শিরোনাম
সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সংকটে মানবতা : সর্বত্র রক্ত আর লাশ

ড. শেখ আবদুস সালাম

সংকটে মানবতা : সর্বত্র রক্ত আর লাশ

দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর সারা দুনিয়া এখন আবারও এক অস্থির সময় পার করছে। গত দুই যুগ বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের কোনো না কোনো এলাকা প্রতিদিনই মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। মানুষ নামের একদল অসুর মানুষের রক্ত এবং জীবন নিয়ে যেন এক অশুভ খেলায় মেতে উঠেছে।  আপতদৃষ্টিতে এই খেলার ধর্ম কিংবা সংকীর্ণ গোষ্ঠী চিন্তার আলখেল্লার আবরণ জড়ানো থাকলেও এই খেলা হচ্ছে মূলত রাজনৈতিক স্বার্থের অথবা ক্ষমতা আর অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের খেলা। এসব খেলা যারা পরিচালনা করছে কিংবা সরাসরি যারা এতে অংশ নিচ্ছে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কখনো ধর্মের, কখনোবা শিয়া-সুন্নি তথা সম্প্রদায়গত জার্সি এঁটে এতে অংশ নিচ্ছে। এ খেলার নির্মমতার শিকার হয়ে দেশে দেশে অগণিত মানুষের রক্ত ঝরছে, প্রাণ যাচ্ছে হাজার হাজার নিরীহ আদম সন্তানের। আমরা তামাম দুনিয়ার মানুষ যারা এসব খেলা কাছে কিংবা দূরে থেকে এমনকি গণমাধ্যমে প্রত্যক্ষ করছি তাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটাতে হচ্ছে আতঙ্ক, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যদিয়ে। কেবলই মনে হচ্ছে পৃথিবী নামক গ্রহটিতে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সুন্দর আর নিরাপদ পরিবেশ উপহার দিয়ে যেতে পারব না।

অতি সম্প্রতি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে যে অকল্পনীয়, দুঃখজনক আর ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে গেল তা আমাদের দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনাকে কেবল বাড়িয়ে দিচ্ছে। গত শুক্রবার (১৩ নভেম্বর) প্যারিস নগরীর মানুষ যখন তাদের কৃষ্টি-কালচারের অংশ হিসেবে সাপ্তাহিক ছুটির আগ রাতে একটু আনন্দ-উল্লাসের মধ্যদিয়ে রাতের শুরুতে স্টেডিয়াম (স্বাদ দো ফ্রঁস), রেস্তোরাঁ (লো পতি কবোজ), কনসার্ট হল (বাতাক্লঁ), বার (লা বেল ইকুইপ), পিৎজার দোকান (কাসা নম্ভ্রা), বুলভার্দ ভলতেয়ার সড়ক প্রভৃতি জায়গায় সময় উপভোগ করতে জড়ো হয়েছে তখনই ঘটে গেছে সাম্প্রতিক সময়ের এক ভয়াবহ দুঃখজনক ঘটনা। সেদিন রাত ৯.২০ মি. থেকে রাত ১০টার মধ্যে মাত্র ৪০ মিনিট সময়ে প্যারিসের অন্তত ছয় জায়গায় সন্ত্রাসীরা যত্রতত্র গুলি চালিয়ে প্রাণ নিয়ে নিয়েছে অন্তত ১৩০ জন নিরপরাধী মানুষের। মারাত্মকভাবে জখম করেছে আরও ৩৫২ জনকে। কী জানি এদের মধ্যেও যেন কতজনের জীবন প্রদীপ নিভে যায়। 

২০১৫ সালের শুরুতে এই শহরটি প্রত্যক্ষ করেছিল এমনই আর একটি লোমহর্ষ ঘটনার, নিকাশ কালো এক অভিজ্ঞতার। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি প্যারিসে একটি ব্যঙ্গ পত্রিকা- শার্লি এবদো কার্যালয়ে একটি ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠী হামলা চালিয়ে হত্যা করেছিল ১১ জনকে। এবার বছরের শেষদিকে সাম্প্রতিক এ ঘটনাকে অনেকে উল্লেখ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্রান্সে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা বলে। ওঁলাদ সরকার ফ্রান্সে এ কারণে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সে এটাই প্রথম ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা। শার্লি এবদো পত্রিকা অফিসে সশস্ত্র আক্রমণ আর মানুষ হত্যার পরে একটি ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠী এর দায় স্বীকার করেছিল। পত্র-পত্রিকায় দেখেছি এবারও এই হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস জঙ্গি গোষ্ঠী। গুলি করার সময় হামলাকারীরা উচ্চারণ করেছে- ‘এটার জন্য তোমাদের প্রেসিডেন্ট ওঁলাদ দায়ী, সিরিয়ায় হামলায় অংশ নেওয়ার পরিণতি’। উল্লেখ্য, মার্কিনিদের নেতৃত্বে আরব দেশগুলোতে সন্ত্রাস-জঙ্গি দমন অভিযানে বহুজাতিক বাহিনীর অংশ হিসেবে গত ৭-৮ বছর ফ্রান্সের উপস্থিতি খানিকটা জোরালো।

স্মর্তব্য, মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া ও ইরাককে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক বছর ধরে বলা যায় এক ভৌতিক যুদ্ধ চলছে- সেখানে প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ আর অনবরত চলছে এক ধ্বংসযজ্ঞ। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স; একদিকে রাশিয়ার আশীর্বাদ নিয়ে সিরিয়া, ইরাক ও ইরান সরকার; আর একদিকে এদের বিরুদ্ধে উগ্র জেহাদপন্থি ইসলামিক স্টেটস অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইসিস)। এদের পারস্পরিক বোমা আর গুলির আঘাতে বহু বছর ধরে ধ্বংসলীলা চলছে আর অশান্তি বিরাজ করছে বাগদাদ থেকে ভূমধ্যসাগরের তীর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায়, সেখানে ধ্বংস হচ্ছে সভ্যতা ও জনপদ। ফলে এই অঞ্চলের হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ তুরস্ক, জর্ডান, লেবানন কিংবা ইতালি হয়ে আশ্রয় খুঁজছে ইউরোপের নানা দেশে। উপরে উল্লিখিত ৩ গোষ্ঠীর অস্ত্রের দাপটে মধ্যপ্রাচ্যে একদিকে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে শত শত মানুষ, পাশাপাশি ‘কোল্যাটিরাল ড্যামেজ’-এ প্রাণ হারাচ্ছে নারী-শিশুসহ অগণিত আদম সন্তান। এতে যেন কারও কিছু আসছে যাচ্ছে না। এ যেন রক্ত তৃষিত এক বন্য উন্মাদনা।

১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বায়নের নামে নতুন এক বিশ্বব্যবস্থায় অল্পদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয় দেশে দেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। লিবিয়া, ইরাকসহ সার্বিয়া, আফগানিস্তান এবং হালে ইয়েমেনের অবস্থা; পশ্চিম সাহারার মৌরিতানিয়া থেকে নাইজার, নাইজেরিয়া, চাদ, সুদান, সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, মিসর সর্বত্র যেন এক অঘোষিত যুদ্ধ লেগে রয়েছে। ৬০-৭০ বছর ধরে চলে আসা ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ আজও শেষ হলো না। পরাশক্তিগুলো তা যেন কেবল জিইয়ে রেখে শান্তি পাচ্ছে। এগুলো ঠেকানোর কেউ নেই। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি, ওয়াহাবি- হানাফি, আলাভি-সালাফি এসব দ্বন্দ্ব আসলে এখন যেন ইসলামের মূল দর্শনকেই পরাজিত করতে যাচ্ছে; শান্তি নামক পায়রাটিকে তারা প্রতিদিনই হত্যা করে চলেছে। মুসলমান নামধারী এসব দেশের যুদ্ধরত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো আজ প্রকারান্তরে ইসলাম ধর্মকেই কেবল কলঙ্কিত করছে।

এসবের নাটের সুতা কার হাতে তা এখন খুঁজে বের করার সময় এসেছে। সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক হিসেবে ইসলামের লেবাসধারী এসব জঙ্গি গোষ্ঠী নিজেরা কিংবা অন্য কারও দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে তারা মানবসভ্যতা ধ্বংস করতে লিপ্ত হয়েছে কিনা তা ভাবার সময় এখনই। ঘটনার ঘটক কিংবা অনুঘটক তাদের উদ্দেশ্যে কেবল এতটুকুই বলা প্রয়োজন যে, এক সময় এই খেলার মাঠ ছিল প্যালেস্টাইন আর ইসরায়েলের দখলকৃত এলাকা নিয়ে সৃষ্টি ময়দানে। এই খেলার মাঠ কিন্তু আস্তে আস্তে সম্প্রসারিত হয়ে ইউরোপের দোরগোড়ায় চলে গেছে, চলে যাচ্ছে মহাপরাশক্তি মার্কিন মুল্লুকেও। এই খেলা এখনই বন্ধ করা দরকার। সারা বিশ্বে বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে এই জঙ্গি এবং মানবতাবিরোধী দানব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দূর থেকে উড়ে এসে বোমা মেরে কিংবা এসব দেশের সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি করে কিংবা তা উসকে দিয়ে এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো যাবে বলে মনে হয় না। বরং এসব দেশের ভিতরের সব শক্তির সঙ্গে আলোচনা করে ন্যায্য সমাধান খোঁজা খুবই জরুরি।  নইলে এই পৃথিবীকে কেবল রক্ত আর লাশের খেলা দেখতে হবে।  আর এটা চলতে থাকলে সংকটে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে মানবতা। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই মহাসত্যটি তখন মহামিথ্যায় পরিণত হয়ে যাবে। 

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক।

E -mail : [email protected]

সর্বশেষ খবর