বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

স্বৈরাচার মুক্তির রজতজয়ন্তীতে...

সৈয়দ বোরহান কবীর

স্বৈরাচার মুক্তির রজতজয়ন্তীতে...

এ বছর এরশাদের পতনের রজতজয়ন্তী। স্বৈরাচারের শৃঙ্খল থেকে গণতন্ত্রের ২৫ বছর পূর্তি হলো। এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আবার নতুন করে সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রার সূচনা হয়েছিল। ’৯০-এর ওই দিনগুলো এখনো চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে ভাসে। ৬ নভেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এক জনসমুদ্রে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই কীভাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যায়, তার রূপরেখা ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করবেন। রাষ্ট্রপতি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করবেন এবং ওই উপরাষ্ট্রপতির কাছে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করবেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯ নভেম্বর তত্ত¡াবধায়ক সরকার কাঠামো এবং আগামীর সরকারের করণীয় নিয়ে ঘোষিত হলো ‘তিন জোটের রূপরেখা’। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮-দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭-দলীয় জোট এবং বামমোর্চাদের পাঁচ দল একসঙ্গে এই অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা করে। রূপরেখায় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা অঙ্গীকার করা হয়। অঙ্গীকার করা হয় এরশাদ ও স্বৈরাচারের সহযোগীদের বিচারের। তাদের কোনো রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়ার। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসির সামনে চিকিৎসকদের এক মিছিলে গুলি করে এরশাদের লেলিয়ে দেওয়া পেটোয়া বাহিনী। মারা যান ডা. মিলন। মুহূর্তে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলনে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে ঢাকা। গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য। পরিস্থিতি সামাল দিতে গণমাধ্যমের গলাটিপে ধরার চেষ্টা করেন স্বৈরাচার এরশাদ। ফরমান জারি করা হয়, সংবাদপত্রে কোনো খবর ছাপার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের (রাজনৈতিক) অনুমোদন নিতে হবে। গণমাধ্যম কর্মীরা এর প্রতিবাদে সব সংবাদপত্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। আন্দোলন পায় নতুন মাত্রা। এ সময় এরশাদের মূল শক্তির ভিত নড়ে যায়। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নূর উদ্দিন, জনগণের প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনী নয় বলে ঘোষণা করেন। এরশাদ নতুন চাল চালেন। যে কূট-কৌশলে এরশাদ দীর্ঘ নয় বছর জনসমর্থনহীন হয়েও ক্ষমতায় ছিলেন, আবার সেই কৌশলের আশ্রয় নেন। বিরোধী দলের মধ্যে বিভক্তি। ’৮৬-তে এই কৌশলে তিনি সফল হয়েছিলেন। বিরোধী দলের মধ্যে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। অথচ ওই সময় সব বিরোধী দল একযোগে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতো। এবার এরশাদ এবং তার অনুগত নেতারা তত্ত্বাবধায়ক  সরকারের প্রধান কে হবেন, বিরোধী দলকে তার নাম দিতে বলেন। এরশাদ নিশ্চিত ছিলেন, অন্যসব ইস্যুর মতো এই ইস্যুতেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একমত হতে পারবে না। আন্দোলন আরেকটা ব্যর্থতার পথে বাঁক নেবে। এ সময় রাজপথের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। সংস্কৃতি কর্মী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ স্বৈরাচার মুক্তির আন্দোলনে একাÍ হতে থাকেন। সচিবালয় থেকে বেরিয়ে আসেন সরকারি কর্মকর্তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পদত্যাগ করেন। এরশাদের ঘোষণার পর জনমনে আশঙ্কা হয়, বিরোধী দলগুলো কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান প্রশ্নে একমত হতে পারবে? কিন্তু ৪ ডিসেম্বর অপরাহে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমদের বাসায় তিন জোটের নেতারা মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে তৎকালীন সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নাম ঘোষণা করেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ প্রথমে এই দায়িত্ব গ্রহণে রাজি ছিলেন না। তাকে শেখ হাসিনা সরাসরি ফোন করে দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। নির্বাচনের পর আবার পূর্ব পদে ফিরে যেতে পারবেন- এই অঙ্গীকারের বিনিময়ে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতে রাজি হন। ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হয়। নয় বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয় কিন্তু আসলে নয় বছর নয়, ১৫ বছরের জংলি, অসাংবিধানিক এবং অগণতান্ত্রিক শাসনের অবসান হয়। বস্তুত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের সূচনা হয়। স্বৈরশাসনের অবয়বটা ছিল পাকিস্তানপন্থি এবং গণবিরোধী। আরও সহজ করে বললে বাংলাদেশ পরিপন্থী। জিয়া ক্ষমতায় এসে রাজনীতিতে কালো টাকার অনুপ্রবেশ ঘটান, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যথেচ্ছ ব্যবহার করেন। জনগণের অধিকারকে স্তব্ধ করে দেন। সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল উৎপাটন করেন। জিয়ার অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করাই ছিল এরশাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য। এরশাদও জিয়ার মতোই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বহাল রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখেন। বঙ্গবন্ধুর আÍস্বীকৃত খুনিদের জিয়া কূটনৈতিক চাকরি দিয়েছিলেন, এরশাদ পদোন্নতি দেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের যে কাজ জিয়া শুরু করেছিলেন এরশাদ তা বেগবান করেন। রাজনীতিকে কলুষিত করেন, কেনাবেচার রাজনীতির মাধ্যমে ‘রাজনৈতিক টাউট’দের ক্ষমতাবলয়ের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং এরশাদের জাতীয় পার্টির নীতি, আদর্শ এবং সাংগঠনিক কাঠামোর কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। দুটো দলই ‘ইসলাম’কে ব্যবহার করেছে। সাংগঠনিকভাবে দুই দলেই চেয়ারম্যানের ক্ষমতা অসীম। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর মানুষ ছিল বিভ্রান্ত, অপ্রস্তুত, এলোমেলো। তাই জিয়াউর রহমানকে বড় ধরনের কোনো আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়নি। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জিয়াকে সামরিক বাহিনীর ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হয়েছিল। জিয়া সব সময়ই বিশ্বাস করতেন, তার পতন কোনো গণঅভ্যুত্থানে হবে না। সামরিক অভ্যুত্থানে হবে। (সূত্র : এ লেগেসি অব ব্লাড, এন্থনি ম্যাসকারনহাস)। জিয়া তার শাসনকালের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন ষড়যন্ত্রে এবং প্রতি ষড়যন্ত্র মোকাবিলায়। জিয়ার সংক্ষিপ্ত শাসনামলে কমবেশি ১৭টি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় বলে লরেন লিফসুইস তার ‘আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এ সময়ে ৩০ হাজারের বেশি সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু এতকিছু করেও রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত একটি সাময়িক অভ্যুত্থানে জিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কারা, কেন তাকে হত্যা করেছিল, এখনো তা ইতিহাসের অনাবৃত অধ্যায়। এমনকি জিয়ার মৃত্যুর পর দুই দফায় তার দল ক্ষমতায় থাকলেও ওই হত্যার তদন্তের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। জিয়ার অপকর্ম, অপশাসন, জনবিরোধী উদ্যোগগুলো জনগণ বুঝে ওঠার আগেই তিনি নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে জিয়ার ‘ইমেজ’ তৈরি করে। তাকে সৎ দেখানোর চেষ্টা, সহায়-সম্বলহীনভাবে উপস্থাপন ইত্যাদি ‘সফল প্রোপাগান্ডায়’ এখনো জিয়ার একটা আলাদা ভাবমূর্তি রয়েছে। এরশাদ জিয়ার সততার জার্সি গায়ে লাগিয়েই ক্ষমতার মাঠে প্রবেশ করেন। বিচারপতি সায়েমের কাছ থেকে জিয়াউর রহমান যেভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, এরশাদ একই কায়দায় বিচারপতি সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন। জিয়ার মতোই এরশাদ সততার জিকির তোলেন। সাইকেল চালিয়ে অফিসে গিয়ে কৃচ্ছ্রগ্লাসে জিয়া ছিল যতটা দুর্বোধ্য, ফ্যাশনসচেতন, গলফপ্রেমী এরশাদ ছিল ততটাই পাঠযোগ্য। এরশাদের ছলাকলা, প্রতারণা, মিথ্যাচার সবই মানুষ দ্রুতই ধরে ফেলতে থাকে। আরেকটি বিষয়ে জিয়া ও এরশাদের পার্থক্য ছিল। জিয়াউর রহমান ছিলেন তার প্রতিপক্ষের ব্যাপারে নির্দয়, অনুকম্পাহীন। এরশাদের কবিহƒদয় ছিল আবেগমথিত। তাই ‘এরশাদ’কে আমরা কোমল হƒদয়ের স্বৈরাচার বলতে পারি। তিনি কবিতা লিখতেন বা কারও কারও কবিতা তার নামে প্রকাশিত হতো। তিনি সকাল দুপুর সন্ধ্যা প্রেম করতেন। এ জন্যই অন্যসব স্বৈরশাসকের মতো এরশাদের পাশবিক তিরোধান হয়নি। এরশাদ জেল খেটেছেন, এখনো অনেক মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন। গত ২৫ বছরে তিনি ‘খলনায়ক’ থেকে ‘রাজনৈতিক ভাঁড়ে’ পরিণত হয়েছেন। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাকে ডাস্টবিন থেকে শোভিত ড্রইং রুমে বসিয়েছে। স্বৈরাচারী এরশাদ এখন গণতন্ত্রের ভারসাম্যে পরিণত হয়েছেন, এটাই বোধহয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রহসন।

বাংলাদেশের বিভক্ত সমাজে আমরা খুব কম সময়েই বেশির ভাগ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছি। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ধাপগুলোতে এবং চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলাম (কিছু রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া)। ৯০ এ এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও জাতি মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ‘এরশাদ’ কোনো ব্যক্তি নন, এরশাদ একটি প্রতীক। এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তাদের অভিভাবকের দুর্নীতি অপছন্দ করেছে। নেতার অসততার প্রতি ঘৃণা জানিয়েছিলেন। সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির ভ্রষ্টাচার প্রত্যাখ্যান করেছে। অবৈধ, অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখলকে ‘না’ জানিয়েছিল। ড. আকবর আলি খান বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পার্থক্য দেখাতে গিয়ে দেখিয়েছেন যে, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সব থেকে বেশি হয়েছে সেনা প্রশাসন এবং অবৈধ একনায়কের হাতে। আর বাংলাদেশের অগ্রগতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, হোক না তা যতই ভঙ্গুর। তাই জনগণের অগ্রগতি ও উন্নয়নের আকাক্সক্ষা থেকেও এ দেশের মানুষ এরশাদকে ‘না’ বলেছিল।

৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরপর আমরা যেমন স্বপ্নেও ভাবিনি, বাংলাদেশ আবার রাজাকারদের দখলে চলে যাবে। স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে আমাদের রক্তøাত পতাকা উড়বে। স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধীরা আস্ফালন করবে। তেমনি আমরা ৯০-এ এরশাদের পতনের পরপর আমরা ভাবিনি, এরশাদ রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হবে, এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর দূত হবে। গণতন্ত্র নিয়ে নসিহত দেবে। তাকে ছাড়া ‘গণতন্ত্র’ পূর্ণতা পাবে না।

৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের চার বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী পুনর্বাসিত হতে শুরু করে। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর তাদের পুনর্বাসিত হতে সময় লাগে মাত্র চার মাস। ৭০-এর পরাজয়ের ২০ বছর পর, স্বাধীনতাবিরোধীরা মন্ত্রিত্ব দখল করে। বাংলাদেশের পতাকা তাদের গাড়িতে উড়িয়ে দেয়। স্বৈরাচারের দোসররা মন্ত্রিত্ব পায় পতনের মাত্র পাঁচ বছর পর। পাঁচ বছর কী? এরশাদের পতনের রেশ কাটতে না কাটতেই তার প্রধান দুই সিপাহসালা, দুই গুরুত্বপূর্ণ সচিব যোগ দেন বিএনপিতে। বিএনপি তাদের মনোনয়ন দেয়। অথচ সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য ঘোষিত স্বৈরাচারের দোসরদের তালিকায় এ দুই সচিবের নাম ছিল। এরশাদ যাদের বারিধারায় প্লট দিয়েছিলেন, যাদের পদোন্নতি দিয়ে অধ্যাপক বানিয়েছিলেন রাতারাতি তারা জিয়ার সৈনিকে পরিণত হন। আমি জানি, আমার এ তুলনা অনেকের কাছে ঘোড় আপত্তির বিষয় হবে। স্বৈরাচার আর যুদ্ধাপরাধ কি এক বিষয় হলো? যুদ্ধাপরাধীরা তো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তারা এখনো বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর জন্য প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র করে। স্বৈরাচার কি তা করে? যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে স্বৈরাচারের অপরাধ তুলনীয় নয়। ইত্যাদি অজুহাত সামনে আসবেই।

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের একটু গভীরে যেতে হবে। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই এ জন্য শুধু নয় যে তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, গণহত্যা করেছে, লুটপাট অগ্নিসংযোগ করেছে। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই এ জন্য যে তারা আমাদের শেকড় উপড়ে ফেলতে চেয়েছে। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই এ জন্য যে, তারা আমাদের চেতনা বিনাশ করতে চেয়েছে। তারা আমাদের অস্তিত্ব ধ্বংস করতে চেয়েছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। পাঠক, একটু চিন্তা করুন, স্বৈরাচার আমাদের শেকড় উপড়ে ফেলে কিনা? এরশাদ ক্ষমতায় এসেই ড. মজিদ খানের নেতৃত্বে একটি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল, গঠন করেছিল সংস্কৃত কমিশন। এরশাদ রাজনীতিকে খোলাবাজারের পণ্যের মতো বেচাকেনা করেছিল। এরশাদ রাজনীতিতে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের প্রবেশ ঘটিয়েছিলেন। এসব কি আমাদের অস্তিত্বের ওপর আঘাত নয়? এসব কি আমাদের চেতনাবিনাশী নয়?

অনেকেই বলেন, এরশাদ তো তার শাস্তি পেয়েছেন। এরশাদের বিচার হয়েছে। লক্ষ্য করে দেখবেন, এই একই কথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শুরুতেও বলা হতো। এরশাদ কিসের শাস্তি পেয়েছেন? চুরির দায়ে জনতা টাওয়ার মামলায় এরশাদ দণ্ডিত হয়েছেন। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত এরশাদের ক্ষমতা দখলকে ‘অসাংবিধানিক’ বলেছে। অবৈধ ক্ষমতা দখলের জন্য কি এরশাদের বিচার হয়েছে? জেনারেল মঞ্জুর হত্যার মামলা নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা চলছে। এটাই যেন এরশাদের ‘জীয়ন কাঠি’। এরশাদকে বশে রাখার চাবি। এরশাদ একটু নড়াচড়া করলেই ওই মামলার তারিখ পরে, আর অমনি এরশাদ ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যান। ঘানির গরু যেমন খুঁটির বাইরে যেতে পারে না, তেমনি এরশাদ বেচারাও ওই মামলার ভয়ে ঠিকমতো নড়তে চড়তে পারেন না। এ তো কেবল মঞ্জুর হত্যা মামলা, কিন্তু ২৭ নভেম্বর, ১৯৯০ এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর হাতে যে নিহত হলেন ডা. মিলন, তার হত্যার বিচার কি হবে? কী হবে ৮৭-এর ১০ নভেম্বর নিহত শহীদ নূর হোসেনকে হত্যার বিচার? এরশাদের ট্রাকের চাপায় পিষ্ট সেলিম, দেলোয়ার হত্যার বিচার কী কোনো দিন হবে? বিচার পাবে জয়নাল, জাফর, দীপালী, কাঞ্চন, রাউফুন বসুনিয়ার পরিবার? ৭১-এর শহীদ পরিবাররা যেমন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বিচারের জন্য কেঁদেছে, রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন দেখেছে, তেমনি স্বৈরাচারের অপশাসনে নিহতরাও তাদের বেদনা লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না। স্বৈরাচার ও তার অনুগতরা এখন ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে তাদের বিদ্রƒপ করছে। যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমরা জাতির পিতার হত্যার বিচার করেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছি, সেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি অবসানের জন্য এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। বিচার হওয়া প্রয়োজন অবৈধ ক্ষমতা দখলের। প্রশ্ন হলো- বিচার করবে কে? এরশাদ এখন রাজনীতির পেণ্ডুলাম। তিনি তো প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের আরাধ্য। এরশাদ যেদিকে ঝুঁকবে ক্ষমতার বলয়ও সেদিকে হাসবে। এরশাদের বিচারের চেয়ে, তাকে ব্যবহার করা, তাকে অনুগত করে রাখাই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য ও কৌশল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি প্রথম যখন উত্থাপিত হয়েছিল, তখন যেমন বলা হয়েছিল এটা ইতিহাসের মীমাংসিত বিষয়, তেমনি এখন জোরে জোরেই এরশাদের পক্ষে এ কথাগুলো বলা হয়। কিন্তু তারপরও স্বৈরাচার মুক্তির রজতজয়ন্তীতে আমি আশাবাদী। জাতি বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার পেতে ৩৫ বছর অপেক্ষা করেছে, বিচার শুরু হয়েছে একুশ বছর পর। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর জন্য জাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৪০ বছর।

কাজেই স্বৈরাচারের বিচারের সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। একদিন নিশ্চয়ই আবার এ দেশের মানুষ স্বৈরাচারের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হবে। স্বৈরাচার মুক্তির রজতজয়ন্তীতে একটু আশাবাদী হতে দোষ কী?

                লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ই-মেইল: [email protected]

সর্বশেষ খবর