শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দুর্বোধ্য রাজনৈতিক সমীকরণ

হায়দার আকবর খান রনো

দুর্বোধ্য রাজনৈতিক সমীকরণ

ইসলামী স্টেট নামক বীভৎস ইসলামী মৌলবাদী ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসী সংগঠনটি সম্প্রতি প্যারিসে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও বাংলাদেশে সম্প্রতি সংঘটিত কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের এক ধরনের যোগসূত্র অবশ্যই আছে। দুজন ইতালি নাগরিক (তার মধ্যে একজন ছিলেন মানবদরদী চিকিৎসক) ও একজন জাপানি নাগরিকের হত্যা, শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা ও হত্যা, পরপর পাঁচজন মুক্তমনা লেখক, ব্লগার ও প্রকাশককে চাপাতির আঘাত দ্বারা হত্যা, ঈশ্বরদীতে খ্রিস্টান যাজককে গলা কেটে হত্যাপ্রচেষ্টা- এগুলো কোনোটিই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।  এমনকি দূর ইউরোপে প্যারিসের হত্যাকাণ্ড আর বাংলাদেশের এসব ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে বাঁধা। পবিত্র ইসলাম ধর্মের নামে এই যে ইসলামবিরোধী ঘৃণ্য তৎপরতা চলছে তা সে আইএস হোক, আল নুসারা হোক অথবা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমই হোক- সবাই একই ধরনের ভাবাদর্শের দ্বারা সংযুক্ত। কোনোটাই বিচ্ছিন্ন নয়। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বারবার এগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে বিবৃতি দিয়ে বস্তুত এসব হত্যাকাণ্ড বা হত্যাপ্রচেষ্টার ঘটনাগুলোর তাৎপর্যকে লঘু করে দেখছেন এবং দেখাচ্ছেন।

আর ঠিক সেই কারণেই এই ঘাতকদের ধরা হচ্ছে না, বিচার শুরু তো আরও দূরের কথা। সেজন্য অধ্যাপক ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্পষ্টতই বলেছেন, ‘মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার হত্যাকারীদের ধরতে সরকার আন্তরিক নয়।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে খুনের ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলেছেন, সে প্রসঙ্গে লেখক-অধ্যাপক জাফর ইকবালের মন্তব্য ছিল- ‘হয় আমি বিচ্ছিন্নতার মানে বুঝি না অথবা উনি বিচ্ছিন্নতার মানে বোঝেন না।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন ৫ নভেম্বর ২০১৫)। তারপর ড. জাফর ইকবাল যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন সেটা আমারও প্রশ্ন, আমাদের অনেকেরই প্রশ্ন, ‘কিন্তু যে বিষয়টা আমরা বুঝতে পারি না, তা হলো আমাদের সরকার এত নির্লিপ্ত কেন?’

এর কদিন পর লেখক ও বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল যে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন তা সত্যিই বড় ভাবনার বিষয়। আরও স্পষ্ট করে বললে দুর্ভাবনার বিষয়। তিনি বলেছেন, ‘(তরুণ সমাজ) বুঝে গেছে এ সরকার ব্লগার-লেখক-প্রকাশক হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে মোটেও আন্তরিক নয়। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, সরকার কোনো এক ধরনের দুর্বোধ্য রাজনৈতিক সমীকরণ সমাধান করার জন্য নিজেরাই এ ঘটনাগুলো ঘটিয়ে যাচ্ছে কিংবা ঘটতে দিচ্ছে।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৬ নভেম্বর ২০১৫)।

প্রায় একই ধরনের সন্দেহ প্রকাশ করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের প্রধান ডা. এমরান এইচ সরকারসহ অনেকেই। শর্ষের মধ্যেই কি ভূত লুকিয়ে আছে? প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও দর্শনের অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকও বলেছেন, (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৫ নভেম্বর ২০১৫) ‘কম্পিউটার টেকনোলজি, টেলিফোন ইত্যাদির যুগে টানা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাওয়া একজনও কেন ধরা পড়ে না, তা কারও বোধগম্য নয়।’

 

আমি সন্দেহবাতিক নই। আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। কিন্তু মুশকিলটা হয় তখনই যখন সরকার প্রকৃত আসামি ধরার চেয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সুযোগ খোঁজে। এ ক্ষেত্রে জামায়াত বা ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর চেয়ে সরকারের কাছে অধিকতর শত্র“ হলো প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। সে জন্য এ ধরনের কোনো দুর্ঘটনা বা খুন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারের মন্ত্রিবর্গ, নেতৃবৃন্দ এমনকি পুলিশ কর্মকর্তা (যারা এখন রাজনীতিকের ভূমিকা নিচ্ছেন) কোনো তদন্ত না করেই দোষ চাপিয়ে দেন প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর। ফলে প্রকৃত তদন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমনটা হয়েছিল বিগত বিএনপি আমলে। জজ মিয়ার মতো ভুয়া আসামি তৈরি হয়। এ প্রসঙ্গে গত ৫ নভেম্বরের বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাতায় কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের মন্তব্য ছাপা হয়েছে। সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃত করা যাক। অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে (দুই বিদেশি হত্যা) রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। বড় দলগুলো এ নিয়ে পারিবারিক ঝগড়ার মতো করছে। এটা কে করছে তার হদিস না করে পরস্পরকে দোষারোপ করছে। ব্লেম গেম করছে। এতে প্রকৃত অপরাধী আড়াল হয়ে যায়।

বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক অনুপম সেনও ব্লেম গেমের অভিযোগ এনেছেন। তিনিও বলেছেন, ‘ব্লেম গেমে অপরাধীরা আড়ালে যাচ্ছে।... অবিলম্বে দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ করে আসল অপরাধীদের খুঁজে শাস্তি দিতে হবে।’ বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও একই অভিযোগ করেছেন- ‘রাজনৈতিক দলের পরস্পরনির্ভর অনুমানভিত্তিক দোষাদোষীতে ক্রমাগত হতাশা বাড়ছে।... দেশের প্রধান দুটি দল মনে করে দোষারোপের সংস্কৃতি দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা যাবে। কিন্তু তারা বোঝে না, এতে মানুষ আরও বিরক্ত হয়।’

আওয়ামী লীগ কোনো আদর্শভিত্তিক দল নয়। একদা কিছুটা জাতীয়তাবাদী উম্মাদনা দলের তরুণদের মধ্যে ছিল। এখন সেসবের সামান্যতম অবশিষ্ট নেই। এখন এই দল লুটেরা ধনীদের দল। সম্পদ বৃদ্ধি ও ক্ষমতা দখলই একমাত্র আদর্শ। সেই দলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। জামায়াত নয়। এবং জামায়াতের সঙ্গে কোনো সমঝোতা করে বিএনপিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় কিনা, সেই প্রচেষ্টাই রয়েছে দলের নীতিনির্ধারকদের। এটাকেই সম্ভবত লেখক ও বিজ্ঞানী জাফর ইকবাল দুর্বোধ্য রাজনৈতিক সমীকরণ বলে মনে করেছেন। অন্যদিকে বিএনপির তো আদর্শ বলে কোনো কিছু কোনো দিনই ছিল না। তবু একদা কিছুটা মধ্যপন্থি দল হিসেবে পরিচিতি ছিল। এখন তারা জামায়াতের মিত্রই শুধু নয়, মৌলবাদীদের ভাবাদর্শের কাছেই পুরোপুরি আÍসমর্পণ করেছেন। খালেদা জিয়া যখন গণজাগরণ মঞ্চকে নাস্তিক বলে গাল দেন এবং হেফাজতে ইসলামের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেন, তখন তার অবস্থান হবে চরম দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল জায়গাতেই।

অন্যদিকে বর্তমান সরকারের অনেক সমালোচনা, সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও গণতন্ত্রের বিনাশ সত্ত্বে ও এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হতো না। হয়তো এ কথাও বলা যায় যে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হলে অন্য কারও পক্ষে বিচার সম্পন্ন করা, এমনকি শুরু করা এবং ’৭১-এর অপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলানো সম্ভব হতো কিনা বলা কঠিন।

এই বিচারের ক্ষেত্রেও আমরা অনেক দ্বিধাদ্ব›দ্ব দেখেছি। সরকারের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকেই গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি। মনে পড়ে প্রথমে যে তদন্ত সংস্থা গঠিত হয়েছিল, দেখা গেল তার প্রধান ব্যক্তিটিই ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী। হয়তো ইচ্ছাকৃত ত্র“টি ছিল না। কিন্তু এর দ্বারা সরকারের চরম অমনোযোগিতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। তবু শেষ পর্যন্ত বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে এবং কয়েকজন অপরাধীর ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে।

একদিকে সরকার যেমন যুদ্ধাপরাধীর বিচার অব্যাহত রেখেছে, অপরদিকে ঠিক তার বিপরীতে নানাভাবে মৌলবাদী গোষ্ঠীর ভাবাদর্শের কাছেও আÍসমর্পণ করছে। এ কারণেই ব্লগার-লেখক-প্রকাশক হত্যাকারীদের ধরার ব্যাপারে এত নির্লিপ্ত। এ কারণেই দেখি, গত কয়েক মাসে কয়েক হাজার জামায়াত নেতা ও কর্মীকে আওয়ামী লীগে সসম্মানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একই কারণে দেখি যে, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ওলামা লীগ ব্লগারদের নাস্তিক বলে ঘোষণা দেয়। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকেও তারা ইসলামবিরোধী বলে নির্দেশ জারি করে। নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিহত হলে পুলিশ প্রধান ঘাতককে ধরার চেষ্টা না করে (ঘাতকরা এখনো ধরা পড়েনি, বিচার প্রক্রিয়া তো অনেক দূর) লেখকদের নসিহত দিচ্ছেন, এমন কিছু না লিখতে, যাতে ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। এমন বক্তব্য কার্যত ঘাতকদেরই উৎসাহিত করে। মৌলবাদী ভাবাদর্শের কাছে শাসক গোষ্ঠীর আÍসমর্পণের আরও অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে।

তাহলে রাজনৈতিক সমীকরণ কী ছিল বা আছে? সম্ভবত এমন হতে পারে, জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দিলেও জামায়াতের অন্য নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে সমঝোতায় আসা যেতে পারে। তারা বিএনপিকে পরিত্যাগ করলে শাসকদলের প্রধান প্রতিপক্ষ বন্ধুহীন ও দুর্বল হয়ে পড়বে। সম্ভবত এটাই হচ্ছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভাষায় দুর্বোধ্য রাজনৈতিক সমীকরণ। এই সমীকরণ এতটাই দুর্বোধ্য যে তার সমাধান তদাধিক কঠিন।

এ রকম দুর্বোধ্য রাজনৈতিক সমীকরণ আমরা আন্তর্জাতিক পর‌্যায়েও দেখব। মার্কিন প্রশাসনসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো তেলসমৃদ্ধ মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্য দখল করার জন্য ইসলাম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, আবার অন্যদিকে তারাই তৈরি করেছে আইএস। একদা কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তারা তৈরি করেছিল আল-কায়েদা ও তালেবান। এখন সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য তারাই তৈরি করেছিল আইএস আজ থেকে আড়াই বছর আগে। তাদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল মার্কিনের বশংবদ সৌদি রাজতন্ত্র। আইএস সহযোগিতা পেয়ে আসছে মার্কিনের মিত্র রাষ্ট্র তুরস্কের কাছ থেকে। সে জন্য আইএস কখনো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দেয়নি, কোনো অবস্থান নেয়নি। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন এখন বুঝতে পারছে তারা কী ধরনের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে বিকৃত মস্তিষ্ক উগ্র মৌলবাদী হিংস্র সন্ত্রাসী আইএস প্যারিসে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যা করতে পেরেছে তা হলো- ইউরোপ ও আমেরিকায় মুসলিম জনগোষ্ঠীকে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। শ্বেতাঙ্গ ইউরোপে চরম দক্ষিণপন্থিদের উত্থান ঘটেছে, যারা মুসলমান বিতাড়নের জন্য তৎপর হয়েছে। এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে। আমাদের জন্যও শিক্ষাটা গুরুত্বপূর্ণ। বিষাক্ত সাপ নিয়ে খেলতে গেলে, সেই সাপের ছোবলে মৃত্যুর আশঙ্কা থেকেই যায়।  সরকার যদি সাময়িক স্বার্থে এমন কোনো রাজনৈতিক সমীকরণে আসে অর্থাৎ জামায়াত বা ওই ধরনের ভাবাদর্শের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় আসতে চায়, তবে তার পরিণতি সরকারের জন্যও ভালো হবে না। দেশের জন্য তো নয়ই।

                লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর