দিলে দেশ বা জাতির কী ক্ষতি?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

হুজুরকে একটু মর্যাদা দিলে দেশ বা জাতির কী ক্ষতি?

ভুল স্বীকারের মধ্য দিয়ে আজ শুরু করছি। গত মঙ্গলবার সকালে, মোবাইল বেজে ওঠে। তাকিয়ে দেখি বড় ভাই, ‘বজ্র, তোর লেখায় মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী লোকসভায় বঙ্গবন্ধুর খাদ্য সংকটের চিঠি সম্পর্কে প্রস্তাব তুলেছেন। কোনো মুখ্যমন্ত্রী লোকসভায় কথা বলে না। লোকসভায় লোকসভার সদস্যরা কথা বলে।’ শোনামাত্র দেহমনে  বিদ্যুৎ খেলে যায়, হায় হায় সর্বনাশ! খসড়া কপিতে দেখি সত্যিই ভুল। এখন উপায়? বাসাইলের জমির উকিলের ছেলে শামসুদ্দিন আহমেদ বালু মোক্তার এবং ইউনুস পেশকারের ছেলে বাবুল হককে নিয়ে সে যাত্রায় দিল্লি গিয়েছিলাম। বাবুল হক ক্যামেরা চালাত, বালু মোক্তার লেখালেখি করতেন। ইন্দিরাজীর ১ নং সফদর জং রোডে আমার আগে দর্শনার্থী ছিলেন মহারাষ্ট্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লোকসভার সদস্য, কংগ্রেসের অন্যতম সেক্রেটারি। ইন্দিরাজী তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাই মহারাষ্ট্রের ‘একসময়ের মুখ্যমন্ত্রী’ লিখতে গিয়ে শুধু ‘মুখ্যমন্ত্রী’ লিখে মারাত্মক ভুল করেছি। সেটা সংশোধনের সুযোগ করে দিয়ে যে বড় ভাই বাপের কাজ করেছেন তা না বললেও কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

ঠিক প্রায় একই রকম বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে একদিন টেলিফোন পেয়েছিলাম। তিনি তখন দিল্লিতে, আমি বর্ধমানে। এখনকার মতো তখন মোবাইল ছিল না। ফোন পেতে কষ্ট ছিল। কখনো শোনা যেত, কখনো যেত না। সে রকম একটা সময় দিল্লি থেকে ফোন, ‘বজ্র, সৈয়দ হোসেন ফুপা এসেছেন। তোমাকে তার দরকার। গভর্নর ট্রেনিংয়ের সময় কি পড়িয়েছিলেন, আরও নাকি অনেক কিছু বাকি। তুমি চলে এসো।’ ফোন পেয়ে গিয়েছিলাম দিল্লি। একটানা ৩ মাস সকাল-বিকাল-দুপুর তার উজাড় করা জ্ঞানের ভাণ্ডারে অবগাহন করেছিলাম। যে কারণে শত গরলের মাঝে বিষে বিষে বিষক্ষয় নীলকণ্ঠ হয়ে আজও বেঁচে আছি।

সে দিন হঠাৎ কাগজে দেখলাম টিউলিপ মা হতে চলেছে। ভাগ্নী মা হলে মামাদের যে কত আনন্দ তা হয়তো সবাই বোঝে না। কামাল-জামাল-রাসেল বেঁচে থাকলে টিউলিপের মা হওয়ার খবরে কতই-না খুশি হতো। আমার আদরের ভাগ্নী দুলাল-শাহানার মেয়ে ইয়ার মা হওয়ার খবরে মনপ্রাণ ময়ূয়ের মতো নেচে উঠে পেখম তুলেছিল। ববির জন্মের কার্ড আজও আমার কাছে আছে। টিউলিপ বড় হয়েছে, আমাদের সম্মান বৃদ্ধি করেছে, তাই ওর জন্য গর্ব হয়। ভালো কিছু হলেই আনন্দ হয়। কী কষ্টের সময় ওরা এ জগতে এসেছিল। রাজনীতি করি বলে এক সময় যে ছোট্ট শিশুদের বুকে তুলেছি তাদের ছুড়ে ফেলে দিতে হবে? সে কী করে সম্ভব? ছোটরা বড় হলে এসব তাদের মনে নাও থাকতে পারে। কিন্তু যারা বড় ছিলাম, যাওয়ার কালে তাদের মনে থাকবে না কেন? দিল্লির পান্ডারা রোডে জয়-পুতুল চায়না ক্লে নিয়ে খেলত। ওরা ছোট ছিল, ওরা ভুলতে পারে। কিন্তু আমি বা আমরা তো ছোট ছিলাম না, আমরা ভুলি কী করে? টিউলিপের মা হওয়ার খবরে বহুদিন পর মনপ্রাণ যখন আনন্দে টইটম্বুর হয়ে উঠেছিল ঠিক তখন হঠাৎ প্রেমের শহর প্যারিসে ভয়াবহ বর্বর হামলায় সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। আমার প্রাণের আধার কুশিমণির জন্মদিন ছিল গত রবিবার। কিন্তু কেন যেন কোনো আনন্দই হৃদয়ে মাখতে পারলাম না।

 

 

কী করে আফ্রেশিয়ার গণমানুষের মুক্তির দূত মজলুম জননেতা হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিনে আমার পর্ব পড়েছে? এটাও হয়তো আল্লাহর রহমত বা দান। জ্বলন্ত পৃথিবীতে যার খুবই প্রয়োজন, সেই তিনি আমাদের মাঝে নেই। তার কর্মকাণ্ড তার আদর্শও যদি লালন করতে পারতাম তাহলেও হয়তো কিছুটা ভরসা ছিল। কিন্তু তাও নেই। ছেলেবেলায় বাঁধনহারা বিহঙ্গ ছিলাম, তেমন কোনো কিছু গায়ে মাখিনি। কী করে বঙ্গবন্ধু এবং হুজুর মওলানা ভাসানীকে পেয়ে মায়ার জালে বদ্ধ হয়েছিলাম আজও ভেবে পাই না। স্বাধীনতার আগে তেমন খুব একটা ভাবতাম না, ভাবতে জানতাম না। আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী আন্দোলনে চিৎকার-চেঁচামেচি করতাম, মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতাম, সভা-সমাবেশ করতাম। আন্দোলন যত বেগবান হয়েছে, যত নির্যাতন-অত্যাচার বেড়েছে ততই সক্রিয় হয়েছি। জেল খেটেছি, জুলুম সহ্য করেছি, অল্প বয়স- তাই কিছু মালুম করিনি। তারপর মুক্তিযুদ্ধ, সেই যুদ্ধে শতভাগ না হলেও সফল হয়ে দুই নেতার মাঝে সেতুবন্ধ হয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু এবং হুজুর মওলানা ভাসানী দুজনের অপার স্নেহ, আস্থা ও বিশ্বাস পেয়েছি। দুজনই একই রকম ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। কেউ সন্দেহ করতেন না। মানুষ কিছু পেলে নির্লোভী হলেও কিছু না কিছু আশা করে।

আমারও আশা ছিল। আল্লাহ যদি আমায় হুজুর মওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কফিন বহন করার সুযোগ দেয় সেটা হবে আমার জন্য শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হন। আমি হই একেবারে নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বহারা। বাংলাদেশের আর কোনো পরিবার মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হয় না, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আর কেউ সর্বস্ব হারিয়েছে কিনা জানি না। মুক্তিযুদ্ধে হানাদাররা আমাদের বাড়িঘর পুড়ে ছারখার করে দেয়। তার আগে আইয়ুব-মোনায়েম আমাদের গুষ্টিশুদ্ধ বছরের পর বছর জেলে রাখে। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নিহত হলে মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই হয় গৃহহারা। ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়া ধ্বংস হয়ে যায়, বৃদ্ধ মা-বাবা বাস্তুত্যাগী হন, বড় ভাই স্ত্রী-কন্যা নিয়ে হন দেশত্যাগী- এসবই ছিল আমাদের কপালের লিখন। কতদিন না খেয়ে থেকেছি, কষ্ট করেছি, পাহাড়, পর্বত, জঙ্গলে ঘুরেছি। এরই মাঝে ’৭৬-এর ১৭ নভেম্বর মেঘালয়ের বাঘমারা রংরাতে হুজুর মওলানা ভাসানীর মৃত্যু সংবাদ শুনে দিশাহারা হয়ে পড়েছি। মণি ভাইর ছোট ভাই মারুফ সে সময় আমার সঙ্গে ছিল। বঙ্গবন্ধু এবং মণি ভাই নিহত হলে জনাব শেখ সেলিম এবং মারুফ কলকাতা গিয়েছিল।

সেখান থেকে প্রতিরোধ আন্দোলনে শরিক হতে মারুফ মেঘালয়ে যায়। মারুফের মেঘালয়ে যাওয়ার ৪-৫ দিন পর তার মায়ের চিঠি পাই, যা আমার মায়ের চিঠির মতোই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ভালো খাবার জুটত না, শোবার বিছানা ছিল না, ঝোরা থেকে গারো ছেলেরা ছোট ছোট মাছ ধরত, মাংস খাই না বলে ভর্তা, ছোট মাছ দিয়ে খেতাম। মারুফ পাশে বসে খেত। ও পাশে থাকায় বেশ ভালোই লাগত। মা-বাবা নেই, ভাই-বোন নেই, এক দমকা হাওয়ায় সব তছনছ হয়ে গেছে। এক বছর পর আস্তে আস্তে পরিবারের সবাই ভারতে এসে শিলিগুড়িতে আশ্রয় নেয়। মেঘালয় থেকে শিলিগুড়ি প্রায় ৬-৭শ কিলোমিটার। ২-১ বার সেখানে যাই। আজাদ, মুরাদ, শাহানা খুবই ছোট, শুশু কেবলই ইন্টারমিডিয়েট পড়ে। তার লেখাপড়া নষ্ট, দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা প্রতি মুহূর্তে কুরে কুরে খাচ্ছিল। ঠিক সেরকম একটা সময় হুজুর মওলানা ভাসানী আমাদের এতিম করে চলে গেলেন। যেহেতু অসহায় অবস্থায় হুজুরের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম, সে জন্য সেদিনের অনেক কথাই আজ মনে পড়ছে। কেন জানি কখনো জীবনটা গুছিয়ে উঠতে পারিনি। যখন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিলাম, তখন আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী আন্দোলনে সব হারিয়েছি, জীবন ধ্বংস করেছি। তারপর এলো মুক্তিযুদ্ধ, দায়িত্ব পালন না করে প্রায় সবাই গা-ঢাকা দিয়েছিল, আল্লাহর তরফ থেকেই বোধহয় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ এসেছিল। আল্লাহ রাজি-খুশি থাকায় সাফল্য পেয়েছিলাম। নেতা এবং পিতা দেশে ফেরার পর তার কাছে অস্ত্র দিতে একদিনও অপেক্ষা করিনি। তাও শান্তিতে থাকতে পারলাম না। নানাদিকে নানা আক্রমণ বুক পেতে বঙ্গবন্ধু ফেরালেও এখন তো সবই জানি অনেকের চোখে আমাদের যুদ্ধে সফলতা অর্জনও একটা মারাত্মক অপরাধের মতো ছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা আমার বোনের সরকার, আর আমি হলাম এখন রাজাকার। যারা পাকিস্তানি ছিল, রাজাকার বানিয়েছিল তারা আওয়ামী লীগে থাকায় রাজাকার হয়েও দেশপ্রেমিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে জীবিত অথবা মৃত ধরে দেওয়ার জন্য লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। মনে হয় আজও তেমনি প্রতি পদে পদে গালাগাল লাঞ্ছনা-গঞ্জনা-নির্যাতনের শেষ নেই। কী যে দুর্ভোগ! কালিহাতী উপনির্বাচনে দাঁড়াতে গিয়েছিলাম। সরকারি ব্যাংক অমন জালিয়াতি করতে পারে ভাবা যায় না। মনে হয় না, আর কারও ব্যাপারে হাইকোর্ট মনোনয়ন বৈধ করলে নির্বাচন কমিশন গা চুলকে পক্ষ হয়ে স্থগিত করার চেষ্টা করছে, আমার ক্ষেত্রে তাও হয়েছে। ৪ দিন আগে মৌলভীবাজারে মহসীন আলীর শূন্য আসনে তার স্ত্রী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সবার মনোনয়ন অবৈধ, শুধু মহসীন আলীর স্ত্রীরটা বৈধ। এভাবে গণতন্ত্রের, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সম্মান থাকবে না। ২-৪টা সুস্থ, সুন্দর উপ-নির্বাচন হলে সরকারের কী ক্ষতি? জ্বর মাপার যেমন থার্র্মোমিটার লাগে, জনমত মাপার তেমনি নির্বাচন। দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করতে দেশের জন্য কাজে লাগতে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে, না হলে মানুষ তার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। একজন উৎসাহী মানুষ শত শত নিরুৎসাহী মানুষের চেয়ে উত্তম। কথাগুলো কেন যেন হুজুরের মৃত্যুদিনে বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো ভেবে পাচ্ছি না।

হুজুর ছিলেন সাধারণ মানুষের মানুষ। গরিব-দুঃখী ছাড়া তার আর কিছু ছিল না। কতবার দেখেছি, গরিব মা-বাবা অসুস্থ বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বোতলের পানিতে ফুঁ দিয়ে নিতে এলে পানির সঙ্গে ওষুধের পয়সা দিয়ে দিতেন। ’৬৯-এর কোনো একদিন হুজুর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে ভূঞাপুর কদ্দুসনগরের এক জনসভায় গিয়েছিলাম। সভা শেষে তিনি ডাকবাংলোয় বসেছিলেন। অনেকেই অসুখ-বিসুখের জন্য বোতলে পানি এনে ফুঁ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। একসময় হুজুর উঠে গিয়ে এক মাটির কুয়ায়ও ফুঁ দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পরে গিয়ে দেখি কুয়ায় পানি নেই। লোকজন নিতে নিতে মাটি তুলে ফেলেছে। কি অপার বিশ্বাস ছিল হুজুরের ওপর এ দেশের দুঃখী-দরিদ্র মানুষের। আজ কোথাও কোনো নেতার ওপর জনতার আস্থা নেই। আস্থাহীনতায় আমরা কুরে কুরে মরছি। হুজুরের মাজার জিয়ারত করতে এসে কত কথা মনে পড়ছে। সন্তোষের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় মেলা চলছে। খাট-পালঙ্ক, নানা ধরনের সামগ্রী কত বেচাকেনা। কিন্তু হুজুর নেই। হুজুরের আদর্শ, চিন্তা-চেতনা নেই। আপামর দরিদ্র জনসাধারণের কোনো স্থান বা ঠাঁই নেই, সরকারি তত্ত্বাবধান নেই। এরকম একজন মানুষের জন্ম না হলে আজ এই দেশ হতো না, হঠাৎ বাবুদের ফুটানি চলত না, সেদিকে কারও কোনো খেয়াল নেই। অবহেলা আর অনাদরে হুজুর মওলানা ভাসানী ঘুমিয়ে আছেন নীরবে-নিভৃতে, থাকবেন অনন্তকাল।

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর