শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

কী হয়েছে মুসলমানের!

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

কী হয়েছে মুসলমানের!

দুনিয়ার মুসলমানের কী হয়েছে? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে তারা। রোজাও রাখছে মুসলমান। প্রতি বছর হাজীর সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু দুনিয়ার সব জাতির মধ্যে মুসলমানই আজ সবচেয়ে বেশি অশান্তি ভোগ করছে। এর কারণ কী? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মুসলমানের লোকদেখানো ইবাদত-আরাধনা। স্রষ্টার ইবাদত-আরাধনা করতে হয় পরিশুদ্ধ আত্নায়। নির্মল হৃদয়ে। আজকের মুসলমান তার আত্নায় দুনিয়ার লোভ-লালসা ঠাঁই দিয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে মুসলমানের নিয়ত। অতএব, সে যেসব ইবাদত-আরাধনা করছে এসবই বালতি বালতি দুধে এক ফোঁটা চনার মতো সব ইবাদত-আরাধনা নষ্ট করে দিচ্ছে। হে রব, আমাদের নিয়তকে আপনি বিশুদ্ধ করে দিন। আমরা যেন বিশুদ্ধ নিয়তে আপনাকে স্মরণ করতে পারি।

তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ আজকের পৃথিবীতে আমাদের ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন বান্দার ইবাদতের সময় কমে আসছে, তখন ইবাদত কবুল হওয়া না হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবার ফুরসতও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। পবিত্র কোরআন ও রসুল (সা.)-এর সহি সুন্নাহ থেকে জানা যায়, আমরা যে ইবাদতই করি না কেন তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হওয়ার জন্য প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো ইখলাস। ইখলাস ছাড়া কোনো আমলই আল্লাহর কাছে কবুল হয় না। দুনিয়াবিমুখ খোদাপ্রেমিক সুফিরা মনে করেন, ইখলাসহীন আমলই বান্দার জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রখ্যাত সুফি ও দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিমিয়ায়ে সাআদাতে’ লেখেন, ইখলাস সব আমলের মূল বিষয়। কোনো বান্দা যদি তার পুরো জীবনে সামান্য মুহূর্তও আল্লাহর জন্য খালেসভাবে অতিবাহিত করে, তবে তা বান্দার জান্নাতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে।

আরবি ইখলাস শব্দের অর্থ হলো ‘কোনো বস্তুকে খালি করা বা পরিষ্কার করা।’ সুফিদের দৃষ্টিতে, পার্থিব যে কোনো মোহ ও সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের যাবতীয় লোভ থেকে আত্নাকে খালি বা পরিষ্কার করে একমাত্র আল্লাহর জন্য সমর্পণ করাকেই ইখলাস বলে। প্রখ্যাত সুফি হজরত আবু উসমান (র.) বলেন, ‘নিজের প্রতি মহান আল্লাহর সার্বক্ষণিক দৃষ্টির কথা স্মরণ রেখে সৃষ্টজীবের সব কৃত্রিমতা ভুলে যাওয়ার নাম ইখলাস।’ ইখলাসের ব্যাখ্যায় অপর সুফি ফুজাইল (র.) বলেছেন, ‘মানুষের জন্য আমল করার নাম রিয়া আর মানুষের কারণে আমল ছেড়ে দেওয়ার নাম শিরক। কিন্তু এ দুটি থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর জন্য আমল করাই হচ্ছে ইখলাস।’

পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহতায়ালা আমাদের ইখলাসের সঙ্গে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ইবাদতে মগ্ন হওয়ার আদেশ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘তাদের এ ছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত দেবে। আর জেনে রাখ এটাই সঠিক ধর্ম, (সূরা বাইয়েনাত : ৫)। অন্যত্র তিনি বলেছেন, আমি আপনার প্রতি এ কিতাব যথার্থভাবে নাজিল করেছি। অতএব, আপনি নিষ্ঠার সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করুন। কেবল নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদতই আল্লাহর জন্য, (সূরা জুমার ২-৩)। ‘হে নবী আপনি বলুন, আমি নিষ্ঠার সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছি, (সূরা জুমার, ১১)।

হাদিসে রসুলের আমরা ইখলাসের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেখতে পাই। রসুল (সা.) বলেছেন, বান্দার আমলগুলোর মধ্যে আল্লাহতায়ালা শুধু সেই আমলই গ্রহণ করেন যা ইখলাসের সঙ্গে তার সন্তুষ্টির জন্য করা হয়ছে। (সুনানে নাসায়ি।) মহান আল্লাহর কাছে আমাদের যাবতীয় আমল গৃহীত হওয়ার ক্ষেত্রে বাহ্যিক কোনো রং-ঢং নয় বরং ইখলাসই বিবেচ্য বিষয়। এ সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের শরীর এবং আকৃতির দিকে লক্ষ্য করেন না, বরং তিনি তোমাদের আত্না দেখেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

তিনি (সা.) আরও বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই প্রতিটি আমল বা কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (বুখারি)। এ প্রসিদ্ধ হাদিসের ব্যাখ্যায় সুফিরা বলেন, অনেক ছোট কাজ নিয়তের কারণে মহান আল্লাহর কাছে খুব মূল্যবান ও দামি হয়ে যায়। আবার অনেক বড় কাজ নিয়তের ত্র“টির কারণে তুচ্ছ ও অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। যেমন পবিত্র কোরআনে সূরা ফোরকানের ২৩নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাদের আমলগুলো দেখব এবং সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব।’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনুল কায়্যিম (র.) বলেন, ‘বান্দার আমল বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করার কারণ হলো আমলগুলো রসুল (সা.)-এর সুন্নাত অনুযায়ী করা হয়নি অথবা ইখলাসের সঙ্গে করা হয়নি। (মাদারেজুস সালেকীন।)

ইখলাসের তাৎপর্য সম্পর্কে সহি মুসলিমে সুফি সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি বড় হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হাদিসের সারমর্ম হলো- কেয়ামতের দিন আল্লাহ এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি আমার সন্তুষ্টির জন্য কী করেছ? বান্দা বলবে, আমার জীবন আপনার রাহে কোরবান করেছি। কাফেরদের সঙ্গে লড়াই করে শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। মানুষ তোমাকে বীর বলবে এ জন্য তুমি লড়াই করেছ, শহীদ হয়েছ। জাহান্নামই তোমার প্রকৃত আবাস। অপর ব্যক্তি বলবে, আল্লাহ আমার সব সম্পদ আমি আপনার জন্য দান করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। মানুষ তোমাকে দানবীর বলবে এ জন্য তুমি দান করেছ। আরেকজন বলবে, আল্লাহ আপনি আমাকে কোরআনের জ্ঞান দান করেছেন, আমি মানুষের মাঝে তা প্রচার করেছি।  আল্লাহ বলবেন, মানুষ তোমাকে জ্ঞানী বলবে, হাদিয়া তোহফা দেবে এ জন্যই তুমি জ্ঞান বিতরণ করেছ। কোরআনের প্রচারক হওয়া সত্তে¡ও আজ তুমি কাক্সিক্ষত জান্নাতে যেতে পারবে না। কারণ তোমার ইবাদতে ইখলাস ছিল না।  মহান আল্লাহ আমাদের ইখলাসপূর্ণ লৌকিকতামুক্ত ইবাদত করার তৌফিক দিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর