বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সেইসব দিন-১

তসলিমা নাসরিন

সেইসব দিন-১

বাবা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের জুরিসপ্রুডেন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। কোনও অধ্যাপক না থাকায় তিনিই বিভাগটির হর্তাকর্তা। সকালবেলা প্রায়ই বাবার সঙ্গে রিক্সা করে কলেজে যাই। অর্ধেক পথ তিনি উদার হস্তে উপদেশ বিতরণ করেন। এক চান্সে মেডিকেলটা পাস করতে যেন পারো, সেইভাবে লেখাপড়া কর। ভাল যে বাবা বলছেন না পরীক্ষায় তারকাখচিত কিছু না পেলে তিনি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন। মেডিকেলে একবার ঢোকা মানে একদিন না একদিন ডাক্তার হয়ে বেরোনো, এ জিনিসটি তিনি বিশ্বাস করেন, তাই বেশ নিশ্চিন্ত দেখায় তাঁকে। মেডিকেলের পরীক্ষাগুলো শাদামাটা পাস করে যাওয়াই অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার, ভাল ছাত্রছাত্রীদের দ্বারাও সবসময় এ কাজটি সম্ভব হয় না। এনাটমি ফিজিওলজির জটিল জিনিসগুলো নিয়ে, যেগুলো মাথায় ঢুকেও ঢুকতে চায় না, কোনও প্রশ্ন করলে বাবা এমন সহজ সরল করে উত্তর দেন যে সুড়সুড় করে সব মগজে প্রবেশ করে। এমন কোনও প্রশ্ন নেই, যার উত্তর তিনি জানেন না। এখনও রাত জেগে পড়াশোনা করেন। যেদিন  ক্লাস নেবেন, তার আগের রাতে প্রায় দুটো পর্যন্ত পড়ে তবে বিছানায় যান। একসময় তিনি লিটন মেডিকেল ইশকুলে এনাটমির শিক্ষক ছিলেন। সেই লিটন তো কবেই উঠে গেছে, এখন আর বিদ্যালয় নেই, এখন মহাবিদ্যালয়, লাগোয়া মহা-হাসপাতাল, মহা-ক্যাম্পাস, আর আর মহাই বেশিরভাগ শিক্ষকমণ্ডলীর, বাবা বলেন বাবার ছাত্র ছিলেন। এক ধরনের সুখ হয় শুনে, আমি যত না নিজের নামে চেনা, তার চেয়ে বেশি চেনা রজবআলী স্যারের মেয়ে হিসেবে, অন্তত কলেজে।

জটিল চিকিৎসাশাস্ত্রের জট খুলে দিতে থাকা বাবাকে আমার বড় আপন বলে মনে হয়। এ এক নতুন বাবা। বাড়ি ফিরেই আমাকে তিনি কাছে ডাকেন। সঙ্গে নিয়ে খেতে বসেন। খেতে খেতে গল্প করেন। নতুন কোনও বিদ্যা অর্জন হয়েছে কি না জানতে চান। যদি বলি না কিচ্ছু হয়নি, মোটেও বিরক্ত হন না, বরং পরম আগ্রহে তিনি কোনও একটি বিষয়ে উত্থাপন করেন। ধরা যাক লিভার, ফস করে বলে দিই, ‘লিভারের কিচ্ছু আমি বুঝতাছি না।’ তিনি, হেসে, আমাকে পাশে বসিয়ে, আমার হাতখানি টেনে নিজের বুকের ওপর রেখে, বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে লিভার দেখতে কেমন, লিভার কোথায় থাকে, লিভার কী করে, লিভারে কী কী  অসুখ হয়, সেই অসুখের ওষুধ কী করে দিতে হয় সব গল্পের মত করে বলে যান। এই যে আমি নির্দ্বিধায় বলে দিই যে আমি লিভার সম্পর্কে কিছু জানি না, তিনি কিন্তু একবারও দাঁত খিঁচিয়ে বলেন না, ‘কেন জানস না? বইএর প্রথম পৃষ্ঠা থেইকা শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মুখস্থ, ঠোঁটস্থ, অন্তঃস্থ কইরা ফালা।’ আমার লেখাপড়ার ব্যাপারে এরকম দুশ্চিন্তা না করা বাবাকে আমি আর আগে দেখিনি। আমাকে তিনি পড়ার টেবিলে দেখতে চান, এরকম কোনও দাবিও আর জানান না। আমি আড্ডা দিলে বা পড়ে পড়ে ঘুমোলে বাবা রাগ করেন না। বাবার দৃষ্টি ইয়াসমিনে। ওকে টেনে ঘুম থেকে ওঠানো, ঘাড় ধরে পড়তে বসানো, খেলা থেকে তাড়ানো, মনীষীদের বাণী শোনানো, মেট্রিকে তারকাখচিত নম্বর না পেলে ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি শোনানোর কর্তব্য নিরলসভাবে পালন করে যান। আমাকে নিয়ে বাবার নিশ্চিন্তি দেখে ছোটবাজারের হরিপদ মলি­কের বাদ্যযন্ত্রের দোকান সুর তরঙ্গ থেকে দেখে শুনে একটি গিটার কিনে গিটারে টুং টাং শব্দ তুলি, গিটারে গান বাজানোর স্বপ্নটি টুং টাং করে হৃদয়ে সুর তোলে সারাদিন। ভাল গিটারবাদক হিসেবে নাম আছে শাহাদাত হোসেন খান হিলুর, কেবল গিটারবাদক হিসেবে নয়, হিলুকে এক ডাকে শহরের সবাই চেনে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হিলু সর্বদা বিরাজমান, তাঁকে গুরু বলে মানার লোকেরও অভাব নেই, মাসুদের গুরু তিনি, রুদ্রর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর রুদ্ররও গুরু-মতো হয়ে গেলেন, মোহাম্মদ আলী মিনার বলে একটি লম্বামত নবীন গল্পলেখককে নিয়ে রুদ্র একবার ময়মনসিংহ এসেছিল, সেই মিনারও শিষ্য হয়ে গেল হিলুর, হিলু এমনই সম্মোহনী শক্তি ধারণ করেন। ছোটদা আর গীতার সঙ্গেও হিলুর ঘনিষ্ঠতা ছিল, দাদারও নাকি বন্ধু। একদিন আকুয়ায়, নানিবাড়ির খুব দূরে নয়, তাঁর বিশাল পুকুরঅলা বাড়িতে গিয়ে অনুরোধ করি আমাকে যেন তিনি গিটার শেখান। শুনেছিলাম তিনি কাউকে শেখান না গিটার, গীতা বলেছে মেয়েমানুষদের নাকি দুচোক্ষে দেখতে পারেন না, সেই হিলু যখন রাজি হয়ে যান আমাকে শেখাবেন গিটার, আমি হাতে কী পেয়ে যাই, তা ঠিক তক্ষুনি ঠাহর করতে পারি না। অসম্ভবকে সম্ভব করলে যেমন আনন্দ হয়, তেমন হয় আমার। হঠাৎ যেন সোনার মোহরের কলস পেয়ে গেছি, কলসের গলা পেঁচিয়ে থাকা সাপ চলে গেছে কোথাও কামিনীর গন্ধ শুঁকতে। সপ্তাহে তিন সন্ধেয় তিনি আসেন গিটার শেখাতে, তিনি এলে আর সব গৃহশিক্ষককে যেমন চা বিস্কুট দেওয়া হয়, তাঁকেও দেওয়া হয়। মাও হিলুকে চেনেন, হিলুর বড় ভাই হাশেমমামার বন্ধু। হিলুর জন্য মা বেশি করে মিষ্টি দিয়ে পায়েস বানান। হিলু আমাকে উদারা মুদারা তারা ইত্যাদি শিখিয়ে মার হাতের চা আর পায়েস খেয়ে উঠে যান। দাদা এক সন্ধেয় মুখোমুখি হন হিলুর। দাদার মখুটি হিলুকে দেখেই ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে, ফ্যাকাসে মুখটিতে ম্লান একটি হাসি ধরে রাখেন তিনি। হিলু চলে যাওয়ার পর ফ্যাকাসে মুখ থেকে হাসিটি বিদেয় করে বলেন, ‘হিলুরে কইছস কেন গিটার শিখাইতে?’

 

 

-‘তাতে কী হইছে?’

কী হয়েছে তা তিনি বলেন না। কেবল জিভে অপছন্দের চুক চুক শব্দ করেন।

মাস গেলে হিলুকে শাদা খামে দুশ টাকা পুরে দিতে যাই সম্মানী।

জিজ্ঞেস করেন, ‘এইটা কী?’

-‘টাকা।’

-‘টাকা কেন?’

টাকা কেন, তা না বোঝার কথা নয় হিলুর। ঠোঁটে বাঁকা একটি হাসি, বলেন, ‘তোমারে গিটার শিখাই বইলা তুমি কি আমারে বেতন দিতাছ নাকি?’

আমি চুপ হয়ে থাকি। হিলু টাকা নেননি। শত অনুনয়েও না। হিলু ধনীর ছেলে, টাকার তাঁর প্রয়োজন নেই সে জানি। কিন্তু মাগনা শিখতে আমার অস্বস্তি হয়! আমার অস্বস্তি থাকে, সেই সঙ্গে আমার জন্য হিলুর এই ত্যাগ, সন্ধের অনুষ্ঠানাদি ফেলে আমাকে সময় দেওয়ার জন্য থাকে হিলুর প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধাবোধ। এই বোধের মধ্যে একদিন সামনে দাঁড়ালেন বাবা। হিলু বৈঠকঘরে বসে আমাকে গিটার শেখাচ্ছেন দৃশ্যটি দেখে তিনি এমন চমকে উঠলেন যেন ভ‚ত দেখছেন। বাবাকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন হিলু। সালামের প্রত্যুত্তর ঘৃণ্য কটাক্ষ। বাবা ভেতর ঘরে গিয়ে বাড়ি ফাটিয়ে আমাকে ডাকেন। সামনে আমি আর আমার হৃদকম্প দাঁড়ায়।

-‘হিলু আইছে কেন?’

-‘গিটার শিখায় আমারে।’

-‘গিটার শিখা এই বাড়িতে চলবে না। ওরে  এক্ষুনি এই মুহূর্তে ভাগা। একটা বদমাইস আমার বাড়িতে আইছে। কত বড় সাহস!’

হিলু নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছেন বাবার বাক্যগুলো, আমি না পারছি শ্বাস ফেলতে না পারছি নিতে। না এটি ঘটছে না, বাবা কিছুই বলছেন না, হিলু ওঘরে হতভম্ব দাঁড়িয়ে নেই, তাঁর কানে কোনও মালকোষ রাগের সুর ছাড়া আর কিছু প্রবেশ করছে না, আমি প্রাণপণে নিজেকে বোঝাতে চাইছি, কোনও অঘটন ঘটছে না বাড়িতে, এ আমার দুঃস্বপ্ন কেবল। একঘর অন্ধকার নিয়ে স্থবির দাঁড়িয়ে থাকি, মাথাটি গ্যাস বেলুনের মত আমাকে ছেড়ে উড়ে যেতে থাকে আকাশে, মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হতে। শরীর, আমি লক্ষ করি, চলৎশক্তিহীন। পাথর চাপা পড়া হলদে ঘাসের মত মরা শরীর, ব্যাঙের ছাতা গজিয়ে যাওয়া স্যাঁতসেঁতে শরীর। হিলুকে সে রাতে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন বাবা। তাড়িয়ে দেবার পর আস্ফালন করতে থাকেন বাড়িময়।

-‘হিলুরে কে না চেনে? শহরের নামকরা গুণ্ডা। এই নোমান! নোমান! দাদাকে চিলি­য়ে কাছে এনে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, তুই কি জানতি হিলু এই বাড়িতে আসে?’

দাদা হ্যাঁ সূচক না সূচক দু’রকমই মাথা নাড়েন।

লেলিহান আগুনের পাশে এক আঁজলা ঠাণ্ডা জল নিয়ে দাঁড়ান মা, ‘হিলু তো এই বাড়িতে কোনও গুণ্ডামি করতে আসে নাই!’

মা’র মন্তব্যের দিকে বাবা ফিরেও তাকান না। আগুন আগুনের মত জ্বলে, জল মার আঁজলা থেকে পড়ে মেঝে ভিজিয়ে দেয়। সারারাতই কড়িকাঠের দিকে মেলা আমার অনড় দুই চোখ থেকে বাবার প্রতি ঘৃণা আর ক্ষোভ চুইয়ে পড়ে। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বিছানায় আমার পাশে এসে বসেন।

-‘এত দেমাগ তর বাপের! কিয়ের এত দেমাগ বুঝি না। মাইনষে অভিশাপ দিব। মানুষের সাথে অন্যায় আচরণ করলে মানুষ অভিশাপ দিব না কেন? নিশ্চয়ই দিব’।

গিটার শেখা জম্নের মত বন্ধ হল। ঘরের এক কোণে জিনিসটি পড়ে থাকে, পড়ে থেকে থেকে ধুলো আর মাকড়সার বাসা হয়ে ওঠে। অনেকদিন ভেবেছি হিলুর কাছে গিয়ে একদিন করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইব, কিন্তু এত ছোট মুখ নিয়ে অত বড় মানুষটির সামনে দাঁড়াতে আমার সঙ্কোচ হয়েছে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর