বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
দৃষ্টিপাত

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও প্রচার মাধ্যম

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও প্রচার মাধ্যম

বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন জারি হয়েছে ২০০৫ সালে এবং বর্তমান সরকারের আমলে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, সংশোধন আইন-২০১৩ সালে প্রণীত হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ আইন সম্পর্কে জনগণ যেমন সচেতন নয় তেমনি যারা প্রচারমাধ্যমে কাজ করেন, সিনেমা-নাটক তৈরি করেন তারাও ঠিক ততটা অবগত নন। ফলে দেখা দিয়েছে সমস্যা। এটা সবাই জানেন যে, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন হয়েছে কিন্তু কোনো আইন অমান্য করলে কী সাজা বা আইনে কী বলা হয়েছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই।

প্রথমেই পাবলিক প্লেস সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া যাক- আইনে পাবলিক প্লেস বলতে বোঝায় জনসাধারণ যেখানে সমবেত হয় বা চলাচল করে বা একত্রিত হয় সেরকম স্থানকেই বোঝানো হয়েছে। যেমন : স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২. গ্রন্থাগার ৩. হাসপাতাল, ক্লিনিক ৪. প্রেক্ষাগৃহ ৫. প্রদর্শনী কেন্দ্র ৬. থিয়েটার হল ৭. রেস্টুরেন্ট ৮. শিশুপার্ক ৯. খেলাধুলার স্থান ১০.পাবলিক পরিবহন- বাস, ট্রেন স্টিমার, লঞ্চ, ফেরি ইত্যাদি।

আইনের ৭ক ধারা অনুযায়ী- এ পাবলিক প্লেসের মালিক বা নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাকে ধূমপানমুক্ত রাখতে কিছু পদক্ষেপ অবশ্যই নেবেন। যেমন : (ক) ধূমপান থেকে বিরত থাকার জন্য নোটিস প্রদর্শন। (খ) ধূমপানমুক্ত এলাকায় কোনো ছাইদানি না রাখা।

(গ) ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থানে (যদি ধূমপানমুক্ত স্থান থাকার বিধান থাকে) ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ এবং ‘ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’ লেখা নোটিস প্রদর্শন। (ঘ) কোনো ব্যক্তি ধূমপানমুক্ত এলাকায় ধূমপান করলে ওই এলাকার মালিক বা নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি ধূমপায়ীকে ধূমপান না করার জন্য অনুরোধ করবেন।

(ঙ) ছক (ঘ) বিধান অনুসারে বিরত থাকতে অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি ধূমপান করলে তাকে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করতে পারবেন এবং তাকে কোনো প্রকার সেবা প্রদান হতে বিরত থাকতে পারবেন এবং আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সহায়তা গ্রহণ করবেন।

ধূমপান এলাকার ব্যবস্থা- আইনের ধারা ৭ এর পাবলিক প্লেস-এর কোনো স্থান ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট করতে বা ধূমপানমুক্ত এলাকায় যাতে ধূমপানের ধোঁয়া প্রবেশ করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, রেস্টুরেন্ট, শিশুপার্ক ইত্যাদিতে ধূমপানের জন্য কোনো স্থান রাখা যাবে না ।

২(ক) অনুসারে কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) বিধান লঙ্ঘন করিলে তিনি অনধিক তিনশত টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং দ্বিতীয়বার করিলে দ্বিগুণ হারে দণ্ডনীয় হইবেন।

আইনের ধারা ৮ অনুযায়ী, পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনের প্রবেশপথে এবং অভ্যন্তরে এক বা একাধিক দৃশ্যমান স্থানে  ‘ধূমপান হইতে বিরত থাকুন, ইহা শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ লিখে রাখতে হবে। এ নোটিস বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। (সাইজ ৪০ সেন্টিমিটার *২০ সেন্টিমিটার) এবং সেটা সাদা জমিনে লাল অক্ষরে অথবা লাল জমিনে সাদা অক্ষরে ধূমপানমুক্ত সাইনসহ প্রদর্শন করতে হবে নমুনা পাওয়া যাবে- জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল-এর ওয়েবসাইটে।

আরেকটি উলে­খযোগ্য দিক হচ্ছে- এবারই প্রথম আইনের ১০ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে তামাকের প্যাকেটে, মোড়কে, কার্র্টনে বা কৌটায়, ক্ষতি সম্পর্কিত সচিত্র সতর্কবাণী মুদ্রণ আকারে ছবি ও লেখায় (অনুপাত ৬:১) ছাপতে হবে। ছবিসমূহ ক্রমানুসারে প্রতি তিন মাস পরপর পরিবর্তন করতে হবে। যেমন : ধূমপানের কারণে গলায় ও ফুসফুসে ক্যান্সার হয়, ধূমপানের কারণে স্ট্রোক হয়, ধূমপানের কারণে হৃদরোগ হয় ইত্যাদি ছবিসহ প্যাকেটের গায়ে ছাপতে হবে। বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন জরুরি, কারণ বছরে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ তামাকের কারণে প্রাণ হারায় এবং ৪ লাখ মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করে বলে বাজেটে উলে­খ করা হলেও বর্তমান বাস্তবতা অনেক বেশি ভয়াবহ।

বাজেটে উলি­খিত সংখ্যাগুলো ২০০৪ সালের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য। বর্তমানে প্রতি বছর তামাকজনিত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ, প্রতিদিন মৃত্যুবরণ করছেন প্রায় ৬৮০ জন, প্রতি ঘণ্টায় ২৮ জন, প্রতি ২ মিনিটে ১ জনের মৃত্যু ঘটেছে তামাকের কারণে।

অথচ এটি কোনো বিশ্ব সংবাদে প্রতিদিন দেখা যায় না। শুধু দেখা যায় যদি কোনো প্লেন ক্রাশ করে ২০০ জনের বা আরও বেশি লোকের মৃত্যু হয়, যেমন মৃত্যু হলো গত কিছু দিন আগে মিসরের সিনাই উপত্যকায় একটি রাশিয়া প্লেন ক্রাশে। অথচ তামাকের কারণে প্রতিদিন মৃত্যু হয় প্রায় ৭০০ লোকের।

সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয় গত ১ নভেম্বর, ২০১৫ টিভি নাটকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন-২০১০ প্রতিপালন সম্পর্কে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তাতে কিছু কিছু টিভি চ্যানেল তাদের নাটকের ধূমপানের দৃশ্য প্রদর্শন করেছে এ মর্মে Environment Council Bangladesh সূত্রোক্তপত্রে অভিযোগও করেছেন এবং তারা তার ডকুমেন্টও প্রেরণ করেছেন।

সুতরাং জনসাধারণের উপকার হয় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করাই স্বাস্থ্যসম্মত শুধু নয়, আইন ও বিধিসম্মত। অতএব আমরা আশা করব যারা টিভি, নাটক, সিনেমা নির্মাণ করেন তারা যথেষ্ট আন্তরিক হবেন এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন, যাতে মানুষ তামাকের এ ব্যবহারের কারণে ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, গর্ভপাত, মৃতশিশু প্রসবের মতো জটিল পরিস্থিতির শিকার না হয়। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে যারা খুন, রাহাজানি বা হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত।

তাই আসুন, প্রচার মাধ্যমে বিশেষত টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিবিধান আমরা মেনে চলি যাতে দর্শকরা বিভ্রান্ত না হয় এবং তামাকের ক্ষয়ক্ষতি ও ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হয়।

লেখক : অধ্যাপক ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম।

E-mail : [email protected]

সর্বশেষ খবর