এ বছরের ৬ জুন ২০১৫ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এলেন। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়ার মাধ্যমে ৩৬ ঘণ্টার এ সফর সমাপ্ত হয়। এ ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমার এ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই সারা বিশ্ব এ নিয়ে পোস্ট মর্টেম করবে, খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে কারণ ও ফলাফল।’ এ সফর দুই দেশের জনগণকে এতটাই আন্দোলিত করেছে, দেশ দুটির অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অথবা অন্য কোনো বিষয়ে আন্তর্জাতিক অবস্থান নিরূপিত হলে, তা মোদি সফরের পূর্বাপর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়। তবু সফর-পরবর্তী দুই দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবস্থান কোন দিকে এবং পারস্পরিক আচরণের ফলে সৃষ্ট ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কেমন; তা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সব ধরনের ষড়যন্ত্রের পথ পরিহার করে শান্তির পথে অগ্রসরমান। তা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত। একটি দেশে শান্তি আপনা-আপনি আসে না। সব ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতার বহিঃপ্রকাশের মাত্রাই হলো ‘শান্তি’। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় শতভাগ সফল। ২৬ জুন ২০১৫ তারিখে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস’ কর্তৃক বিশ্বের ১৬২ দেশের জরিপে শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এশিয়ায় ৩ নম্বরে উঠে এসেছে। জরিপে প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সহিংসতার মাত্রা এবং সামরিক গতিবিধি বা শাসন বিবেচনায় আনা হয়েছে। তিনটি বিবেচ্য বিষয়ের ক্ষেত্রে, প্রথম দুটির সাধারণ ধারণা আমরা সার্বক্ষণিক পাচ্ছি। আর সামরিক শাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদ সংযোজিত করে স্থিতিশীলতা আনয়ন করা হয়েছে। যুগোপযোগী এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছি। ৭ জুলাই ২০১৫ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং তামাকের কারণে মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের ক্রম অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপটি হলো তামাকজাতীয় পণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ৭৫ শতক বেশি করারোপ করা। বিশ্বে এরূপ পদক্ষেপ নিতে পেরেছে মাত্র সাতটি দেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ভারতে করারোপের পরিমাণ ৬০ শতাংশের একটু উপরে। শুধু করারোপ করে নয়, বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা থাকায় তামাকের ব্যবহার বাংলাদেশে আশানুরূপ গতিতে কমে আসছে। এ সফলতায় অর্থনীতির ভিত্তিও মজবুত হচ্ছে। কেননা এর মাধ্যমে শ্রমশক্তি আক্রান্ত হয় এবং চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। তবে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। বংলাদেশের এ সফলতা আজ বিশ্ব স্বীকৃত। উল্লিখিত জরিপে তামাকের ব্যবহার এবং তামাকের কারণে মৃত্যুর হার কমানোর সফলতায় আমরা ভারতকে পেছনে ফেলতে পেরেছি। ৬ থেকে ৩১ জুন; ছিটমহল বিনিময় বিষয়ে দুই দেশের মানুষের মধ্যে ছিল তীব্র উত্তেজনা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছিল ভারতের ১১১টি ছিটমহল আর ভারতের অভ্যন্তরে ছিল বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহল। ছিটবাসীর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টি বিবেচনায় আনা যাক। জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে সাত শতাধিক ভারতীয় নাগরিক তাদের নিজ দেশ ভারতে ফিরে গেছেন। তবে এরূপ মায়া ত্যাগ করে একজন বাংলাদেশি নাগরিকও বাংলাদেশে ফিরে আসেননি। বলা যায়, আমরা কারও মন জয় করতে পারিনি। ভারত যা পেরেছে আমরা তা পারিনি কেন? কারণ একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশকে অকার্যকর, অস্থিতিশীল ও জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে দেশপ্রেম ও ধর্মপ্রেম অর্থহীন ও ক্ষীণ।
ফেলানীর বিষয়টি অনেক পুরনো। ৩ জুলাই ২০১৫ তারিখে পুনঃবিবেচনার রায় হয়। বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারানো মেয়েটি সুবিচার না পেলেও সে ভারতীয় বিশেষ সংস্থার বিচারব্যবস্থা ও নীতিজ্ঞানহীন অবস্থানকে আঘাত করতে পেরেছে। এ ঘটনায় বিশ্ববিবেকের কাছে ভারত প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে আংশিক পরাজিত হয়েছে। ভারতসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করায় পরাজয়ের ছাপটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত ভারতের সুপ্রিমকোর্ট বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। বিশেষায়িত সংস্থার নীতিভ্রষ্টতায় ভারতের সুপ্রিমকোর্ট দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করায় বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। তাই বলা যায়; দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তৈরিতে তিনি সবসময় বায়ু, পানি ও পাখির মতোই নির্ভেজাল। তা ভ্রমণ-পরবর্তী প্রতিটি পদক্ষেপেই প্রমাণিত হচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষ চায় ইতিবাচক পরিবর্তন। এই পরিবর্তন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক; যে কোনো বিবেচনায় ভাবা যেতে পারে। বাংলাদেশের ইতিবাচক পরিবর্তন আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক জনপ্রিয় একটি ওয়েবসাইট ‘ডেইলি পজিটিভ’ কর্তৃক প্রকাশিত একটি তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন উল্লেখ করা হলো। এই প্রতিবেদনে বিশ্বের সব দেশ বিবেচনায় নিয়ে ইতিবাচক দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে ইতিবাচক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম এক নম্বরে উঠে এসেছে (সূত্র : বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক; ৩ নভেম্বর ২০১৫ খ্রি.)। উল্লেখ্য, ৫৫৬ পয়েন্ট পেয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ইতিবাচক দেশের অবস্থানে সুুইজারল্যান্ড। মজার ব্যাপার হলো, এই তালিকায় যৌথভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নামটি যুক্ত হয়েছে। ইতিবাচক পথ চলার সর্বশেষ মাইল স্টোন হলো; ১১ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অনুকরণীয় সম্মান প্রদর্শন করেছে। আন্তর্জাতিক শান্তি ও সংহতির ক্ষেত্রে শুধু ভারত নয়, বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরির বিভিন্ন মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব। ইতিবাচক পথ চলায় বাংলাদেশ দিন দিন আরও সফলতা অর্জন করুক, এ কামনা আমার, আপনার, সবার।
লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।