শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বরকতময় জীবন

মুফতি আমজাদ হোসাইন

বরকতময় জীবন

একজন মানুষের জন্য জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে বরকত থাকা অতীব জরুরি। বরকতময় জীবন শান্তিময় হয়, সুখ-শান্তিতে ভরপুর থাকে। সে হায়াতে, সময়ে, সম্পদে বরকত পায়। আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে এমন কিছু মনীষীকে দুনিয়ার বুকে পাঠান। যারা পৃথিবীবাসীর কল্যাণ কামনায় নিজ জীবনকে উৎসর্গ করে দেন। পার্থিব লোভ-লালসা ও সব মোহের ঊর্ধ্বে উঠে মানব সমাজের জাগতিক ও পারলৌকিক শান্তি-মুক্তির আশায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান। তারা শোষিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত ও আল্লাহ ভোলা মানুষদের জন্য সার্বক্ষণিক ফিকির করে থাকেন। মানুষদের সিরাতে মুস্তাকিম ও স্বর্গীয় অনাবিল শান্তি লাভের পথ দেখান। কোন কাজ করলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বরকত পাওয়া যাবে, সে পথের দিশা বাতলিয়ে দেন। খালিক ও মাখলুকের মাঝে সেতুবন্ধনের অবিরাম মেহনত করে থাকেন। সমাজ সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আধ্যান্তিক পরিশুদ্ধতার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার প্রতিটি মুহূর্ত যেন বরকতময় হয়, বরকতশূন্য না হয়, মানব জাতিকে সে বিষয়ে  তালিম দিয়ে থাকেন। তারা তো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বরকত পেতেন। তাদের দ্বারা লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হতেন। কারণ একটিই তা হলো, তারা স্বীয় প্রভুর কাছে নিজেদের সর্বস্ব অর্পণ করে দিয়েছিলেন। যেমন :  আম্বিয়ায়ে কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবেতাবেয়িন, উলামায়ে মুজতাহেদিন, উলামায়ে সলফ ও উলামায়ে খলফদের সুমহান জামাত। ক্ষণজম্না মনীষী হজরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.), হজরত শাহ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.), হজরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রহ.), হজরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.), হজরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কি (রহ.), হজরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.), কুতুবুল আলম আল্লামা কাসেম নানতবী (রহ.), হাকীমুল উম্মত হজরত আশরাফ আলী থানভী (রহ.), শাইখুল ইসলাম সাইয়্যেদ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.), ফেদায়ে মিল্লাত আল্লামা সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী (রহ.), হাকীমুল ইসলাম কারী তাইয়্যেব সাহেব (রহ.), কুতুবুল ইরশাদ মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রহ.), হজরত মুহাম্মদুল্লাহ (হাফেজ্জী হুজুর) (রহ.), মুরশীদে কামেল আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন (ফেনুয়ার হুজুর) (রহ.)সহ প্রমুখ উলামায়ে কেরাম। তাদের জীবন ছিল একেবারে সাদামাটা। পরনে থাকত পুরাতন কাপড়-চোপড়। নরমাল খাবার-দাবার খেতেন। হায় হুতাশ ছিল না। না পাওয়ার বেদনা ছিল না। তারা আল্লাহর কাছে যা চাইতেন তা আল্লাহপাক দিয়ে দিতেন। আল্লাহতায়ালার সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক থাকার কারণে সব কাজে বরকত পেতেন। তারা ছিলেন সাহাবায়ে কেরামদের প্রকৃত উত্তরসূরি। আর সাহাবায়ে কেরামরা প্রিয় রসুল (সা.)-এর সোহবতে থেকে বরকতময় জীবন গ্রহণ করেছিলেন। ফলে দুনিয়াবি কাজকর্ম তাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করতে পারত না। তারা পার্থিব কাজকর্মে লিপ্ত থাকার পরও তাদের জবানে মাওলার জিকির চালু থাকত। মৃত্যুর যন্ত্রণা, কবরের আজাব এবং কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে কী উত্তর দেবে তার ভয় ছিল। সব সময় মাওলার আজাবের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতেন। সাহাবিদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, এমন লোকেরা, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখেন না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। (তারা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে) যাতে আল্লাহ তাদের উৎকৃষ্টতর কাজের প্রতিদান দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও অধিক দেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিজিক দান করেন। (সুরাতুন-নূর : ৩৭-৩৮) আলোচ্য আয়াতের বিষয়বস্তু দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, যারা আল্লাহর বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালনা করবে, আল্লাহপাক তাদের তিনটি জিনিস পুরস্কার দেবেন। এক. তিনি প্রতিটি উৎকৃষ্ট কাজের উত্তম প্রতিদান দেন। দুই. তিনি নিজ অনুগ্রহে অসংখ্য-অগণিত প্রতিদান দেন। তিন. দুনিয়াতে রিজিকের কোনো অভাব রাখেন না। প্রতিটি কাজে বরকত দেন এবং বরকতময় জীবনধারণ করার তাওফিক দান করেন। মৌলিকভাবে যারা হেদায়েতের আলোয়ে জীবন আলোকময় করে তারাই আল্লাহ কর্তৃক এমন বরকত পেয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে বরকতহীন জীবন অশান্তি ও দুঃখে-কষ্টে ভরা থাকে। জীবনের কোনো কাজে বরকত পায় না। অর্থাৎ হায়াতে, সময়ে ও সম্পদে বরকত পায় না। দেখা যায় আল্লাহর দেওয়া হায়াত কখন ফুরিয়ে যায় টেরই পায় না। মাসে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করার পরও উপার্জন বরকতহীন থাকে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যারা কাফের, তাদের কর্ম মরুভূমির মরীচিকার মতো, যাকে পিপাসার্ত ব্যক্তি পানি মনে করে। এমনকি সে যখন তার কাছে যায়, তখন কিছুই পায় না এবং পায় সেখানে আল্লাহকে, অতঃপর তার হিসাব চুকিয়ে দেন। আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।’ (সুরাতুন-নূর : ৩৯) প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করুন! কী কাজ করলে বরকতময় জীবনধারণ করা যায় ও জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে বরকত পাওয়া যায়? সেই কাজটি গ্রহণ করতে হবে। জীবনের সব কাজে বরকত পাওয়ার জন্য আমরা কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করতে পারি। এক. ইমান আনয়নের পর, ইমানের ওপর অটল থাকার সংকল্প করা। দুই. ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদাগুলোকে আদায় করা। তিন. দৈনন্দিন প্রতিটি কাজ আল্লাহর নামে শুরু করা।

হাদিসে পাকে এসেছে ‘যেই কাজের শুরুতে আল্লাহর নাম নেওয়া না হয় সেই কাজ বরকতশূন্য হয়ে যায়।’ আর যেই কাজের শুরুতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় সেই কাজ বরকতময় হয়ে যায়। যেমন খানা আল্লাহর এক নেয়ামত। যা না খেলে জীবন বাঁচানো সম্ভব নয়। জীবন বাঁচানোর জন্য খানা খেতে হবে।  খানার শুরুতে যদি খানার দোয়া ‘বিসমিল্লাহে ওয়ালা বারাকাতিল্লাহ্’ পড়ি। আল্লাহ চাহে তো  আমাদের খানা বরকতপূর্ণ হবে। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে বরকতময় জীবনধারণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

                লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর