মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আমার মা

লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.)

আমার মা

দিনাজপুর শহর থেকে মাইল কয়েক দূরে পুনর্ভবা নদী পেরিয়ে একটু পশ্চিমে এগিয়ে গেলে জগতপুর। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় পাখিডাকা গাছে ঢাকা শ্যামলে শ্যামল নীলিমায় নীল একটি গ্রাম। জগতপুর আমার জন্মস্থান। আমার গ্রাম। এ জগতের আলো আমার চোখে প্রথম প্রতিভাত হয় এই জগতপুরে। আমি জগতপুরের ভূমিতেই প্রথম জগৎ দেখি। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ সবচেয়ে আপন সবচেয়ে কাছের হৃদয়ের প্রাণের সে আমার স্নেহময়ী জননী, আমার মা। তারই জঠর থেকে আমার উৎপত্তি, সে আমার জীবন প্রবাহের উৎসমুখ, আমার মানস সরোবর।

সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ আমার মা বেঁচে আছে। প্রাণভরে বেঁচে আছে। বাঁচার আনন্দে বেঁচে আছে। আশপাশে পাড়াপড়শি আত্মীয়স্বজন সবাইকে নিয়ে বেঁচে আছে। সবাইকে বাঁচতে প্রেরণা দিচ্ছে, সাহস জোগাচ্ছে। সে কথা বলছে, গল্প শোনাচ্ছে। কত কাহিনী সে জানে। সুদূর অতীতের কত ইতিহাস, কত ঘটনা। সেই ব্রিটিশ আমল, তখন ছিল রুপার টাকা আর তাতে ছিল রাজার বড় টাক মাথার ছাপ। তখন গোরা সাহেবদের কি দাপট! তারা ঘোড়ায় চড়ে আসত। সঙ্গে অনেক লোকলস্কর। তখন মাঝে মাঝে গ্রামে কলেরার মহামারী হতো। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। তখন টিউবওয়েল ছিল না। পাতকুয়া আর পুকুরের পানি মানুষ খেত। মানুষ বলত দেও এসেছে। বাড়ির দরজায় জানালায় লম্বা লম্বা লাল ঝালমরিচ লাইন করে ঝুলিয়ে রাখত। যেন দেও ঢুকতে না পারে। ঘুঘুডাঙা জমিদার পরিবারে মায়ের জন্ম। ছোট্টবেলায় বিয়ে। বধূবেশে হাতির পিঠে চড়ে জগতপুরে শ্বশুরবাড়িতে আসা।

ছোটবেলায় মায়ের কাছে গল্প শুনেছি গ্রামাঞ্চলে তখন অনেক জঙ্গল ছিল। বসতিও কম ছিল। রাতে নিকষ অন্ধকারে ডাকাত পড়ার ঘটনা ঘটত। ডাকাতরা দলবেঁধে দৈত্যের মুখোশ পরে মশাল জ্বালিয়ে বড় বড় গৃহস্থ বাড়িতে হানা দিত। মারধর করে রক্তপাত ঘটিয়ে টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, গয়না-গাটি, লোহার সিন্দুক উজাড় করে জঙ্গলে উধাও হয়ে যেত। আমাদের বাড়িতে বাবার একটি দোনলা বন্দুক ছিল। বাবা ভালো শিকারি ছিলেন। শিকার করতে খুব পছন্দ করতেন। পাখি শিকারে প্রায়ই নদীতে বিলে বনে-জঙ্গলে দূরদূরান্তে যেতেন। আমার মনে পড়ে একবার হাতির পিঠে চড়ে আমি তার সঙ্গে বাঘ শিকারেও গিয়েছিলাম। আমাদের বাড়িতে এক অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার রাতে ডাকাত পড়ে। বাবা কলকাতায় কাজে গিয়েছিলেন। বাড়িতে মা আর আমরা কজন ছোট ভাইবোন। গভীর রাতে আমরা টের পেয়ে দেখছি মশাল জ্বালিয়ে ডাকাতরা আসছে। বাড়ির একটু দূরে পুকুর পাড়ে তারা জড়ো হয়েছে। সবার মুখে দৈত্যের মুখোশ। মাকে কখনো আগে বন্দুক ধরতে দেখিনি। সে বন্দুক চালানো জানে না। কিন্তু সেই রাতে কি অবাক ব্যাপার সে এতটুকু ভয় পেল না। সাহস করে বন্দুক হাতে নিয়ে দুই দুটো গুলি দুই নলে ভরে নিল। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে পূর্বদিকে সেই পুকুর পাড়কে লক্ষ্য করে ফায়ার করল। প্রথমে একটি। পরে আরেকটি। নিশুতি নিস্তব্ধ রাতে বিশাল শব্দ হলো। ডাকাতরা সব মশাল নিভিয়ে পালিয়ে গেল। মা আমাদের নিরাপদ করল। গ্রামবাসী সবাই ধন্য ধন্য করল। সাহসী মা আমার! আমাদের নিরাপত্তা আমাদের নির্ভর। পরিবারে বিপদে-আপদে, অসুখে-বিসুখে মাকে কখনো ভয় পেতে দেখিনি। অসীম ধৈর্যশীল সে, সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে বলত। বলত সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন। তিনি জানমালের মালিক। সারা জাহানের মালিক। ভয় কীসের? মায়ের চোখে কখনো হয়তো জল দেখেছি, মুখ মলিন হতে দেখেছি, কিন্তু কখনো তাকে শব্দ করে কাঁদতে দেখিনি। তার কাঁদার আওয়াজ কখনো শুনিনি। নীরবে সে চোখের জল বিসর্জন করেছে, চোখ মুচেছে, কখনো অধীর হয়নি। নিশ্চুপে শুধু সয়ে গেছে। নিজের কষ্টের কথা, যন্ত্রণা যাতনার কথা কাউকে বলেনি। রোগে-শোকে কাউকে কখনো বিরক্ত করেনি। সর্বংসহা মা আমার।

আমার দাদি অনেক আগেই মারা যান। আমি তখন অনেক ছোট। তাকে ভালো করে মনে পড়ে না। আমার ছোটবেলার পুরোজগৎ আমার মাকে ঘিরেই। আর বাবার সংসারটাও তাকে ঘিরেই। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হতো। ঘরগৃহস্থি, আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা, বাড়ির রান্নাবান্না সব সে এক হাতে করত। কেমন করে করত তা ভাবতেও অবাক হই। আমরা এগার ভাইবোন। তিনি জন্ম দিয়েছেন, মানুষ করেছেন।

আমার বাবা ছোটবেলায় বাবা হারান। তখন তিনি দিনাজপুরে। জিলা স্কুলের ছাত্র। একমাত্র বড় ভাই তিনিও মারা গেলেন। বাবার ম্যাট্রিক দেওয়া হয়নি। পড়াশোনা ছেড়ে গ্রামে ফিরে এসে সংসারের হাল ধরতে হয়। দাদা অনেক জমিজমা রেখে যান। তিনি ছিলেন একজন বড় জোতদার। বাবাকে সংসারে মন বসাতে আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে বিয়ে দিয়ে দেয়। মা কিশোরী বধূ বাড়িতে আসে। বাবা এলাকায় যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। সংসারের শ্রীবৃদ্ধি করেন, সমৃদ্ধি আনেন। তিনি একাধিকবার ইউনিয়ন  কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হন। তখন ইউনিয়ন কাউন্সিলকে ইউনিয়ন বোর্ড এবং চেয়ারম্যানকে প্রেসিডেন্ট বলত। তখন বাড়ির কাছারি ঘরভর্তি মানুষ। সব সময় গমগম করত। খাওয়া-দাওয়া লেগে থাকত। বাবার জীবনের সাফল্য ও সুখ্যাতির নেপথ্যের যে মানুষটি সে আমার মা। মাকে কখনো বাবার সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখিনি। সবসময় শ্রদ্ধা করে কথা বলেছে। আপনি করে সম্বোধন করেছে। বাবার ইচ্ছার-অনিচ্ছার পুরোপুরি মূল্যায়ন করেছে। বাবাকেও দেখেছি সব সময় মায়ের সঙ্গে সব বিষয় আলাপ করতে, তার পরামর্শ নিতে, তার মতামতের দাম দিতে। মা কখনো ভুল করত না। আমি তখন দিনাজপুর জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকায় ঢাকা কলেজে ইন্টারমেডিয়েট পড়ি। বাবার কাছে অনেকে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। বাল্যবিবাহ। মা বাবাকে বলেছেন, বেটা পড়াশোনা করছে, তাকে পড়াশোনা শেষ করতে দেন। আগে পাস দিক। বিয়েথা পরে দেখা যাবে।

 

 

মনে পড়ছে ১৯৬৩ সালে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছি। হাতে তখন অনেক চাকরি। আমি সব পায়ে ঠেলে সেনাবাহিনীতে যোগদান করি। পশ্চিম পাকিস্তানে মিলিটারি একাডেমি কাকুলে যাচ্ছি। বাবা মোটেই রাজি ছিলেন না। মা বেশি মন খারাপ করেনি। আমার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। সে দোয়া করেছে। সুরা ইয়াসিন পড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। মুখে ফুঁ দিয়েছে। আমি মায়ের দোয়া সম্বল করে চলে যাই। আমার দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় কত ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে, চলার পথে কত চড়াই-উতরাই, কত উথাল-পাথাল। মায়ের দোয়ায় সব পার হয়ে এসেছি, খাদে পড়িনি। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনাবাহিনীতে সেনা অভ্যুত্থান, সেনা বিদ্রোহ। আমি ঢাকা সেনানিবাসে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটে। বেশকিছু বিয়োগান্ত দুঃখজনক সহিংস ঘটনা ঘটে যায়। বেশ কয়েকজন সেনা অফিসার সহিংসতার শিকার হন। ক্যাপ্টেন মাহবুব নামের একজন অফিসার নিহত হন। খবরটা দিনাজপুরে রটে যায়। আমার মা প্রায় পাগল হয়ে যায়। চিৎকার করে বলতে থাকে ‘ওর বাপ বারবার না করেছিল। মিলিটারিতে যেতে মানা করেছিল। আমি রাজি করাই। আমার বেটাকে আমিই মেরে ফেলেছি।

মা, তুমি কল্যাণময়ী, মঙ্গলময়ী, তুমি মমতাময়ী। সব দুঃখে কষ্টে তোমার কথা সুধার মতো আমার মন জুড়িয়েছে। তোমার হাতের প্রলেপ সব যন্ত্রণা-যাতনা চুষে নিয়েছে। আমি জেগে উঠেছি। সতেজ হয়েছি। মা, প্রিয় মা আমার। কি ঐশ্বরিক শক্তি তোমার! কি জাদু হাতে তোমার! আমার মা আমাকে মাঝে মাঝে বলে বেটা নামাজ পড়িস। আমি অবাধ্য। পাঁচবেলা আমার নামাজ পড়া হয় না। জানি মা কষ্ট পায়। মনে হলে আমি তখনই ওজু করে জায়নামাজ বিছাই। নামাজ পড়তে বসে যাই। আল্লাহ আমাকে মাফ করুক।

আমার মায়ের বয়স সঠিক কেউ বলতে পারে না। সেও না। সবরকম হিসাব কষলে দেখা যায় তার বয়স নব্বই ঊর্ধ্ব। সে বলে, কবে ১০০ বছর পার হয়ে গেছে। তার সঙ্গের লোকেরা, তার ভাই বোনেরা, কাছের মানুষেরা কেউ বেঁচে নেই। সে বলে সেই নাকি কালের সাক্ষী হয়ে একমাত্র বেঁচে আছে। আমার মা এখনো লাঠি হাতে নেয় না। কেউ হাত ধরে চলতে সাহায্য করলে রাগ করে। আমি ছিলাম না। কিছুদিন আগেও ঢাকায় আমার ছোট ভাইয়ের ৬তলা বাসায় আমার মানা সত্ত্বেও চুপিসারে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠেছিল।

জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফিরদৌস ওয়াহিদের একটি গান আমার খুব প্রিয়। ‘এমন একটা মা দে না। যে মায়ের সন্তানেরা কান্দে আবার হাসতে জানে।’ কণ্ঠশিল্পী ওয়াহিদকে বলতে চাই, আল্লাহ সত্যি এমন একটি মা দিয়ে আমাকে ধন্য করেছেন যার ১১ জন সন্তানকে সে কাঁদতে নয় শুধু হাসতে শিখিয়েছে। আর সে নিজে কখনো কাঁদেনি সব সময়ই শুধু হেসেছে। সদা হাস্যময়ী মা আমার। পৃথিবীতে কত লক্ষ কোটি মা আছেন। সব মা-ই তো মা। ছোট্ট সংক্ষিপ্ত মধুর শব্দের মা। সবাই প্রাণের মা। তবুও যেন আমার মনে হয় আমার মা-ই শ্রেষ্ঠ মা, মধুরতম প্রাণতম মা। মা, তুমি চিরজীবী হও। তুমি আশীর্বাদ হয়ে আমার জীবনে সদা প্রবহমান থাক। আমার জীবনধারা সে যে তোমারই ধারা। তোমা হতেই তো সে সৃষ্ট।

রবীন্দ্রনাথ বাংলাকে ভালোবেসেছিলেন। আদর করে সোনার বাংলা নাম দিয়েছিলেন। বাংলার  আকাশ, বাংলার বাতাস তার প্রাণে বাঁশি বাজিয়েছিল। বাংলা মায়ের বদনখানি মলিন হলে তিনি আঁখি জলে ভাসতেন। তার এ অমর কবিতা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশের সাড়ে ষোল কোটি মানুষের প্রাণের সংগীত। জননী-জন্মভূমি, স্বর্গাদোপি গরীয়সী। দুটোই স্বর্গের মতো গরীয়ান। স্বর্গের মতো মহীয়ান। দুটোই স্বর্গ হতে বিধাতার আশীর্বাদরূপে মানুষের প্রাপ্তি। আমি আমার মাকে ভালোবাসি, গভীর ভালোবাসি। আমার মা আমার সোনার মা, অমূল্য রতন মণি মানিক্যের মা, আমার মা জননী। আল্লাহ তুমি সর্বশক্তিমান। তুমি আমার মাকে ভালো রেখো। সদা হাস্যময়ী রেখো। তার বদনখানি চির অমলিন রেখো। এটুকু ছোট্ট প্রার্থনা আমার।

লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।

সর্বশেষ খবর