বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অসুস্থ প্রতিযোগিতার অলাতচক্রে আমরা

সাইফুর রহমান

অসুস্থ প্রতিযোগিতার অলাতচক্রে আমরা

বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আলেকজান্ডার ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন ভারতবর্ষের পাঞ্জাব অভিমুখে। প্রথমেই পরে গান্ধার রাজ্য (বর্তমান রাওয়ালপিন্ডি ও আশপাশের জায়গা নিয়ে গঠিত হয়েছিল এই গান্ধার রাজ্য)। তক্ষশিলা তখন ছিল এর রাজধানী। গান্ধার রাজ্যের রাজা অম্ভি আলেকজান্ডারকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সাদরে গ্রহণ করলেন। আলেকজান্ডারকে সাধুবাদ জানানোর কারণ ছিল স্পষ্ট, রাজা অম্ভির সঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও রাজনৈতিক বিবাদ চলছিল ঝিলাম এবং চেনার নদীর পাশে প্রতিবেশী রাজ্যের রাজা পুরুর সঙ্গে। রাজা পুরুকে পরাজিত করার জন্য রাজা অম্ভি আলেকজান্ডারকে সব রকমের সহায়তাও করলেন। বন্দী অবস্থায় পুরুকে সামনে হাজির করা হলে আলেকজান্ডার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি কেমন ব্যবহার আশা করেন। তার উত্তরে পুরু সগর্বে বলেছিলেন একজন রাজা আরেকজন রাজার কাছে যে রূপ ব্যবহার আশা করে, আমিও সেরূপ ব্যবহারই আশা করি। এতে আলেকজান্ডার খুশি হয়েছিলেন এবং পুরুকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর আলেকজান্ডার ভারতবর্ষের পূর্ব অঞ্চল মগধে (বিহার ও এর আশপাশের অঞ্চল) অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করলেন। সেখানে তখন বিখ্যাত নন্দ বংশের রাজত্ব চলছিল। আলেকজান্ডার এই রাজ্য জয় করার জন্য বিপাশা নদীর পাশে তাঁবু ফেললেন। পাঞ্জার অভিযানের সময় চন্দ্রগুপ্ত নামে এক যুবক গ্রিকবীরের সংস্পর্শে এসেছিলেন। সম্ভবত চন্দ্রগুপ্তই আলেকজান্ডারকে মগধ আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের কাছ থেকে গ্রিক যুদ্ধবিদ্যা ও রণকৌশল রপ্ত করেছিলেন। কিন্তু আমাদের এই উপমহাদেশীয় লোকজনের একটি বদঅভ্যাস- আমরা যে থালায় অন্ন গ্রহণ করি সেটাই আবার ফুটো করতে বাধে না। চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের সঙ্গে ভয়ানক এক শিষ্টাচারবহির্ভূত ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করলেন। এতে গ্রিকবীর চন্দ্রগুপ্তের ওপর ভয়ানক রুষ্ট হলেন। আলেকজান্ডার তার সেনাপতি সেলুকসকে নির্দেশ দিলেন চন্দ্রগুপ্তকে বন্দী করতে। চন্দ্রগুপ্ত শেষ পর্যন্ত পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। আর চন্দ্রগুপ্তের এহেন আচরণের জন্য নাকি আলেকজান্ডার সেলুকসকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন- সত্যিই সেলুকস কী বিচিত্র এই দেশ! অন্যদিকে চন্দ্রগুপ্ত গ্রিক শিবির থেকে পালিয়ে গিয়ে বিন্ধ্য পর্বত অঞ্চলে একটি সৈন্যদল গড়ে তোলেন। চাণক্য বা কৌটিল্য নামে তক্ষশিলার একজন অতি বিচক্ষণ ও রাজনীতিজ্ঞ ব্রাহ্মণের সাহায্যে এই সৈন্যদল নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত পরবর্তীতে মগধ আক্রমণ করেন এবং নন্দ বংশকে পরাজিত করে সেখানে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।

আজকাল আমরা যেন অসুস্থ প্রতিযোগিতার এক অলাতচক্রে খাবি খাচ্ছি সর্বত্র। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো এটা আমরা না বুঝেই করছি। জলের মাছকে ডাঙায় তুললে যেমন খাবি খেতে খেতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়, অনেকটা সেরকম। মৎস্যকুল ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে, মাছ খাবি খাওয়ার সময় হয়তো বুঝতে পারে তার মৃত্যু আসন্ন। আমরা হয়তো সেটাও বুঝতে পারি না। বিষয়গুলো একটু স্থির দৃষ্টি দিয়ে কিংবা ভালো করে খেয়াল না করলে টের পাওয়ার উপায় নেই। আমার একমাত্র কন্যার বয়স পাঁচ বছর। ওকে ভর্তি করে দিয়েছি একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। ওর মা তাঁর ডাক্তারি পেশাটিকে আপাতত নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে আমাদের পুত্রকন্যাদের গড়ে তোলায় ব্যস্ত। স্কুল থেকে প্রতিনিয়ত আনা নেওয়ার কাজটি দীর্ঘদিন ধরে ও-ই সুচারুরূপে সম্পন্ন করে আসছে।

আমার স্ত্রীর মুখেই কথাগুলো শুনলাম একদিন। স্কুলের পাশে অভিভাবকদের অপেক্ষা করার জন্য অভিভাবক ছাউনির মতো একটি অভ্যর্থনা কক্ষ থাকে। যেখানে বসে অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের ছুটির জন্য অপেক্ষা করেন। বাদবাকি সময় মেতে থাকেন নানারকম মুখরোচক গালগল্পে। জনৈক অভিভাবক মহিলা অন্য একজনকে উদ্দেশ করে বলছেন- ‘আরে আপা শুনেন- আশ্চর্যের বিষয়! হয়েছে কী জানেন, আমার মেয়ে তো এখনো ভালো করে বাংলাই বলতে পারে না। অথচ দেখেন ইংরেজিটা কেমন গটগট করে বলে যায়। মেয়ের ইংরেজি শুনে বোঝার উপায় নেই যে আসলে কোনো ইংরেজ কথা বলছে নাকি কোনো বাঙালি। দ্বিতীয় অভিভাবক- ‘আরে আপা কী বলেন! আমার মেয়েরও তো সেই একই অবস্থা। আপনার মেয়ে তো তাও দু-চারটা কথা বাংলায় বলে। আমার মেয়ে তো তাও নয়। গর্বে বুকটা ভরে যায় তাই না? ওদের বয়সে আমরা কি এক লাইনও ইংরেজি বলতে পারতাম, বলেন, তাই না?’ বউয়ের মুখে এসব শুনে আমি বললাম, তোমার কথায় আমি এতটুকু অবাক হচ্ছি না। বিচিত্র সব চরিত্রের অধিকারী বাংলাদেশের মানুষ। পৃথিবীতে এমন আরেকটি দেশ ও জাতি খুঁজে পাবে না যারা মাতৃভাষা না জানার জন্য গর্ববোধ করতে পারে। ইংল্যান্ড আমেরিকায় তো চাষা ভুষারাও ইংরেজিতে কথা বলে। তাতে আর এমন কী আসে যায়। বরঞ্চ এসব অভিভাবককে বলা উচিত ছিল- দেখেন আপা, আমার এতটুকু মেয়ে অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেকটাই ওর আয়ত্তে। অনেকের শিশু বয়স থেকেই জ্ঞানের স্ফুরণ ঘটে। এটা খুবই স্বাভাবিক। প্রত্যেক পিতা-মাতার কর্তব্য হচ্ছে সেই শিশুকে ঠিক পথে পরিচালিত করা। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তিন বছর বয়সে মামাবাড়ি বেড়াতে এসেছেন কলকাতায়। এসেই অসুখ। কলকাতায় তখন মশামাছির প্রবল উপদ্রব। সেটা দেখেই বালক ঈশ্বরচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলেছিলেন এটি ছাড়া যা পরবর্তীতে কিংবদন্তিতুল্য হয়েছিল- রাতে মশা, দিনে মাছি- এই নিয়ে কলকাতায় আছি। বিদেশি ভাষা রপ্ত করা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে তা নিয়ে আদিখ্যেতা করা দৃষ্টিকটু। বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলও মাত্র তিন বছর বয়সে গ্রিক ভাষাটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। মিল যে শুধু একটি বিদেশি ভাষাই শিখেছিলেন তা নয়। সেই সঙ্গে তিনি পড়তে শুরু করেছিলেন ইংল্যান্ডের ইতিহাস শিল্প ও সাহিত্য। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জেরেমি বেন্থাম ছোটবেলায় প্রতিভাসম্পন্ন বালক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিন বছর বয়সেই নাকি তার পিতার পড়ার টেবিলে স্তূপকৃত ইংল্যান্ডের ইতিহাসের বিশাল বিশাল ভলি্যুম খুলে খুলে পড়তেন। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে শিখতে শুরু করেছিলেন পৃথিবীর জটিলতম ল্যাটিন ভাষা। যা হোক আমার স্ত্রী কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার কাছে জানতে চাইলেন এরকম আদিখ্যেতার কারণ কী? আমি বললাম এর কারণ সম্ভবত দুটি। হীনমন্যতা ও নিরাপত্তাহীনতা। আমার স্ত্রী বললেন হীনমন্যতা তো বুঝলাম কিন্তু ইনসিকিউরিটি অনুভব করবে কেন? আমি বললাম, ভালো করে খেয়াল করে দেখলে দেখবে এসব লোকজনের বেশিরভাগই নব্য ধনীক শ্রেণির যে কোনো পথে হাতে কিছু কাঁচা টাকা এসেছে। একজন মানুষের টাকা অর্জন করাটাই শেষ কথা নয়। ওটা অর্জনের পর প্রয়োজন সম্মান, স্ট্যাটাস ইত্যাদি। যেহেতু নিজেরা জীবনে স্কুল-কলেজে হয়তো পড়ার সুযোগ তেমন একটা পায়নি কিংবা ইচ্ছে করেই লেখাপড়া করেনি কিন্তু এখন টাকার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তাটাও প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে তোমাকে একটা মজার গল্প শোনাই। বাংলাদেশের সচিবালয়ে যদি কখনো যাও তবে দেখবে ওখানে একটি অদ্ভুত সংস্কৃতি চালু আছে। উচ্চপদস্থ একজন আমলা অপেক্ষাকৃত নিন্মপদস্থ আমলাকে তুমি বলে সম্বোধন করে। এর মূলেও কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা। বলা হয়ে থাকে এই উপমহাদেশে এই অপসংস্কৃতির গোড়াপত্তন করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তার বেশ কিছু গুণ থাকলেও একটি বদঅভ্যাস ছিল। তিনি কাউকে আপনি করে বলতে পারতেন না। সবাইকে সম্বোধন করতেন তুমি বলে। যেখানে শিষ্টাচারে বাধে সেখানে কথাবার্তা চালাতেন ভাববাচ্যে। এর কারণ উদঘাটন করতে গিয়ে জানা যায় ডা. বিধান রায় রাজনীতি ভালো বুঝলেও সিভিল ব্যুরোক্রেসি সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল সীমিত। আর এ জন্য বড় বড় আমলাকে কাবু ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের সবাইকে তিনি তুমি করে বলতেন। এ জন্য ডা. বিধান রায়ের সঙ্গে অনেক বড় বড় আইএস অফিসারের মনোমালিন্যেরও সৃষ্টি হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিধান রায় এমন কোনো রাজা মহারাজা, নবাব জমিদার বংশে জম্নাননি। জন্মেছিলেন সাধারণ এক পরিবারে। তারপরও এ বদঅভ্যাসটি জীবনে তিনি কখনো বদলাতে পারেননি। ধীরে ধীরে তার এ তুমি বলাটাই অতীব এক দৃষ্টি নিন্দিত অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়।

আমার ছোটবেলায় চারটি জিনিস খুব ভয় পেতাম। ভূত, ডাকাত, বন্যা ও পরীক্ষা। ভূতের ভয় আমাদের প্রায় সবার জন্মগত। ১৯৯১-৯২ সালের দিকে ঢাকা ছিল অনেকটাই ফাঁকা। আমরা থাকতাম উত্তরার দিকে। তখনো ফ্ল্যাট বাড়ির রমরমা শুরু হয়নি। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় তাই প্রায়ই ডাকাত পড়ত। ১৯৮৮ সালের বন্যার কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। সমস্ত ঢাকাই প্রায় তলিয়ে গিয়েছিল বন্যার পানিতে। যা হোক মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক যে কোনো পরীক্ষায় আমরা ছিলাম অনেকটা কারাবন্দীর মতো। পড়ার কামরাটিতে সম্পূর্ণরূপে বন্দী। খাবার সময় হলে শুধু মা দরজা খুলে টেবিলে খাবার রেখে যেতেন। আমাদের প্রায় সবাইকে পড়তে হতো পাগলের মতো। পরীক্ষা নামক শব্দটি ছিল আমাদের জীবনে এক বিভীষিকা। কিন্তু এই তো কিছুদিন আগে দেখলাম এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী নির্বিঘেœ ঘুরে বেড়াচ্ছে। জিজ্ঞাস করলাম, তোমার না পরীক্ষা, পড়ছ না কেন? পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে উত্তর এলো- খাতায় কিছু লিখলেই পাস। শিক্ষামন্ত্রী সব শিক্ষককে বলে দিয়েছেন কাউকে ফেল করানো চলবে না। যাদের হাতে আজ দেশের সম্পূর্ণ শিক্ষার ভার অর্পিত তারা কী এক সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছেন। শিক্ষার গুণগতমানের দিকে খেয়াল নেই অথচ বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রী পাস করানোর অসুস্থ এক প্রতিযোগিতায় তারা লিপ্ত। দৈবাৎ যদি কখনো খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় আমি বিছানায় শুয়ে না থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করি। সূর্য ওঠার আগে প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপ দেখতে আমার বেশ ভালো লাগে। নিকুঞ্জ-১ এর দিকটায় গাছপালা সমেত একটি প্রসন্ন ছায়াছন্ন পরিবেশ। তো হয়েছে কী, একদিন হেঁটে হেঁটে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে ফুটপাথে বসে জিরোচ্ছিলাম। পাশে দু-তিনজন অশীতিপর বৃদ্ধ কথা বলছিলেন- জানেন, ভাই আমার শরীরে তো নানারকম ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। উচ্চরক্তচাপ, বহুমূত্র, হাড়ে হাড়ে ব্যথা ইত্যাদি। পাশে বসা দ্বিতীয় বৃদ্ধলোকটি বললেন, আরে ভাই, আপনার তো উচ্চরক্তচাপ, বহুমূত্র, হাড়ে গোড়ে ব্যথা। আমার তো এগুলো আছেই। সঙ্গে কিডনির সমস্যা, পোস্ট্রেট জটিলতা ইত্যাদি। তৃতীয় লোকটি উপরে উল্লিখিত সব রোগের নাম তো বললেনই সঙ্গে যুক্ত করলেন আরও দু-চারটি নতুন রোগের নাম। আমি মনে মনে ভাবলাম হায় খোদা! শরীরের রোগবালাই নিয়েও প্রতিযোগিতা! শিল্প-সংস্কৃতিতেও অসম প্রতিযোগিতা চলছে নির্বিঘেœ। ঈদ উৎসবটি এলেই টিভি চ্যানেলগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে কে কতগুলো নাটক দেখাবে। গুণগতমানের দিকে তাদের কোনো খেয়াল নেই। দেখে খুবই বিস্মিত হতে হয় যে আমাদের দেশে মেধাভিত্তিক নাটক রচিত হয় হাতেগোনা দু-চারটি। দেখে মনে হয় যেন নাটক নির্মাতাদের কোনো দায় নেই, দর্শকদের প্রতি। নেই কোনো ভালো চিত্রনাট্য কিংবা দিকনির্দেশনা। নাটকগুলো প্রায় সবই আঞ্চলিক ভাষা বিকৃত ও ভাঁড়ামিতে পূর্ণ। একটি ভালো নাটকের জন্য প্রচুর গবেষণা ও শ্রম দিতে হয়। এর একটি উদাহরণ দিচ্ছি। প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ১৯৭৭ সালের দিকে যখন ‘শতরঞ্জ কা খিলাড়ি’ চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছিলেন, তার ছবিটিতে একটি দৃশ্য ছিল নলগড়গড়ায় আগুন ধরানো। শতরঞ্জ কা খিলাড়ির প্রেক্ষাপট ১৮৫০ সাল। সত্যজিৎ রায় এ দৃশ্যটি ধারণ করতে গিয়ে খুব চিন্তায় নিমগ্ন হলেন। কারণ ১৮৫০ সালের দিকে হুঁকায় আগুন ধরানোর জন্য কী ব্যবহার হতো- দেশলাই না কী জ্বলন্ত মালসার টিকে। শুধু এই একটি নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য দৃশ্য ধারণ করার জন্য সত্যজিৎ রায় ছয় মাস গবেষণা করেছিলেন। কবে ভারতবর্ষে প্রথম দেশলাই চালু হয় ইত্যাদি। এ ব্যাপারগুলো নিয়ে তিনি অনেক কাগজপত্রও ঘেঁটেছিলেন। এই উপমহাদেশে প্রথম দেশলাই চালু হয় ১৮৫৮ কিংবা ১৮৬০ সালের দিকে। তবুও সত্যজিৎ তার শতরঞ্জ কা খিলাড়ীতে দেখিয়েছেন যে যখন জেনারেল উটরামকে ওয়াজিদ আলি শাহ দেখা করার জন্য ডেকে পাঠান তখন তিনি সামনে গড়গড়া থেকে জ্বলন্ত টিকে চিমটে করে তুলে তার সিগার ধরালেন। সত্যজিৎ বাবুর মালসায় টিকে দিয়ে সিগার ধরানোর ব্যাপারটি এসেছিল ১৮৫৬-৬০-এর মধ্যে ছাপা জিএফ অ্যাটকিনসের ‘কারি অ্যান্ড রাইস’-এর ডেকচিপুর শহরের ‘আওয়ার প্যাড্রি’ ছবিটি দেখে। এ ছবিটিতে দেখা যায় যে, পাদরী সাহেবকে একজন চাকর পেছন থেকে কোট পরিয়ে দিচ্ছে আর তিনি সামনে আর একজন চাকরের হাতে ধরা টিকের মালসা থেকে সিগার ধরিয়ে নিচ্ছেন। দর্শকদের প্রতি কতটা নিষ্ঠাবান হলে একজন পরিচালক ছয় মাস শ্রম দেন শুধু একটি বস্তুনিষ্ঠ তথ্য আবিষ্কারের জন্য। এ জন্যই সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকরা ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছেন।

সাহিত্য জগতেও সেই একই দুরবস্থা। প্রতি বইমেলায় নতুন নতুন বই প্রকাশের ধুম পড়ে যায়। মৎস্য ডিম্বের মতো প্রকাশিত হয় সহস্রাধিক বই। রসনা বিলাসের দিক থেকে মৎস্য ডিম্বেরও কিছুটা উপযোগিতা আছে বটে। কিন্তু মাছের পোনার মতো প্রকাশিত সেই সব বইয়ের অধিকাংশেরই কোনো সারবস্তু নেই। বর্তমানে লিখিত অধিকাংশ উপন্যাসে নেই কোনো মেধা, মনন, কিংবা সৃজনশীলতার ছোঁয়া। সবই যেন চর্বিত চর্বন। কোনোটি অতিশয় ম্রিয়মাণ কিংবা কোনোটি উগ্র অগ্ন্যুৎপাত, আলো কিছু নেই তাতে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু ইসহাক, শহীদুল্লাহ কায়সার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক ও দু-একজন হাতেগোনা সাহিত্যিকের সাহিত্যের পর অসীম শূন্যতা। তবে সমকালীন দু-চারজনের লেখায় দেখা যায় আলোর স্ফুরণ। এদের মধ্যে হয়তো কেউ কেউ ভবিষ্যতে পাদপ্রদীপের পূর্ণ আলোতে হবেন উদ্ভাসিত, অর্ধালোকে ভাবীকালের জন্য অপেক্ষমাণ। তাদের মধ্যে ছোট গল্পে মেহেদী উল্লাহ, শাহানাজ মুন্নী, প্রশান্ত মৃধা, অদিতী ফাল্গ–নী, উম্মে মুসলিমা ও আরও দু-একজনকে আমার বেশ সম্ভাবনাময় বলে মনে হয়। মেহেদী উল্লাহর কিছু গল্প দুর্বোধ্য হলেও তিনি সাহিত্যের ছোট গল্পে নিজস্ব ও নতুন একটি আঙ্গিক তৈরিতে নিমগ্ন। মেহেদী উল্লাহ ‘সিংহবাড়ির কুত্তার ইতিহাস’ গল্পটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তসলিমা নাসরিন, ভার্জিনিয়া উলফ, সিমন দ্য বোভেয়াররা। সবাই একত্রে মিলে নারীবাদীর সপক্ষে যা করতে পারেনি, মেহেদী উল্লাহ সিংহবাড়ির কুত্তার ইতিহাস গল্পে সেটা মাত করে দিয়েছেন। শাহানাজ মুন্নীর ‘ব্যান্ডি ওবাদুর’ গল্পটি পড়ে আনন্দিত হয়েছিলাম। লেখকদের লিখতে হয় নির্মোহভাবে। কোনো দলের কাছে মাথা বিক্রি করে দিলে সে আর মননশীল লেখক হতে পারেন না।

                লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর