বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সন্ত্রাসের দুনিয়া

তসলিমা নাসরিন

সন্ত্রাসের দুনিয়া

আমরা সন্ত্রাসের পৃথিবীতে বাস করছি। সন্ত্রাস চিরকালই অল্পবিস্তর ছিল। আমরা রাষ্ট্রীয়-সন্ত্রাস দেখেছি, দলীয়-সন্ত্রাস দেখেছি, ব্যক্তি-সন্ত্রাস দেখেছি। কিন্তু বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাস ঠিক এভাবে দেখিনি। এই সন্ত্রাস শেষ অবধি কোথায় গিয়ে শেষ হয়, অনুমান করাও সম্ভব নয়। ধর্মের নামে মানুষ খুন করা হচ্ছে চারদিকে। এর ফলে কী হচ্ছে? ইউরোপের দেশগুলোতে, বিশেষ করে ফ্রান্সে, মুসলিমবিরোধী হয়ে উঠছে মানুষ। আমেরিকাতেও একই চিত্র। কথা ছিল দশ হাজার সিরিয়ার শরণার্থীকে আমেরিকা নেবে। এখন সেখানকার নাগরিকরা সাফ সাফ বলে দিচ্ছে, সিরিয়ার কোনও শরণার্থীকে তারা তাদের দেশে দেখতে চায় না। শরণার্থীর ভিড়ে জঙ্গিরা মিশে গেছে। প্যারিসের জঙ্গি হামলায় সিরিয়ার এক আইসিস সদস্য ছিল, যে কিনা শরণার্থী হয়ে সিরিয়া থেকে ইউরোপে ঢুকেছে। এসব খবর জানাজানি হওয়ার পর কী ভরসায় তাদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে কথা বলবে আমেরিকার সাধারণ মানুষ!

আজ ফ্রান্সের আবালবৃদ্ধবনিতা ‘লা মারসিয়েজ’ গাইছে। এই গান ভায়োলেন্সের গান। গানের কথাগুলো যে কোনও সভ্য মানুষকেই অস্বস্তি দেবে। ‘অপবিত্র রক্তে দেশ ধুয়ে দেবো...’ এটি যে কোনও কারণেই হোক, ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত। এটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে অনেকেই অবশ্য পছন্দ করে না। এই জাতীয় সংগীত কট্টর ডানপন্থিদের পছন্দ হলেও বামপন্থিরা প্রায়ই এর সমালোচনা করেছে। কিন্তু এখন সবাই মিলে এই সংগীতটি গাইছে। এটি এখন ফ্রান্সকে এক করার লক্ষ্যে গাওয়া হচ্ছে। এই ভায়োলেন্সের গানটি এত গাওয়ার পর, আমি জানি না, শেষ অবধি ফরাসিরা শান্তির গান গাইতে আগ্রহী হবে কি না।

প্যারিসের জঙ্গি হামলার নীলনকশা এঁকেছে আবদেল হামিদ আবাউদ। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের মোলেনবিক এলাকায় মরক্কো থেকে আসা মধ্যবিত্ত ইমিগ্রান্ট পরিবারে তার জন্ম। পড়াশোনা করেছে ব্রাসলসের নামিদামি ইস্কুল-কলেজে। কিন্তু একসময় দুষ্টচিন্তা ঢোকে মস্তিষ্কে। কলেজ ছেড়ে দিয়ে আবদেল হামিদ ড্রাগ ডিলারদের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করে, ছোট ছোট ক্রাইম করতেও অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এসব কারণে জেলও খেটেছে কয়েক বছর আগে। আবদেল হামিদ সালাফি ইসলামের আদর্শে গড়ে ওঠা কেউ নয়। দারুল ইসলামের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত- কোরআন হাদিস ঠোঁটস্থ করে রাখা, নামাজ রোজা করা কোনও ‘সাচ্চা মুসলমান’ নয়। সিরিয়ায় গিয়ে মানুষ-মারার ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। প্রতিবেশী সালাহ আবদেসসালাম এবং আরও কিছু ইমিগ্রেন্ট পরিবারের বীতশ্রদ্ধ ফরাসিভাষী মুসলমান নিয়ে সে প্যারিসে হামলা করার পরিকল্পনা করে। দলে সিরিয়ার এক আইসিস সদস্য ছিল, যে কিনা সিরিয়ার শরণার্থী দলে মিশে গিয়ে ইউরোপে ঢুকেছে। স্টেডিয়ামের বাইরে প্রথম আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণটি সে-ই ঘটিয়েছে। হামলায় আবদেল হামিদের জঙ্গি বন্ধুরা মোটামুটি সাকসেসফুল। ১২৯ জন মানুষকে হত্যা করা কম কথা নয়। আবদেল হামিদের রাগ আমেরিকা আর ইউরোপের ওপর, মুসলমানের রক্তে দুনিয়া ভেজাচ্ছে ওরা, এখন ওদের রক্তের হোলি খেলতে হবে। মূলত ঘৃণা আর রাগ থেকেই নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। আইসিস লিডার আবু মোহাম্মদ আল আদনানি অথবা আল বাগদাদির অনুমতি নিয়েই সম্ভবত হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা এঁকেছিল আবদেল হামিদ। অনুমতি না নিলেও প্যারিসের টেরর অ্যাটাকের দায় আইসিস দল নিজের ঘাড়েই তুলে নিয়েছে। সব হত্যাকাণ্ড অবশ্যই ইসলামের নামে। আবদেল হামিদের পরিবারের লোকরা চায় আবদেল হামিদ মরে যাক। সে তার নিজের ছোট ভাই ইউনেসকে আইসিসে ঢুকিয়েছিল, তার বাবা ওমর তখন আবদেল হামিদের বিরুদ্ধে পুলিশে রিপোর্ট করেছিল। এই জঙ্গি ছেলে মরে গেলে পরিবার জানিয়ে দিয়েছে, তারা অখুশি নয়, বরং খুশিই হবে।

আবদেল হামিদকে এখন পুলিশ খুঁজে চলেছে। নিশ্চয়ই পেয়েও যাবে একদিন। ওর পরিণতি আমরা কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারি। কেন মানুষ জেনে বুঝে জঙ্গিদলে যোগ দেয়? এই প্রশ্নটি অনেকে করে। কী আকর্ষণ এই আইসিসের। সোজা সরল উত্তর, ইসলামি খেলাফতের ঘোষণা দিয়েছে বলে। টাকা-পয়সা অঢেল আছে বলে! এই আইসিস আল কায়দা থেকে বেরিয়ে আসা একটি দল। আইসিস ছোট ক্রাইম করবে, আল কায়দা নাইন-ইলেভেনের মতো বড় কিছু। এরকম একটা অলিখিত চুক্তি সম্ভবত আছে। আমেরিকার ভয় আল কায়দাকে নিয়ে, আইসিসকে নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন নয় আমেরিকা। আইসিসকে একরকম গড়েছে তারা, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে হটানোর জন্য। অবশ্য আইসিস যে শেষ অবধি এমন ভয়ঙ্কর ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে উঠবে, তা আমেরিকার কল্পনাতেও আসেনি। তালেবানকেও একসময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে-শক্তি হিসেবে গড়েছিল, সেও ফ্রাংকেনস্টাইন হয়েছে। আর কত সন্ত্রাসী দল জন্ম দেবে আমেরিকা! ইরাকে যুদ্ধটি না করলে ইরাকি আল কায়দার জন্ম হতো না, আইসিসেরও হয়তো জন্ম হতো না। আজ আইসিসকে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বললেন, চল্লিশটি দেশ আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে। চল্লিশটি দেশের মধ্যে, অনুমান করছি, বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ।

কেবল সন্ত্রাসীদের হত্যা করে সন্ত্রাস বন্ধ হবে না। গোড়া থেকে সন্ত্রাস উপড়ে ফেলার সময় এসেছে। যতদিন সন্ত্রাসের সূতিকাগারগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস না হচ্ছে, ততদিন সন্ত্রাস চলবেই। ততদিন আমরা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে অপঘাতে মরবো। কোনও দেশ আর নিরাপদ নয়। সন্ত্রাসীদের হাতে এখন একবিংশ শতাব্দীর অস্ত্র, মস্তিষ্কে সপ্তম শতাব্দীর অজ্ঞানতা।

মাঝে মাঝে ভাবি, আমেরিকা যদি আইসিসকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য না করতো, খুন করার ট্রেনিং না দিতো, তাহলে কি ওরা খুন করতো না? হয়তো করতো। বাংলাদেশে যারা মুক্তচিন্তক ব্লগার-লেখক-প্রকাশকদের খুন করছে, তাদের তো আমেরিকা খুন করতে শেখাচ্ছে না? চাপাতির সাপ্লাই তো আমেরিকা থেকে আসছে না। খুনিরা শরিয়া আইন অনুযায়ী পাথর ছুড়ে মেয়েদের হত্যা করে, ওই পাথর ইউরোপ, ইজরাইল বা আমেরিকা থেকে আসে না। সুইসাইড ভেস্টগুলোও নিশ্চয়ই আসে না। ওসব লোকাল। বাংলাদেশেও জঙ্গি ট্রেনিং চলছে। আমেরিকার সাহায্য ছাড়াই চলছে।

শুধু অন্যকে দোষ দিয়ে বসে থাকলে সমস্যার সমাধান কিছু হবে না। নিজেদের দোষও দেখতে হবে। দেখতে হবে আমাদের কিছু কিছু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী শেখানো হচ্ছে, ওয়াজে বা খুৎবায় কী বলা হচ্ছে।

অমুসলিমদের এবং অবিশ্বাসীদের ঘৃণা করার কথা বলা হচ্ছে কি না, ওদের খুন করার কথা বলা হচ্ছে কি না। আজ যারা প্রগতিশীল লেখকদের কোপাচ্ছে, কাল তারা মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীদের কোপালে অবাক হওয়ার কিছু কিন্তু নেই। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যারা অশুভশক্তিকে প্রশ্রয় দেয়, অশুভশক্তিই একদিন তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাস তা-ই বলে।

প্যারিস হামলার পরপরই ফ্রান্সের গোয়েন্দারা পেয়ে গেছে সবগুলো সন্ত্রাসীর নাম ধাম চেহারা চরিত্র। সন্ত্রাসীদের নাড়ি নক্ষত্রের খোঁজ পেতে পশ্চিমের দেশগুলোর খুব বেশি সময়ের দরকার হয় না। কেবল আমরাই অদক্ষ লোক। আজও আমরা জানি না কে দাভোলকার, পানসারে, কালবুর্গির হত্যাকারী, কে হত্যা করেছে অভিজিৎ রায়কে, অনন্ত বিজয় দাশকে, ওয়াশিকুর বাবুকে, নিলয় নীলকে, ফায়সাল আরেফীন দীপনকে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর